পথে, মাঠে, ঘরে নারীর প্রতি বিদ্বেষ-সহিংসতা

নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানববন্ধন শেষে বিক্ষোভ। গতকাল বিকেলেছবি: প্রথম আলো

বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময়ের একটি ছবি সম্প্রতি ফেসবুকে ছড়িয়েছে। বোরকা আর টি–শার্ট-প্যান্ট পরা দুই নারী লাঠি হাতে পাশাপাশি দাঁড়ানো। আন্দোলনের সময়ে পোশাক নিয়ে প্রশ্ন না উঠলে এখন কেন? কেন এই যুগে এসে ‘ওড়না গায়ে থাকা না-থাকা নিয়ে’ একটি মেয়েকে হেনস্তার শিকার হতে হয়? কেন নিপীড়নকারীকে ‘বরণ’ করা হয় ফুলের মালা দিয়ে? এসব প্রশ্ন ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

এক তরুণীর সাক্ষাৎকার ভাইরাল হয়েছে এই সময়ে। তরুণীর প্রতি প্রশ্ন ছিল, ‘২৪ ঘণ্টার জন্য যদি পৃথিবী থেকে সমস্ত পুরুষ উধাও হয়ে যায়, আপনি কী করবেন?’—উত্তরে তরুণী বলেছিলেন, ‘রাতে একা হাঁটতাম। রাত তিনটা বাজে হেঁটে দেখব কেমন লাগে।’

এ দেশে একজন নারীর রাতে একা হাঁটতে চাওয়ার ইচ্ছা যে কত ‘বড় ইচ্ছা’, তা নারীমাত্রই উপলব্ধি করতে পারেন। এখানে দিনের বেলাও নারীর নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয়। পথ, জনপরিসর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, খেলার মাঠ, ঘরে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন, নিপীড়ন ও হেনস্তার ঘটনাগুলোই নারীর ভয় বাড়িয়েছে।

অসহনশীল ও অনিরাপদ পরিবেশ নারী ও মেয়েদের স্বাভাবিক চলাচলকে ব্যাহত করছে।

গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই আন্দোলনকারী নারীদের বিরুদ্ধে অনলাইনে নিপীড়নমূলক অপপ্রচার থেকে শুরু করে সম্প্রতি জনপরিসরে নারী নিপীড়নের যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা উন্নত করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার কোনো উদ্যোগ তো নেয়নি, বরং তাদের এই নীরবতা ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের প্রতি নতজানু সমর্থনকে প্রকাশ করছে।
অধিকারকর্মী মারজিয়া প্রভা

১ মার্চ মোহাম্মদপুরে ‘পাবলিক প্লেসে’ (জনপরিসরে) ধূমপান করাকে কেন্দ্র করে দুই নারীকে ‘মব’ (একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা) সৃষ্টি করে মেরে রক্তাক্ত করা হয়। ৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে ‘ওড়না পরা’ নিয়ে হেনস্তা করার অভিযোগ ওঠে মোস্তফা আসিফ অর্ণব নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। ওই ব্যক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে সহকারী বাইন্ডার। মেয়েটি মামলা করায় গ্রেপ্তার করা হয় ওই ব্যক্তিকে। ঘটনা শুধু এখানেই শেষ নয়, অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে এবং ওই মেয়ের বিরুদ্ধে একটি গোষ্ঠী তৎপর হয়ে ওঠে। পরদিন জামিনে মুক্ত হওয়ার পর ওই ব্যক্তিকে ফুলের মালা দিয়ে, পাগড়ি পরিয়ে বরণ করে ওই গোষ্ঠী–সমর্থিত লোকজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে হেনস্তার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া মোস্তফা আসিফ (লাল পলো শার্ট পরা)। পরে তিনি জামিন পান
ছবি: সংগৃহীত

এর আগে বাসে ডাকাতি করার সময় নারীদের যৌন নিপীড়ন, ঘরে-বাইরে নির্যাতন-ধর্ষণ এবং দেশের দুটি এলাকায় নারী ফুটবল খেলা আয়োজন বন্ধ করার ঘটনাও ঘটে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে থেকে আন্দোলন করা নারীদের ওপর সাইবার আক্রমণ তো রয়েছেই। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত কয়েক মাসে এ ধরনের ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে অধিকারকর্মীদের ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে। ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে এখন পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে গণপদযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল, মশালমিছিল, প্রতিবাদ-সমাবেশ অব্যাহত থাকার মধ্যেই নতুন নতুন ঘটনা ঘটে চলেছে।

আরও পড়ুন

এসব প্রতিবাদ-আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে রয়েছেন অধিকারকর্মী মারজিয়া প্রভা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমাদের বর্তমান সমাজে নানাবিধ পিতৃতান্ত্রিক প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যা নারী নির্যাতনের প্রবণতাকে জারি রাখে। সেটিকে বিবেচনা করেই বলতে চাই, গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই আন্দোলনকারী নারীদের বিরুদ্ধে অনলাইনে নিপীড়নমূলক অপপ্রচার থেকে শুরু করে সম্প্রতি জনপরিসরে নারী নিপীড়নের যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা উন্নত করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার কোনো উদ্যোগ তো নেয়নি, বরং তাদের এই নীরবতা ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের প্রতি নতজানু সমর্থনকে প্রকাশ করছে।’

‘ওরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও লালমাটিয়ায় হেনস্তার শিকার ভুক্তভোগী নারীদের সঙ্গে পরিচিতদের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। ওই মেয়েরা জানিয়েছেন, তাঁরা মানসিকভাবে এতটা বিপর্যস্ত যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চান না। ওড়না নিয়ে ঘটনার ভুক্তভোগী মামলা করলেও তা এখন চালাতে চাইছেন না। আর ধূমপানকে কেন্দ্র করে দুই নারীকে মারধরের ঘটনায় মামলা হয়নি।

ওই দুটি ঘটনাতেই ভুক্তভোগীদের সঙ্গে থানায় উপস্থিত ছিলেন সীমা আক্তার। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য। ওড়না নিয়ে ঘটনায় সীমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ভুক্তভোগী নারী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। নিরাপত্তার জন্য তিনি মামলা প্রত্যাহার করে নিতে চাইছেন। তবে অভিযুক্ত মোস্তফা আসিফ অর্ণবকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনার পর যেভাবে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়েছে তার ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সমাজে। নারীরা বাসা থেকে বের হতে ভয় পাবে। তিনি বলেন, একটি গোষ্ঠী নারীদের কোনো জায়গা দিতে চাইছে না। তারা নারীর বিরুদ্ধে অনলাইনে প্রচণ্ড সক্রিয়। তারা গণ-অভ্যুত্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে।

ধূমপানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই নারীকে মব সৃষ্টি করে মারধরের ঘটনায় থানায় উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলী। দুই নারীর একজন তাঁর ক্যাম্পাসের জুনিয়র। ঋদ্ধ ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে বলেন, মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে দেখি বাইরে এক থেকে দেড় শ জনের মব। ভুক্তভোগীরা মামলা করতে চাইছিল। আত্মরক্ষার জন্য একটি মেয়ে হামলাকারী ব্যক্তির দিকে কাপ ছুড়ে মেরেছিল। সেটাকেই ইস্যু করে ওই লোক পাল্টা মামলা করতে চাইছিল। পরে সমঝোতার মাধ্যমে দুই পক্ষের কেউ মামলা করেনি।

আরও পড়ুন

‘ভয়ে বাসায় চলে এসেছি’

খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার মঙ্গলী বাগচীর কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। স্থানীয় ফুটবল খেলোয়াড়। দেড় বছর আগে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে মেরে তার মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ‘এত বড় মেয়ে হাফপ্যান্ট পরে কেন খেলে’ বলে বিদ্রূপ করা হয়েছিল। মারধরে আহত হয়েছিল আরও তিন কিশোরী খেলোয়াড়। এ নিয়ে স্থানীয় তিনজনের বিরুদ্ধে এখনো মামলা চলছে। তবে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, সেই মঙ্গলী এখন আবার নতুন করে চাপের মধ্যে। নারী ফুটবলের বিরুদ্ধে একটি চক্র নতুন করে সক্রিয় হওয়ায় আতঙ্কে মেস ছেড়ে তিনি বাসায় চলে গেছেন।

গত ২৯ জানুয়ারি জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে টিনের বেড়া ভাঙচুরের পর নারীদের প্রীতি ফুটবল ম্যাচটি বাতিল করা হয়। পরে ৫ ফেব্রুয়ারি উপজেলা প্রশাসন ঢাকা থেকে নারী দল এনে ওই মাঠে হাজারো দর্শকের উপস্থিতিতে খেলার আয়োজন করে। ৬ ফেব্রুয়ারি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় জয়পুরহাট নারী দল ও রাজশাহী নারী দলের খেলা বাতিল হয় বিক্ষোভের হুমকির মুখে।

আরও পড়ুন

নারী নির্যাতনের ঘটনা

নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ধারা কম-বেশি আগের মতোই রয়েছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বাংলাদেশ: ‘নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪’ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদন অনুসারে, জীবনসঙ্গী বা স্বামী কর্তৃক সহিংসতা (আইপিভি) বাংলাদেশে এতটাই প্রকট যে প্রায় ৭০ ভাগ নারী তাঁদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও শারীরিক, যৌন, মানসিক এবং অর্থনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন। ৪১ শতাংশ নারীর ক্ষেত্রে গত ১২ মাসে এই সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলার সংখ্যা কম। তবে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের বেশ কিছু ঘটনা জনমনে গভীর দাগ কেটেছে। বিশেষ করে বাসে ডাকাতির সময় নারীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনা। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী বাসে ডাকাতেরা ডাকাতির সময় নারী যাত্রীদের যৌন নিপীড়ন করে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১৭ হাজার ৫৭১টি। এর মধ্যে ৬ হাজার ৮৬৭টি মামলা হয়েছে আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। ২০২৩ সালে মামলা হয়েছিল ১৮ হাজার ৯৪১টি। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ১ হাজার ৪৪০টি মামলা হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির জন্য নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও সরকারি পর্যায় থেকে আশাব্যঞ্জক সাড়া নেই। বিশেষ করে লালমাটিয়ার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর মন্তব্য নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যতটুকু জেনেছি, তারা (দুই তরুণী) নাকি সিগারেট খাচ্ছিল, কিছু লোক সেখান দিয়ে নামাজ পড়তে যাচ্ছিল। তারা (লোকেরা) বাধা দেওয়ায় তাদের ওপর চা ছুড়ে মেরেছিল।’ তিনি বলেন, ‘পাবলিক প্লেসে ধূমপান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য অপরাধ। তাই সবাইকে অনুরোধ করব, কেউ যেন উন্মুক্ত স্থানে ধূমপান না করে।’

দায়সারা এসব বক্তব্য না দিয়ে নারী নির্যাতনকারীদের কঠোরভাবে দমনে সরকারের দৃশ্যমান কিছু কাজ আশা করছে জনগণ। তা না হলে নির্যাতনের শিকার হয়ে মাগুরার যে শিশুটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে, তার পরিবারও এ দেশকে নিজের বলে ভাবতে পারবে না।

মাগুরার শিশুটির প্রসঙ্গ টেনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যদি দায়িত্ব এড়িয়ে যাই, শিশুটির কাছে অপরাধী হব।’ সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পরোক্ষভাবে অপরাধীদের প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। সরকারের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য। আমরা ব্যথিত যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে মন্তব্য আসছে না। এ অবস্থায় নারী আন্দোলনের এককভাবে কিছু করা দুরূহ। নারী আন্দোলনের সঙ্গে শিক্ষার্থী ও নাগরিক সমাজকে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করতে হবে।’