গত বছর ৮২ লাখ জন্মনিবন্ধন, সেপ্টেম্বরে সর্বনিম্ন

জন্মনিবন্ধন

গত বছরের জন্মনিবন্ধনের হিসাবের দিকে তাকালে চোখ আটকে যায় সেপ্টেম্বরে। ওই মাসে জন্মনিবন্ধনের সংখ্যা ছিল অস্বাভাবিক হারে কম। বিশেষ করে বছরের শুরুর মাস জানুয়ারির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরে জন্মনিবন্ধন কমে পাঁচ ভাগের এক ভাগে এসে ঠেকেছিল। ওই সময়ে যাঁরা নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগকেই তখন বারবার একটি কথাই শুনতে হয়েছে—‘সার্ভার ডাউন’।

দুর্বল সার্ভার, নিবন্ধনকারীদের তথ্য ফাঁস, রাজস্ব পাওয়ার দাবিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তিন মাস নিবন্ধনকাজ বন্ধ রাখাও নিবন্ধনের সংখ্যা কমাতে ভূমিকা রেখেছে।

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের তথ্য বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন সময়ে মাঠপর্যায়ের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, গত বছরের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধন ছিল ‘আতঙ্কের বিষয়’। ভোগান্তির কথা বলতে গিয়ে আবেদনকারীদের ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। কেউ কেউ কেঁদেও ফেলেছেন।

রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের তথ্যানুসারে, ২০১০ সাল থেকে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ অনলাইনে হচ্ছে। গত বছর মোট জন্মনিবন্ধন হয়েছে ৮২ লাখ ৪২ হাজার ৩১১টি। মৃত্যুনিবন্ধন হয়েছে ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৬৭৩টি।

এক দিন বয়সী শিশুর জন্মনিবন্ধন

রাজধানীর কুড়িল এলাকার মো. আবু বকর সিদ্দিক সরকারের একমাত্র সন্তান মো. ইয়াসিন সরকারের বয়স এখন তিন বছর। তিনি এখনো সন্তানের জন্মনিবন্ধন করাননি। প্রথম আলোকে তিনি জানান, সন্তানকে স্কুলে ভর্তির সময়ে জন্মনিবন্ধন করতে চাইছেন তিনি।

কুড়িল মিয়াবাড়ী এলাকায় ঢাকা নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে-৫ সন্তানের চিকিৎসার জন্য আসা শাহানাজ আক্তার এই প্রতিবেদককে বলেন, তাঁর মেয়ে শেহতাজের বয়স ২৪ দিন। এখনো তার জন্মনিবন্ধন করাননি।

জন্মনিবন্ধনের ‘চরম ভোগান্তির’ সময় গত বছরের ১ অক্টোবর রাজধানীর শেওড়াপাড়ার ফারহানা ফেরদৌস নামের এক নারী বলেছিলেন, এক মাস চেষ্টা করার পর একটি দোকান থেকে তাঁর মেয়ের জন্মনিবন্ধনের আবেদন করতে পেরেছিলেন। দোকানের কর্মীরা বলতেন, ‘সার্ভার ডাউন।’ পাসপোর্ট করার প্রয়োজন থাকায় দেড় বছর বয়সী মেয়ের জন্মনিবন্ধন করাতে হয়েছিল তাঁকে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে নবজাতকদের জন্মনিবন্ধনের হার অনেক কম। বিশেষ প্রয়োজনে বা পাসপোর্ট করার দরকার না হলে স্কুলে ভর্তির আগে সন্তানের জন্মনিবন্ধন করেন না বেশির ভাগ অভিভাবক। কিছু অভিভাবক শিশুর জন্মের পরপরই নিবন্ধন করান।

আরও পড়ুন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু ভর্তির প্রস্তুতি হিসেবে প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে জন্মনিবন্ধনের চাপ বেশি থাকে। গত বছরও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তবে গত বছরের জন্মনিবন্ধনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বরে সবচেয়ে কম জন্মনিবন্ধন হয়েছে। এ সংখ্যা ছিল সোয়া তিন লাখের কিছু বেশি। গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় সেপ্টেম্বরের নিবন্ধনসংখ্যা নেমে আসে এক-পঞ্চমাংশে। জানুয়ারি মাসে নিবন্ধন হয়েছিল ১৫ লাখ ৪৪ হাজারের বেশি।

রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের তথ্যানুসারে, গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৪৮টি, যা মোট জন্মনিবন্ধনের ১ শতাংশের কম। মোট জন্মনিবন্ধনের প্রায় ১২ শতাংশ ২ থেকে ৪৫ দিন বয়সী ও প্রায় ১০ শতাংশ ৪৬ দিন থেকে ১ বছর বয়সী শিশু।

রেজিস্ট্রার জেনারেলের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা যুগ্ম সচিব আবু নছর মোহাম্মদ আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সচেতন অভিভাবক রয়েছেন, যাঁরা সন্তানের জন্মের পরপরই নিবন্ধন করছেন। তাঁর মতে, একদম ছোট শিশুদের জন্মনিবন্ধন করার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে এখন সচেতনতা বেড়েছে।

রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের হিসাব বলছে, গত বছর ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের জন্মনিবন্ধন হয়েছে ৩১ লাখের বেশি, যা মোট জন্মনিবন্ধনের ৩৮ শতাংশ। মোট জন্মনিবন্ধনের প্রায় ২৩ শতাংশ ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী এবং প্রায় ১৮ শতাংশ ১ থেকে ৫ বছর বয়সী।

এ ছাড়া মৃত্যুনিবন্ধনের ক্ষেত্রেও মৃত্যুর পর এক দিনের মধ্যে নিবন্ধন হয়েছে ৯ হাজার ৪৩১টি, যা মোট মৃত্যুনিবন্ধনের ১ শতাংশের বেশি।

যেসব কারণে জন্মনিবন্ধন কম

নিবন্ধন এত ব্যাপক হারে কমে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে ছিল, সার্ভারের দুর্বল ব্যবস্থাপনা। এর মধ্যে গত ৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তি–বিষয়ক সংবাদমাধ্যম টেকক্রাঞ্চে বাংলাদেশের সরকারি একটি ওয়েবসাইট থেকে লাখ লাখ নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। পরে জানা যায়, সেই সরকারি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন।

এ খবর প্রকাশের পর অনলাইনে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের জন্য ব্যক্তির নিজে আবেদন করার সুযোগ আগস্ট মাসজুড়ে বন্ধ থাকে। পরে সার্ভারের ‘ত্রুটি সারানোর’ পরও বেশির ভাগ সময় সার্ভারে কাজ করা যেত না। তবে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় জানিয়েছিল, ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি), সিটি করপোরেশনে কাউন্সিলর কার্যালয়গুলোর সার্ভার ব্যবহারের দক্ষতা ছিল না।

আরও পড়ুন
রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের তথ্যানুসারে, ২০১০ সাল থেকে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ অনলাইনে হচ্ছে। গত বছর মোট জন্মনিবন্ধন হয়েছে ৮২ লাখ ৪২ হাজার ৩১১টি। মৃত্যুনিবন্ধন হয়েছে ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৬৭৩টি।

এ ছাড়া তথ্যভান্ডারে যুক্ত হওয়ার এখতিয়ার চাওয়া নিয়ে ডিএসসিসির সঙ্গে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের দ্বন্দ্ব দেখা দেয় গত বছর। মাস তিনেক বন্ধ থাকার পর ডিএসসিসি গত ৪ অক্টোবর স্বতন্ত্র সার্ভারে নিবন্ধন শুরু করে। তবে তা কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে যুক্ত হচ্ছে না। ফলে মোট নিবন্ধনের তথ্যের মধ্যে ডিএসসিসির হিসাব নেই। আর রেজিস্ট্রার জেনারেলের এখতিয়ারভুক্ত কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে এখনো প্রবেশাধিকার নেই ডিএসসিসির সার্ভারের। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের তথ্য যাচাইয়ে আন্তযোগাযোগের জন্য ডিএসসিসির সঙ্গে সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) নেই। ফলে ডিএসসিসিতে নিবন্ধন করা ব্যক্তিরা পাসপোর্ট করাতে পারছেন না।

‘ভোগান্তি অনেক কমেছে’

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু ভর্তির প্রস্তুতি হিসেবে প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে জন্মনিবন্ধনের চাপ বেশি থাকে। গত বছরও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তবে গত বছরের জন্মনিবন্ধনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বরে সবচেয়ে কম জন্মনিবন্ধন হয়েছে। এ সংখ্যা ছিল সোয়া তিন লাখের কিছু বেশি। গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় সেপ্টেম্বরের নিবন্ধনসংখ্যা নেমে আসে এক-পঞ্চমাংশে। জানুয়ারি মাসে নিবন্ধন হয়েছিল ১৫ লাখ ৪৪ হাজারের বেশি।

মূলত জুন থেকে জন্মনিবন্ধনের সংখ্যা কমতে থাকে। কমের ধারাটি অক্টোবর পর্যন্ত ছিল। এ সময়ে নিবন্ধনের সংখ্যা ছিল সোয়া তিন লাখ থেকে প্রায় পাঁচ লাখের মধ্যে। নভেম্বরে সংখ্যাটি বেড়ে ৬ লাখে পৌঁছায় এবং ডিসেম্বরে তা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যায়।

নিবন্ধনে ভুল থাকা, সেসব ভুল সংশোধনে জটিলতা, অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের অভিযোগ থেকে গেলেও অন্তত অনলাইনে আবেদন করার ক্ষেত্রে গত বছরের শেষ প্রান্তে এসে ভোগান্তি অনেকটাই কমে আসে।

রাজধানীর নূরের চালার সাইদুল ইসলাম জানান, তিনি দোকান থেকে দুদিন চেষ্টার পর নিজের বাসার কম্পিউটার থেকে গত ৮ ডিসেম্বর ১৫ মাস বয়সী ছেলের জন্মনিবন্ধনের আবেদন করতে পেরেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘সহজেই কাজটা হয়েছে।’

প্রায় একই কথা বলেন ডিএনসিসির ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম। গত ৩১ ডিসেম্বর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ওয়ার্ডে নিবন্ধন করাতে গিয়ে এখন ভোগান্তি অনেক কমেছে।

আরও পড়ুন