আটকের ২০ ঘণ্টা পর শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তারে অবিশ্বাস্য অভিযান

প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানকে আজ আদালত থেকে কারাগারে নেওয়া হয়ছবি: সাজিদ হোসেন

প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে সাভারের বাসা থেকে বুধবার ভোর চারটার দিকে সিআইডি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। আজ বৃহস্পতিবার সকালে আদালতে হাজির করা হয়। তার আগপর্যন্ত সিআইডি বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ তাঁকে আটক বা তুলে নেওয়ার কথা স্বীকার করেননি।

তুলে নেওয়ার ৩০ ঘণ্টা পর শামসুজ্জামানকে আদালতে হাজির করে পুলিশ প্রতিবেদন দিয়ে জানাল, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে শামসুজ্জামানকে বুধবার মধ্যরাতে ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করেছে।

আরও পড়ুন

যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান আজ সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রাথমিকভাবে প্রথম আলো ও একাত্তর টেলিভিশনের তথ্যের জন্য সিআইডি তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার পর বিভিন্ন স্থানে আরও মামলা হয়েছে, সেসব মামলায় তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এর আগে বুধবার দিনভর সরকারের একাধিক মন্ত্রী কয়েক দফায় প্রথম আলোকে বলেছিলেন, শামসুজ্জামানকে ছেড়ে দেওয়া হবে। শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দেওয়া হয়নি। এমন একটা পরিস্থিতিতে বুধবার দিবাগত রাত ১২টা ৩৬ মিনিটে শামসুজ্জামানের ফোন থেকে প্রথম আলোর একজন সহকর্মীর কাছে ফোন আসে। ফোনে শামসুজ্জামান বলেন, তাঁকে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের (বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র) সামনে সিআইডি নামিয়ে দিচ্ছে। এরপর শামসুজ্জামান বলেন, সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরেকটি দল দেখতে পাচ্ছেন। কল চালু থাকা অবস্থায় শামসুজ্জামান কাউকে বলছিলেন, ‘ভাই, আমাকে আরেকটু সামনে নামিয়ে দিয়ে আসেন না।’  

আরও পড়ুন

শামসুজ্জামানের এই কল পাওয়ার ১০ মিনিটের মাথায় প্রথম আলোর দুজন কর্মী মোটরসাইকেলে সেখানে পৌঁছান। কিন্তু সেখানে শামসুজ্জামানকে পাওয়া যায়নি। তাঁর ফোনে কল করা হলে তা ধরা হয়নি। পরে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর প্রথম আলোর কর্মীরা অনেকক্ষণ সেখানে অবস্থান করেন, আশপাশে খোঁজ করেও তাঁকে পাননি।

এই অবস্থায় রাত ১২টা ৩০ মিনিটে রমনা থানা–পুলিশ কীভাবে শামসুজ্জামানকে একই স্থান থেকে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করল, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেবল তা–ই নয়, প্রথম আলোর সম্পাদকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হচ্ছে, এমন খবর পেয়ে প্রথম আলোর দুজন প্রতিবেদকসহ একাধিক গণমাধ্যমের সংবাদকর্মী বুধবার দিবাগত রাত ১২টা ৩০ মিনিটে রমনা থানায় যান। তাঁদের থানায় প্রবেশে করতে না দেওয়ায় রাত ২টা পর্যন্ত থানার ফটকেই তাঁরা অবস্থান করেন। তাঁরাও রমনা থানায় শামসুজ্জামানকে নিয়ে আসতে দেখেননি। যদিও ওই রাতে রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলাটিতে প্রথম আলো সম্পাদকের সঙ্গে শামসুজ্জামানকেও আসামি করা হয়। ওই মামলায়ই তাঁকে পরদিন সকালে আদালতে হাজির করে ‘গ্রেপ্তার অভিযান’ চালানোর কথা বলা হয়।

আরও পড়ুন

পুলিশের এমন দাবির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে গিয়ে জানা গেল আরেক চমকপ্রদ তথ্য। শামসুজ্জামান কোথায় আছেন, তাঁকে নিয়ে কী হতে যাচ্ছে; সেটা জানার জন্য তাঁর স্বজন ও সহকর্মীরা যখন নানা জায়গায় যোগাযোগ করছিলেন, সে সময় সবার অগোচরে সিআইডি শামসুজ্জামানকে দিয়ে ফোনে তাঁর বন্ধুস্থানীয় এক ব্যক্তিকে মালিবাগ সিআইডি কার্যালয়ে ডেকে পাঠায়।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ফোনে ডেকে নেওয়া হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এক ছাত্রকে। তিনি বুধবার রাত সোয়া ১১টার দিকে ঢাকার মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে পৌঁছান। সিআইডি তাঁর জিম্মায় শামসুজ্জামানকে বুঝিয়ে দিচ্ছে মর্মে কাগজে লিখে সই নেয়। শামসুজ্জামানকে তাঁর ফোন ফেরত দেয়। এরপর দুজনকে সাভারের বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে তাঁদের সিআইডির একটি গাড়িতে তোলা হয়। গাড়িটি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের কাছে এসে থেমে যায়। সেখানে আরেকটি গাড়ি আগে থেকে অপেক্ষমাণ ছিল। সেই গাড়িতে শামসুজ্জামানকে তুলে নেওয়া হয়। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ওই ছাত্রকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতে বলা হয়।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা যায়, সিআইডির গাড়ি থেকে নামানোর পরে সেখানে আগে থেকে অপেক্ষমাণ গাড়িটি থেকে কয়েকজন নেমে আসেন। তাঁরা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বলে পরিচয় দেন। আইনি কার্যক্রমের কথা বলে শামসুজ্জামানকে তাঁদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যান।

একজন সাংবাদিককে সাভার থেকে তুলে ঢাকায় এনে ২০ ঘণ্টা আটকে রাখা, তারপর ছেড়ে দেওয়ার নামে মধ্যরাতে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া, শেষে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তারের অবিশ্বাস্য দাবির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু সিআইডি ও পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁরা সাড়া দেননি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. হারুন অর রশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

আরও পড়ুন