পাঁচ তারকা মানের একটি হোটেল বানাতে কক্সবাজারের টেকনাফের ‘সাবরাং পর্যটন অঞ্চলে’ ১০ একর জমি বরাদ্দ পেয়েছে বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি। দুই বছর আগে বরাদ্দ পেলেও এখনো জমির নির্ধারিত লিজ-মূল্য পরিশোধ করেনি প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের কল্যাণে গঠিত সংগঠনটি। টাকা পরিশোধের লক্ষ্যে সমিতি তার সদস্যদের প্রকল্পের শেয়ার কিনতে বারবার তাগিদ দিলেও তাতে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। এ অবস্থায় প্রকল্প বাস্তবায়নে ৩১ আগস্টের মধ্যে শেয়ার কিনতে প্রশাসন ক্যাডারের সব কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়েছেন সমিতির সভাপতি।
কক্সবাজার থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং নামক এলাকায় ১ হাজার ৪১ একর জমিতে গড়ে উঠছে বিশেষ পর্যটন অঞ্চলটি। থাইল্যান্ডের পাতায়ার আদলে এলাকাটিকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন অঞ্চলে রূপ দেওয়ার কথা জানিয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)।
এলাকাটিতে পাঁচ তারকা মানের একটি হোটেল বানাতে ২০২০ সালের ৩১ মে ১০ একর জমি বরাদ্দ পায় বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি। ৫০ বছরের জন্য জমির লিজ-মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১৮ লাখ ৭১ হাজার ৬৭২ ডলার।
নির্ধারিত লিজ-মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় এখনো জমি বুঝে পায়নি সমিতি। লিজ-মূল্য পরিশোধ করতে পাঁচবার সময় বাড়িয়েছে বেজা। চলতি আগস্টের পর আর সময় বাড়ানো হবে না বলে বেজা সাফ জানিয়ে দিয়েছে।
বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে জমির লিজ-মূল্য পরিশোধ করতে না পারলে পাঁচ তারকা হোটেল বানানোর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন অসম্ভব হবে বলে আশঙ্কা করছে সমিতি। গত ৭ জুলাই প্রশাসন ক্যাডারের সব কর্মকর্তার কাছে পাঠানো চিঠিতে এই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন সমিতির সভাপতি মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব।
চিঠিতে বলা হয়েছে, সাবরাং পর্যটন অঞ্চলটি পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় হিসেবে বিবেচিত। দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে এখানে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে স্থাপনা নির্মিত হচ্ছে।
সাবরাংকে পর্যটনের আকর্ষণীয় স্থান উল্লেখ করে প্রকল্পের শেয়ার কিনতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয় সমিতির চিঠিতে।
সূত্র জানায়, সাবরাংয়ে আন্তর্জাতিক মানের হোটেল বানানোর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চার হাজার শেয়ার বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সমিতি। প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ৫০ হাজার টাকা ধরে প্রথমে সমিতির সদস্যদের চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু আটবার চিঠি দিয়েও সমিতির সদস্যদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সাড়া মেলেনি। এখন পর্যন্ত মাত্র ২২১ জন সদস্য ৮৮১টি শেয়ার কিনেছেন, যার মূল্য প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা। যা জমির লিজ-মূল্যের চেয়ে অনেক কম।
এমন প্রেক্ষাপটে শেয়ার কিনতে এবার প্রশাসন ক্যাডারের সব কর্মকর্তার কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন সমিতির সভাপতি। চিঠিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে ৩১ আগস্টের মধ্যে সর্বনিম্ন ৩টি ও সর্বোচ্চ ২০টি শেয়ার কিনতে বলা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, সাবরাং পর্যটন অঞ্চল প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তির জন্য বিভিন্ন সময় সমিতির সদস্যদের অবহিত করা হলেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় শেয়ার বিক্রি হয়নি। শেয়ার কেনার সময়সীমা ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে শেয়ার না কিনলে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।
শেয়ার কিনতে অনাগ্রহ সত্ত্বেও বারবার চিঠি দেওয়াকে ‘অস্বস্তিকর’ বলছেন সমিতির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সদস্য।
শেয়ার কিনতে কেন অনাগ্রহ
সাবরাং পর্যটন অঞ্চলে বিনিয়োগে কেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা অনাগ্রহী, সে বিষয়ে কথা হয় অন্তত ১০ জন কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁরা বলেন, সমিতির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত যতগুলো আবাসন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তার একটিও সফলতার মুখ দেখেনি। রাজধানীর পূর্বাচলে ৩০০ ফুট রাস্তাসংলগ্ন এলাকায় সমিতির আবাসন প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১১ সালে। সেখানে সমিতির অনেক সদস্য বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু নানা জটিলতায় এখনো প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি, ফলে বিনিয়োগ করা টাকা ঝুলে আছে।
সমিতির আবাসন প্রকল্পটি সম্পর্কে সাবেক একাধিক সচিব প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ইতিমধ্যে অবসরে চলে গেছেন। কিন্তু কবে নাগাদ প্লট বুঝে পাবেন, তা তাঁরা জানেন না।
সূত্র জানায়, রাজউকের উত্তরা আবাসিক প্রকল্পে (তৃতীয় পর্যায়) একটি আন্তর্জাতিক মানের কনভেনশন সেন্টার বানানোর উদ্যোগ নিয়েছিল সমিতি। সেটিও বেশি দূর এগোয়নি। রাজধানীর খিলক্ষেতে সমিতির আরেকটি আবাসন প্রকল্পের অগ্রগতিও আশানুরূপ নয়। আবার গাজীপুর ও মগবাজারে সমিতির আলাদা দুটি আবাসন প্রকল্প এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৭ সালে। রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে অবস্থিত বিয়াম ফাউন্ডেশন ভবনে সমিতির কার্যালয়। সমিতির সদস্য তিন হাজারের বেশি, তবে প্রশাসন ক্যাডারে কর্মকর্তার সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। অর্থাৎ প্রশাসন ক্যাডারের প্রায় দুই হাজার কর্মকর্তা সমিতির সদস্য নন। এখন সমিতি অনেকটা নিরুপায় হয়ে সদস্য নন—প্রশাসন ক্যাডারের এমন কর্মকর্তাদেরও সাবরাং প্রকল্পের শেয়ার কিনতে বলছে।
সমিতি প্রতিষ্ঠার পর থেকে একটি প্রকল্পও আলোর মুখ না দেখায় সদস্যরা নতুন কোনো প্রকল্পে শেয়ার কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন না বলে জানা গেছে।
প্রশাসন ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তা ও সমিতির সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সাবরাং পর্যটন অঞ্চলে এখনো জমি ভরাটের কাজ চলছে। জমি ভরাটের জন্য মাটি পাওয়া যাচ্ছে না, আছে পানির সংকট। সেখানে কবে নাগাদ অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হবে, তা অজানা। এখানে শেয়ার না কিনে সঞ্চয়পত্র বা অন্য কোথাও জমি কিনলে সেটি তাঁদের জন্য বেশি লাভজনক হবে। তা ছাড়া আগে যেসব আবাসন প্রকল্পে তাঁরা বিনিয়োগ করেছেন, সেখানে অনেক সদস্যের টাকা পড়ে আছে। সেই টাকা অন্যত্র বিনিয়োগ করলে বেশি লাভবান হওয়ার সুযোগ ছিল। এ জন্য তাঁরা নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে চাইছেন না।
এসব বিষয়ে কথা বলতে সমিতির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার মুঠোফোনে কয়েকবার কল করা হয়, কিন্তু তিনি সাড়া দেননি। মুঠোফোনে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠালেও তার জবাব মেলেনি।
সমিতির সদস্য, অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব মেজবাহ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি সমিতির সভাপতির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
জানতে চাইলে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সাবেক জনপ্রশাসনসচিব শেখ ইউসুফ হারুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেজার পক্ষ থেকে আমরা সমিতিকে জমির লিজ-মূল্য পরিশোধের একটা সময়সীমা বেঁধে দিয়েছি। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে টাকা পরিশোধ করতে না পারলে আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।’
কেন কর্মকর্তারা শেয়ার কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন না, জানতে চাইলে শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘সমিতির পক্ষ থেকে আগে যতগুলো আবাসন প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, তার একটিও সফল হয়নি। ফলে সমিতি কর্মকর্তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। দু-একটি প্রকল্প যদি সফল করে তোলা যায়, তাহলে সদস্যরা হয়তো শেয়ার কিনতে আগ্রহী হবেন।’
শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, এখন সমিতির উচিত হবে, কর্মকর্তাদের বোঝানো যে সাবরাং প্রকল্পটি লাভজনক হবে। এটি পর্যটনের জন্য আকর্ষণীয়। তাহলে তাঁরা শেয়ার কিনতে আগ্রহী হতে পারেন। এ ছাড়া অতীতে নেওয়া দু-একটি প্রকল্প উদ্বোধন করা যেতে পারে।