অবৈধভাবে আসছে বিদেশি প্রাণী, ফেসবুকে গোপন কেনাবেচা, হুমকির মুখে বাস্তুতন্ত্র
শখ করে অনেকেই বিদেশি নানা প্রজাতির সরীসৃপ পুষছেন। এতে দেশে এসব প্রাণীর চাহিদা বাড়ছে। এই সুযোগে অবৈধভাবে এসব প্রাণী দেশে আনছে নানা চক্র। এগুলোর বেচাকেনায় ফেসবুকভিত্তিক বাজার বড় হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো নীতিমালা ও তদারকি ছাড়া দেশে আসা এসব প্রাণী দেশীয় বাস্তুতন্ত্র ও প্রতিবেশের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিদেশি প্রাণী কেনাবেচার প্রধান মাধ্যম ফেসবুক। সামাজিক এই যোগাযোগমাধ্যমে পেজ খুলে চলছে বেচাকেনা। এমন বেশ কয়েকটি ফেসবুক পেজ খুঁজে পেয়েছে প্রথম আলো।
এসব পেজে নানা জাতের বিছা (স্করপিয়ন), টিকটিকি (লিজার্ড), পাইথন (অজগর) ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। ফরমাশ দিলে বাড়িতে পৌঁছে (হোম ডেলিভারি) দিচ্ছেন কেউ কেউ। সঙ্গে থাকছে এগুলো লালনপালন করার গাইডলাইন বা নির্দেশিকা।
বিদেশি প্রাণী কেনাবেচার কয়েকটি ফেসবুক পেজ হলো এক্সোটিক অ্যানিমেল অব বাংলাদেশ, এক্সোটিক পেট সোসাইটি অব বাংলাদেশ, এক্সোটিক পেট বিডি, এক্সোটিক পেট এম্পায়ার অব বাংলাদেশ, এক্সোটিক অ্যানিমেল ফেয়ার অব বিডি।
প্রাণীগুলো যেহেতু অবৈধভাবে দেশে আনা হয়। তাই অনেকটা গোপনীয়তা রক্ষা করে এগুলোর কেনাবেচা হয়ে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ফিরোজ জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব বিদেশি প্রজাতি আমাদের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করতে পারে। যদিও ক্যাপটিভ (বন্দী) অবস্থায় এদের পালন করা হয়, কিন্তু অসতর্কতাবশত এগুলো প্রকৃতিতে সাকার মাছের মতো অবমুক্ত হয়ে যেতে পারে।’
বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সঠিক জায়গায় নজরদারি বাড়াতে হবে। এগুলো কোনোভাবে প্রকৃতিতে অবমুক্ত হয়ে গেলে সেটার ক্ষতি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব না।অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এসব প্রজাতির প্রাণীর রোগব্যাধি থাকতে পারে উল্লেখ করে অধ্যাপক জামান আরও বলেন, এসব প্রাণীর তো কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) করা হয় না। এর ফলে এদের মধ্যে থাকা যেকোনো রোগব্যাধি এখানকার অন্য প্রাণী ও মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ ছাড়া এখানকার খাদ্যশৃঙ্খলে একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে এরা। কারণ, বিদেশি স্পেসিসের অ্যাডাপ্টেবিলিটি (অভিযোজনের ক্ষমতা) বেশি থাকে।
কোন প্রাণীর কেমন দর
বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী দেশে কেনাবেচা হচ্ছে দুই হাজার থেকে দুই লাখ টাকায়। গত ২৬ এপ্রিল ক্রেতা সেজে অস্ট্রেলিয়া ও নিউগিনির নিশাচর প্রাণী সুগার গ্লাইডার কেনার জন্য এ প্রতিবেদক কথা বলেন এক্সোটিক ফার্ম বিডির স্বত্বাধিকারী আবদুল্লাহ আল কায়েসের সঙ্গে। গাজীপুর থেকে ফার্মটি পরিচালনা করেন তিনি। একটি সুগার গ্লাইডারের দাম চাইলেন ৩০ হাজার টাকা।
গাজীপুর সদরে অবস্থিত তাঁর ফার্ম থেকে দেশের যেকোনো জায়গায় প্রাণী পাঠানো হয় বলে জানান কায়েস। তিনি বলেন, পণ্য বুঝে পাওয়ার পর টাকা পরিশোধের (ক্যাশ অন ডেলিভারি) ব্যবস্থা আছে। তাঁরা এসব প্রাণী পোষার জন্য গাইডলাইনও সরবরাহ করেন। কীভাবে এসব প্রাণী সংগ্রহ করেন, সে প্রশ্ন এড়িয়ে যান এই বিক্রেতা।
এদিকে এশিয়ান ফরেস্ট স্করপিয়নের জন্য ১ হাজার ৮০০ টাকা দাম চাইলেন রাজধানীর লালমাটিয়ার ফারদিন নামের এক বিক্রেতা। তিনি জানান, সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয় বল পাইথন। বাহারি রঙের এসব অজগর বিক্রি হচ্ছে দেড় থেকে দুই লাখ টাকায়।
২৫ থেকে ২৮ এপ্রিল বিদেশি প্রাণী বিক্রির ফেসবুক পেজগুলোয় ঢুঁ মেরে দেখা গেছে, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ক্যামেলিয়ন ড্রাগন, লেপার্ড গেকো, সিরিয়া ও তুরস্কের সিরিয়ান হ্যামস্টার, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া কোয়েল, অস্ট্রেলিয়ার সুগার গ্লাইডার, ইন্দোনেশিয়ার ভ্যাম্পায়ার ক্র্যাব, তানজানিয়ার সালফার ব্লু হেড লিজার্ড, দক্ষিণ এশিয়ার এশিয়ান স্করপিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার পেইন্টেড টার্টেল, থাইল্যান্ডের এলিফ্যান্ট এয়ার হাফমুন বেটা, সাব-সাহারা অঞ্চলের সাভান মনিটর লিজার্ড, পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার বল পাইথন বিক্রির জন্য নানা ধরনের পোস্ট দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের কর্ন স্নেক, অস্ট্রিলিয়ার বিয়ার্ডেড ড্রাগন, এশিয়ান ডুয়ার্ফ মাডস্কিপার, আফ্রিকার টারানটুলা, ম্যাক্সিকান ফায়ার লেগ, এশিয়ান ফরেস্ট স্করপিয়ন, দক্ষিণ এশিয়ার মাইক্রো স্কুইরিল, অস্ট্রেলিয়ার লুসিস্টিক সুগার গ্লাইডার, ভেনেজুয়েলার মাতামাতা অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে।
বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের প্রধান বন সংরক্ষক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কোনো এক্সোটিক স্পেসিস (বিদেশি প্রজাতির প্রাণী) আমদানির ক্ষেত্রে বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। সাইটিস–ভুক্ত প্রাণী হলে সেটা আমদানি করা যায় না।
উল্লেখ্য, সাইটিস বা কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেঞ্জারড স্পেসিস অব ওয়াইল্ড ফাউনা অ্যান্ড ফ্লোরা হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। যাতে করে বুনো পরিবেশে এগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে না পড়ে। বাংলাদেশ এই চুক্তিতে সই করেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ সাইটিসের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সদস্য।
অবৈধ বন্য প্রাণীর বাণিজ্য রোধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০২৪ সালে বাংলাদেশ সাইটিসের নিষেধাজ্ঞায় পড়ে, যা এখনো বলবৎ আছে।
মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিদেশি প্রজাতির প্রাণী দেশে আনার খবর পেলে আমরা বিমানবন্দরে অভিযান চালিয়ে সেগুলো জব্দ করি। অনেক সময় অন্য নামে সেগুলো দেশে আনা হয়। সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য বিমানবন্দরে বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট স্থাপনের জন্য বন অধিদপ্তরে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
কোন পথে ঢুকছে বিদেশি প্রাণী
বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের মধ্যম সারির দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জাহাজের নাবিকদের হাত ধরে ও বিমানবন্দর দিয়ে মূলত এসব বিদেশি প্রজাতির প্রাণী দেশে ঢোকে। বিমানবন্দরে তদারকির জন্য সার্বক্ষণিক কোনো টিম নেই বন অধিদপ্তরের। কেবল গোপন সূত্রে খবর পেলেই অভিযান পরিচালনা করা হয়।
ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, বিমানবন্দরে মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে এসব প্রাণী জব্দ করা হলেও সমুদ্রবন্দরগুলোতে কোনো তদারকির ব্যবস্থা নেই, অভিযান চালানো হয় না। অনেক নাবিক এসব প্রাণীর ডিম নিয়ে এসে বাচ্চা ফুটিয়ে বিক্রি করেন। অ্যাকুয়ারিয়ামের মাছের সঙ্গেও নানা জাতের সরীসৃপ, সাপ নিয়ে আসা হয়।
জানতে চাইলে বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের প্রধান বন সংরক্ষক ছানাউল্লাহ পাটওয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শুধু পাখি আমদানির অনুমতি (এনওসি) দিই। কোনো সরীসৃপ (রেপটাইলস) আমদানির জন্য আমরা অনুমতি দিই না।’ তাহলে এসব প্রাণী কীভাবে দেশে ঢুকছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে তাঁর কাছে কোনো তথ্য নেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমত এসব ইনভেসিভ (ক্ষতিকর) প্রজাতি দেশে ঢোকা বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে সঠিক জায়গায় নজরদারি বাড়াতে হবে। এগুলো কোনোভাবে প্রকৃতিতে অবমুক্ত হয়ে গেলে সেটার ক্ষতি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব না।’