কষ্ট আর ব্যথা ভুলে আজ ওরা মাতল আঁকাআঁকিতে

চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পুরস্কার হাতে বিজয়ী তিন শিশু মাহিদুল (মাঝে), আওয়াল (ডানে) ও সাইফুল। বৃহস্পতিবার, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) মিলনায়তনেছবি: প্রথম আলো

দারুণ ছবি আঁকে মাহিদুল ইসলাম। মাস ছয়েক আগেও নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে পছন্দ করত সে। তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত মাহিদুল। পড়া আর খেলা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটত শিশুটির। তবে প্রায়ই জ্বরে আক্রান্ত হতো সে। সেরে উঠছিল না পুরোপুরি।

সন্তানের অসুস্থতায় মা-বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। জ্বরে আক্রান্ত মাহিদুলকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে ছুটে যান তাঁরা। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মাহিদুলের শরীরে রক্তের ক্যানসার শনাক্ত হয়। মা-বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।

এরপর সবকিছু বদলে গেছে। এখন আর বিদ্যালয়ে যেতে পারে না প্রাণোচ্ছল শিশুটি। কর্কট রোগের সঙ্গে লড়াই এখন মাহিদুলের নিত্যসঙ্গী।

আরও পড়ুন

মায়ের হাত ধরে আজ বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) মিলনায়তনে এসেছিল মাহিদুল। তবে চিকিৎসক দেখাতে নয়, ১৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক শিশু ক্যানসার দিবসের এক আয়োজনে মাহিদুলের চমেকে এসেছে।

দিবসটি উপলক্ষে শিশুদের জন্য চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্রতিযোগিতায় ছোট্ট মাহিদুল প্রকৃতির ছবি এঁকেছে, প্রথম হয়েছে।

মাহিদুলের মতো শ খানেক শিশু জড়ো হয়েছিল চমেক মিলনায়তনে। এসব শিশুর সবাই চমেক হাসপাতালের শিশু বিভাগে ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়েছে, নিচ্ছে। কেউ মায়ের, কেউবা বাবার হাত ধরে অনুষ্ঠানে এসেছে। শিশুরা কষ্ট আর ব্যথা ভুলে মেতেছিল আঁকাআঁকিতে। কেউ এঁকেছে ভূত, কেউ মানুষ, আবার কেউ এঁকেছে প্রকৃতি।

আরও পড়ুন
মা মাছুমা বেগমের সঙ্গে মাহিদুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

চমেকের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম রেজাউল করিম বলেন, প্রতিবার এই দিবসে ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুদের কিছুটা আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এবারও শতাধিক শিশু অনুষ্ঠানে এসেছে। ছবি এঁকেছে। হাসি আর আনন্দে মেতেছে।

মায়ের সঙ্গে এসেছে জিহাদ হোসেন। ওর বয়স আট বছর। দুই ভাইয়ের মধ্যে জিহাদ বড়। জিহাদের মা জানালেন, মাস ছয়েক আগে শিশুটির কিডনিতে টিউমার ধরা পড়ে। অস্ত্রোপচার হয়েছে। এখন অনেকটা সুস্থ সে।

চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকে জিহাদের পরিবার। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে। বাবা পেশায় দিনমজুর।  জিহাদের মা জানালেন, টানাটানির সংসার। এর মধ্যে জিহাদের চিকিৎসা করাতে সংকটে পড়েছে পুরো পরিবারটি। অসুস্থ হওয়ার আগে জিহাদ প্রথম শ্রেণিতে পড়ত। এখন অর্থাভাবে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে।

শিশু ক্যানসার দিবসের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় জিহাদ নৌকার ছবি এঁকেছে। আবার পড়াশোনা করতে চায় সে।

চকরিয়া থেকে মায়ের সঙ্গে এসেছে ছয় বছরের আওয়াল। রক্তের ক্যানসারের চিকিৎসা চলছে শিশুটির। প্রতিযোগিতায় কার্টুনের ছবি একে দ্বিতীয় হয়েছে আওয়াল। পুরস্কার পেয়ে দারুণ খুশি সে।

৯ বছরের সাইফুল ইসলাম তৃতীয় হয়েছে। সাগরতলের নানা প্রাণীর ছবি এঁকেছে সে। পেকুয়ার ছেলে সাইফুল বছরখানেক ধরে রক্তের ক্যানসারে ভুগছে। তার আগে প্রাথমিকে পড়ত সে। এখন পড়াশোনা বন্ধ।

ক্যানসারে আক্রান্ত এসব শিশুর প্রাণোচ্ছল মুখ দেখে খুশি চিকিৎসকেরা, খুশি অভিভাবকেরাও। কথা হলো মাহিদুলের মা মাছুমা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, দুই ছেলে আর এক মেয়ে তাঁর। মাহিদুল মেজ। একসময় তাঁরা কুমিল্লার লালমাই এলাকায় থাকতেন। ছেলে অসুস্থ হওয়ার পর চট্টগ্রামে চলে এসেছেন। বাসা ভাড়া করে আছেন।

আরও পড়ুন

মাছুমা বললেন, মাহিদুলের বাবা একজন এনজিওকর্মী। মধ্যবিত্ত পরিবার, টানাটানি করেই চলতে হয়।  ছেলেকে সুস্থ করে তাঁরা কবে আবার বাড়ি ফিরতে পারবেন এই আশায় আছেন মাছুমা। ঠিক মাহিদুলের আঁকা ছবির মতো। মাহিদুলের ক্যানভাসে ভেসে উঠেছে, নীল আকাশের কোণে এক টুকরা মেঘ। গাছপালা আর সবুজ মাঠ পেরিয়ে দূরে দুটি কুঁড়েঘর। বেলাশেষে মাথায় বোঝা নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটছেন একজন।

সেই আশায় দিন গুনছেন মাছুমা।

আরও পড়ুন