আমদানিনিষিদ্ধ, তবু ই-সিগারেটের চটকদার বিজ্ঞাপন আর বাধাহীন বিক্রি অনলাইনে
পণ্য কতটা সহজলভ্য আর গন্ধ কেমন—সেসবের দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে। আরও রয়েছে তরুণদের আকর্ষণের নানান চেষ্টা। অবৈজ্ঞানিক তথ্যে গুণাবলি তুলে ধরার চেষ্টাও করা হয়েছে। ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে বিজ্ঞাপন ও বিপণনের যত কায়দা আছে, সবই করা হচ্ছে। বলছি, ই-সিগারেট বা ভেপ বিক্রির কথা।
অনলাইন মার্কেট প্লেস বা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইটে আমদানিনিষিদ্ধ এ পণ্য দেদারে বিক্রি হচ্ছে। যে পণ্যের আমদানিনিষিদ্ধ, সেটা কীভাবে বিক্রি হয়, তা নিয়ে বিস্মিত ধূমপানবিরোধী অধিকারকর্মী, চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা। বিক্রি বন্ধে সরকারি কোনো তৎপরতাও চোখে পড়ে না।
এ পরিস্থিতিতে আজ শনিবার পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস’। চলতি বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ‘ঝকমকে পণ্য, মন্দ উদ্দেশ্য’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশু তামাক ব্যবহার করে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বেশ কিছু এলাকায় কিশোরদের মধ্যে ধূমপানের হার ৪৩, আর কিশোরীদের মধ্যে তা ২০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে।
বাংলাদেশেও, বিশেষ করে তরুণ বয়সীদের মধ্যে ই-সিগারেটের ভোক্তা অনেক। এর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বেশি থাকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পণ্যটি আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারির অনুরোধ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ই-সিগারেট বা ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (ইএনডিএস)–সংশ্লিষ্ট সব পণ্য আমদানিনিষিদ্ধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
‘আমদানি নীতি আদেশ, ২০২১-২৪’ সংশোধন করে আমদানিনিষিদ্ধ পণ্য তালিকায় ই-সিগারেট অন্তর্ভুক্ত করে গত ৩১ ডিসেম্বর আদেশ জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আর ১ জানুয়ারি সেটা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এরপরও আমদানিনির্ভর পণ্যটির বিক্রি বন্ধ হয়নি, বরং ‘নানা গুণ’ বর্ণনা করে অনলাইনে প্রচার চলছে।
ই-সিগারেটের আমদানিনিষিদ্ধ, কিন্তু বিক্রি তো নিষিদ্ধ নয়। কেউ যদি আমদানিনিষিদ্ধ করার আগেই আমদানি করে থাকে, সেটা বিক্রি করতে বাধা কোথায়?
যা বলছেন বিক্রেতারা
অনলাইন মার্কেট প্রতিষ্ঠান দারাজ ডটকমে ই-সিগারেটের প্রচার দেখা গেছে। বলা হয়েছে, ‘ই–সিগারেট বা ভেপের ব্যবহার বর্তমান সময়ের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন ফ্লেভারের ই-সিগারেট কম ক্ষতিকর হওয়ায় অনেকেই এখন সিগারেটের বদলে ইলেকট্রনিক সিগারেটের দিকে ঝুঁকছেন...দারাজের ভেপ বা ই-সিগারেট কালেকশন নিয়ে এল সাশ্রয়ী দামে ঘরে বসে ভেপ কেনার ব্যবস্থা। এখানে আপনি পাবেন সেরা দামে, সেরা ব্র্যান্ডের ই-সিগারেট ও ভেপ জুস কেনার সুযোগ।’
এ ছাড়া বিডি স্টল, আজকের ডিল ডটকম ও ফুডপান্ডার মতো প্রতিষ্ঠানের সাইটেও ই-সিগারেটের নির্বিঘ্ন প্রচার দেখা গেছে।
এমন প্রচার ও বিক্রি আইনের লঙ্ঘন কি না, এর জবাবে দারাজ বাংলাদেশের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স কর্মকর্তা এ এইচ এম হাসিনুল কুদ্দুস প্রথম আলোকে বলেন, ‘ই-সিগারেটের আমদানিনিষিদ্ধ, কিন্তু বিক্রি তো নিষিদ্ধ নয়। কেউ যদি আমদানিনিষিদ্ধ করার আগেই আমদানি করে থাকে, সেটা বিক্রি করতে বাধা কোথায়? অন্য প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ই-সিগারেটের বিক্রি করছে। সে ক্ষেত্রে আমরা এ পণ্য বিক্রিতে বাধা দিতে পারি না।’
কোনো পণ্য আমদানিনিষিদ্ধ হলে সেটা বিক্রি করা অপরাধ। বিজ্ঞাপন দেওয়াটাও অপরাধের আওতায় পড়ে। ই-সিগারেট শতভাগ আমদানিনির্ভর পণ্য। কোনো দেশি প্রতিষ্ঠান এটি তৈরি করে না। এটা বিক্রির কোনো সুযোগ নেই।
ফুডপান্ডা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা দেশের প্রচলিত আইন ও বিধিমালা অনুসরণ করে ব্যবসা করে। সরকারের নিষিদ্ধ করা কোনো পণ্য বিক্রি করে না। এ ছাড়া ফুডপান্ডা কোনো ধরনের সিগারেট বা ই-সিগারেট আমদানি করে না।
আজকের ডিল ডটনেটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজকের ডিলে এখন তো কোনো কেনাবেচা নেই। কাজেই সাইট আপডেট করা হয় না।’
এমন বক্তব্যের পর আজকের ডিলে ই-সিগারেট বিক্রির ছবি (স্ক্রিনশট) দেখানো হলে ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘আমি চেক করছি। আমাদের সাইট থেকে এখন ফেসবুকের মতো ফ্রি লিস্টিং। আমাদের কোনো আর্থিক ভূমিকা নেই। এগুলো থেকে থাকলে ডিলিট করার ব্যবস্থা করছি।’
মানতে নারাজ বিশেষজ্ঞরা
কাস্টমস আইন ২০২৩ অনুযায়ী, সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমদানিনিষিদ্ধ করা হলে সেই পণ্য আমদানির কোনো সুযোগ নেই। এটা করলে তা অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হবে।
কাজেই আমদানিনিষিদ্ধ হলেও পণ্যের বিক্রি নিষিদ্ধ নয়, এ বক্তব্যকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ বলে মন্তব্য করেন আইনজীবী ও ধূমপানবিরোধী অধিকারকর্মী সৈয়দ মাহবুবুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো পণ্য আমদানিনিষিদ্ধ হলে, সেটা বিক্রি করা অপরাধ। বিজ্ঞাপন দেওয়াটাও অপরাধের আওতায় পড়ে। ই-সিগারেট শতভাগ আমদানিনির্ভর পণ্য। কোনো দেশি প্রতিষ্ঠান এটি তৈরি করে না। এটা বিক্রির কোনো সুযোগ নেই।’
দারাজসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ই-সিগারেটের বিক্রির প্রচারে একে ‘কম ক্ষতিকর’ বলে যে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে, সেটাও ভুল। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা এফডিএ বলছে, ই-সিগারেট বা ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (ইএনডিএস) কখনো নিরাপদ নয়।
মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা মানসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, ‘ই-সিগারেট কম ক্ষতিকর বলে যে প্রচারণা আছে, সেটা নির্জলা মিথ্যা। পণ্য বিক্রির জন্য এসব কথা বলেন বিজ্ঞাপনদাতা ও উৎপাদনকারীরা। অপরাধ এটা। ই-সিগারেটে থাকা অন্তত ৭০টি উপাদান ক্যানসার সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।’
ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন ধরনের নিকোটিনজাত পণ্য, যেমন ই-সিগারেট ও গরম তামাক পণ্যের প্রচার বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। এসব পণ্য প্রায়ই রঙিন ডিজাইন ও নানা স্বাদে বাজারজাত করা হয়, যা বিশেষ করে নারীদের ও তরুণদের আকৃষ্ট করে। এ কারণে আসক্তির হার বেড়ে যায়।