‘বালুখেকো’ সেলিমের কাছ থেকে ইলিশের ক্ষতির টাকাও আদায় করতে হবে

চাঁদপুরের ডিসিকে চিঠি দিয়ে নদী কমিশন বলেছে, সেলিম খানের কারণে ইলিশের প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্রও নষ্ট হয়েছে।

সেলিম খান

চাঁদপুরে অবৈধ উপায়ে নদী থেকে বালু উত্তোলনের মাধ্যমে ইলিশের বিচরণক্ষেত্র নষ্ট ও জলজ উদ্ভিদ বিপন্ন করায় বিতর্কিত সেলিম খানের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে বলেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।

‘বালুখেকো’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম খান পদ্মা ও মেঘনা থেকে দীর্ঘদিন বেপরোয়াভাবে বালু তুলে বিক্রি করেছেন। এর বিপরীতে (র‌য়্যালটি বাবদ) ২৬৭ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে চাঁদপুর জেলা প্রশাসন গত ৪ সেপ্টেম্বর সেলিম খানকে চিঠি দেয়। তবে এক মাস পার হলেও তিনি কোনো টাকা দেননি। চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) কামরুল হাসান গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, সেলিম খানকে আরও ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে টাকা না দিলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

তবে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন মনে করে, কেবল র‌য়্যালটি নেওয়াটা যথেষ্ট নয়। কারণ, বালু উত্তোলনের কারণে ইলিশের বিচরণক্ষেত্রসহ সেখানকার জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়েছে।

এ বিষয়ে ১ অক্টোবর চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো চিঠিতে নদী রক্ষা কমিশন বলেছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সেলিম খানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সেলিম এন্টারপ্রাইজ নদী থেকে ৬৬৮ কোটি ৩৩ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করে। এর বাজার মূল্যের রয়্যালটি আদায়ের পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে।

চিঠিতে নদী রক্ষা কমিশন বলেছে, ওই এলাকা ইলিশের অভয়াশ্রম। তা ছাড়া এলাকাটি ভাঙনপ্রবণ। সেখানে বালুমহাল ঘোষণা করে বালু তোলা হলে ইলিশের অভয়াশ্রম নষ্ট হবে। নদীর পাড় ও শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙে যাওয়াসহ নদীর জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকিতে পড়বে।

এ বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সেলিম খান ড্রেজার দিয়ে বালু তোলার কারণে ইলিশের বিচরণক্ষেত্রের পাশাপাশি ইলিশের অভয়াশ্রমও নষ্ট হচ্ছে। ফলে চাঁদপুর অংশে ইলিশের প্রজননে প্রভাব পড়ছে। ইলিশের বাস্তুতন্ত্রও নষ্ট হবে। এ কারণে সেলিম খান যতটুকু বালু উত্তোলন করেছেন, তার বর্তমান বাজারমূল্য ঠিক করে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে বলা হয়েছে।

এদিকে চাঁদপুরে বালুমহাল নিয়ে বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না। জেলা সদরে বহরিয়া মৌজায় বালুমহাল ঘোষণা করাকে কেন্দ্র করে নতুন বিতর্ক দেখা দিয়েছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর বহরিয়া এলাকায় ৪১৫ একর জায়গাকে বালুমহাল ঘোষণা করেন চাঁদপুর জেলা প্রশাসক। জেলা প্রশাসককে ১ অক্টোবর পৃথক চিঠি দিয়ে বালুমহাল ঘোষণার এই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বলেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।

সেলিম খান একসময় জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। জোট সরকারের আমলে তিনি বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য (চাঁদপুর-৩) ও বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে এলাকায় পরিচিতি পান।

চিঠিতে নদী রক্ষা কমিশন বলেছে, ওই এলাকা ইলিশের অভয়াশ্রম। তা ছাড়া এলাকাটি ভাঙনপ্রবণ। সেখানে বালুমহাল ঘোষণা করে বালু তোলা হলে ইলিশের অভয়াশ্রম নষ্ট হবে। নদীর পাড় ও শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙে যাওয়াসহ নদীর জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকিতে পড়বে।

নদী রক্ষা কমিশনের আপত্তির চিঠি পাওয়ার কথা জানিয়ে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি সব সংস্থার মতামত নিয়ে বালুমহাল ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি চাইলে আপত্তি জানাতে পারবেন। এর মধ্যে স্থানীয় নয়জন বাসিন্দাও আপত্তি জানিয়েছেন। বিষয়টি ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ভূমি মন্ত্রণালয়।

এদিকে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, নতুন করে বালুমহাল ঘোষণা করায় সেখানেও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী সেলিম খানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পেতে পারে বলে এলাকায় আলোচনা আছে।

সেলিম খান একসময় জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। জোট সরকারের আমলে তিনি বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য (চাঁদপুর-৩) ও বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে এলাকায় পরিচিতি পান। এর পর থেকে এলাকায় বালু তোলার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন সেলিম খান। তিনি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে। অভিযোগ উঠেছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তাব করা জায়গার বড় অংশ নামে-বেনামে কিনে নেন তিনি।

আরও পড়ুন

এসব জমির দলিল করতে গিয়ে মৌজা দরের চেয়ে ২০ গুণ বেশি মূল্য দেখানো হয়। সরকারের কাছ থেকে কৌশলে বিপুল টাকা নিতে এমন কারসাজি করা হয়। এ নিয়েও গত বছরের ২৭ জানুয়ারি ‘মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠদের দুর্নীতির জাল’ শিরোনামে প্রথম আলোতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।