৩৩ বছর কাটল, কথা রাখছেন না জাকসুর কেউ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচনে ভোট গণনা চলছে। আজ শনিবার সকালে, সিনেট হলেছবি: প্রথম আলো

‘কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি’—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার এই পঙ্‌ক্তি জীবনের নানা সময়ে মনে পড়ে যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) আর হল সংসদ নির্বাচনে ভোট গণনার দীর্ঘসূত্রতা দেখে আর এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের একেক সময় একেক রকম প্রতিশ্রুতি শুনে আজ এই কবিতা বারবার মনে পড়ছে।

জাকসু ও হল সংসদে ভোটও হচ্ছে ৩৩ বছর পর। জাকসুতে ১৯৯২ সালের পরের নির্বাচন বাতিল হয়েছিল একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায়। তখনকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে কয়েকটি গ্রুপ ছিল। ১৯৯৩ সালের ২৯ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের জন্য নির্ধারিত শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন চলছিল। ওই নির্বাচন বানচালের জন্য শিক্ষকদের একটি গ্রুপ জাকসুর প্রতিনিধি ও ছাত্রদের দিয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায়। ওই হামলায় কয়েকজন শিক্ষক আহত হন। পরে সভাপতি (উপাচার্য) জাকসু ভেঙে দেন।

এরপর ৩৩ বছর কেটে গেছে। ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার জাকসুতে ভোট গ্রহণ হয়। ওই দিন রাত সোয়া ১০টা থেকে চলছে গণনা। সেই সঙ্গে চলছে ফলাফলের জন্য অনন্ত অপেক্ষা।

কে কী কথা দিয়েছিলেন

অব্যবস্থাপনা, অভিযোগ আর বর্জনে জাকসুর এবারের নির্বাচন নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়। তবে আলোচনা আরও প্রকট হয় ভোট গণনায় দীর্ঘসূত্রতায়। বৃহস্পতিবার ভোট গ্রহণ হলেও শুক্রবার পেরিয়ে আজ শনিবার দুপুর পর্যন্ত কয়েক হাজার ভোট গুনে শেষ করতে পারেনি জাকসুর নির্বাচন কমিশন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ১০টা থেকে টানা ভোট গণনা চলছে।

গণনা শুরুর পর বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও জাকসু নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোট গণনা করতে আজ সারা রাত লেগে যাবে। আশা করছি, কাল (শুক্রবার) দুপুরের মধ্যে ফলাফল ঘোষণা করা সম্ভব হবে।’

জাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান সিনেট হলে সংবাদ সম্মেলন করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ১২ সেপ্টেম্বর
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

পরদিন শুক্রবার সকাল আটটা নাগাদ একটি দুঃসংবাদ জানা যায়। ভোট গণনার কাজে অংশ নিতে এসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস মৌমিতা। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। তিনি প্রীতিলতা হলে পোলিং অফিসার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। এ খবরে গণনা কক্ষে কান্নায় ভেঙে পড়েন জান্নাতুলের সহকর্মীরা।

শোকের মধে৵ও চলতে থাকে ভোট গণনা। সকাল ১০টার পরে জাকসু নির্বাচনের নির্বাচনী কর্মকর্তা রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জানান, হল শিক্ষার্থী সংসদের ভোট গণনা শেষে কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদের ভোট গণনা শুরু হবে।

এ কে এম রাশিদুল আলম জানান, রাতে (শুক্রবার) গণনা শেষ হতে পারে। রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে সম্পূর্ণ গণনা শেষ করে বেসরকারিভাবে ফল প্রকাশ করতে পারবেন তাঁরা।

আরও পড়ুন

দুপুরে নামাজ ও মধ্যাহ্নভোজের জন্য দেওয়া এক ঘণ্টার বিরতিতে রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা বলেন, ‘আমাদের সব কটি হল সংসদের মধ্যে কেবল তিনটি হল ছাড়া বাকি হলগুলোর গণনা শেষ হয়েছে বা চলছে।’

ভোট গণনায় এত দেরি হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেকের মধে৵ ক্ষোভ দেখা যায়। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ৪৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী উম্মে হাবীবা শুক্রবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল সন্ধ্যা থেকে নির্বাচনের ফলের জন্য অপেক্ষা করছি। কেউ সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না কখন ভোট গণনা শেষ হবে। এভাবে অপেক্ষার কারণে জাকসু নির্বাচনের আনন্দটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

জাকসু নির্বাচনে ভোট গণনা চলছে। সিনেট হল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ১২ সেপ্টেম্বর
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো কলাভবনের সামনে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জাকসু নির্বাচনে নওয়াব ফয়জুন্নেসা হল কেন্দ্রের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সুলতানা আক্তার বলেন, ‘হল সংসদে একটিমাত্র ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোট হচ্ছে; কিন্তু জাকসুতে তিনটি করে, অর্থাৎ যদি আট হাজার ভোট কাস্ট (প্রদত্ত ভোট) হয়ে থাকে, তবে ২৪ হাজার কাউন্ট (গণনা) করতে হবে ম্যানুয়াল (হাতে গোনা) পদ্ধতিতে। তাহলে এটা কীভাবে সম্ভব, তিন দিনেও তো এটা সম্ভব হবে না। এই পদ্ধতির আমরা পরিবর্তন চাই।’

বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে সংবাদ সম্মেলন করে ‘নির্বাচনের ফল প্রকাশ না করে বানচাল করার ষড়যন্ত্র চলছে’ বলে অভিযোগ করে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল।

অবশেষে শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদের ভোট গণনা শুরু হয়েছে বলে জানান জাকসু নির্বাচন কমিশনার রেজোয়ানা করিম স্নিগ্ধা।

ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘রাতের মধ্যেই ভোট গণনা শেষ করে ফলাফল ঘোষণা করা হবে। তবে সেটির নির্দিষ্ট সময় নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। রাতের শেষভাগেও (ফল ঘোষণা) করা হতে পারে।’

জাকসু নির্বাচনের ফল স্থগিত করা হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা হবে বলে ঘোষণা দেন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী আবদুর রশিদ জিতু।

অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে শুক্রবার রাত পৌনে নয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনের নিচে এক সংবাদ সম্মেলনে জাকসু নির্বাচন কমিশন থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার।

শুক্রবার পেরিয়ে শনিবার

আজ শনিবার, তৃতীয় দিনের মতো ভোট গণনা চলছে। গণনা কখন শেষ হবে তা নিয়ে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানা যায়নি। নির্বাচন কমিশন একেকবার একেক সময়সীমার কথা বলে আসছেন।

জাকসু নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী আজ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বলেন, মোট ১৫টি হলের ভোট গণনা শেষ। আশা করছি, বাকি হলগুলোর ভোট গণনা বেলা ১টার মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।

আরও পড়ুন

বেলা সাড়ে ১১টার কিছু আগে অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী জানান, ১৭ হলে ভোট গণনা শেষ হয়েছে। বাকি আর চারটির।

সর্বশেষ দুপুর পৌনে ১২টার দিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আশা করছি, সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে জাকসু নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ করা সম্ভব হবে।’

ভোট গণনা শেষ হওয়ার সময় আর ফলাফল নিয়ে কর্তৃপক্ষের বারবার এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া ও রাখতে না পারা দেখে মনে পড়ে যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই কবিতা ‘কেউ কথা রাখেনি’। সুনীল বলেছিলেন ‘কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখেনি’। ৩৩ বছর পর অনুষ্ঠিত জাকসু নির্বাচনে ভোট গণনা আর ফলাফল নিয়ে প্রতিশ্রুতি শুনে মনে হয় কথা রাখছে না জাকসুর নির্বাচন কমিশনও।

ভোটার ১১ হাজার ৭৪৩ জন

জাকসুতে মোট ভোটার ১১ হাজার ৭৪৩ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ৫ হাজার ৭২৮ এবং ছাত্র ৬ হাজার ১৫ জন। কেন্দ্রীয় সংসদে মোট ২৫টি পদে লড়ছেন ১৭৭ জন প্রার্থী। একই সঙ্গে ২১টি হল সংসদের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে।

সহসভাপতি (ভিপি) পদে প্রার্থী ৯ জন। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ৮ জন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে ৬ জন এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে ১০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

আরও পড়ুন

একেকটি হলে পদসংখ্যা ১৫। ২১টি হল সংসদে মোট পদ ৩১৫টি। এতে ৪৭৭ জন প্রার্থী হয়েছেন। ছাত্রীদের ১০টি আবাসিক হলে ১৫০টি পদের মধ্যে ৫৯টিতে কোনো প্রার্থী নেই। একজন করে প্রার্থী রয়েছে ৬৭টি পদে। সে হিসেবে মাত্র ২৪টি পদে ভোট হয়েছে।

জাকসুতে মোট সাতটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এর মধ্যে চারটি পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ও তিনটি আংশিক প্যানেল রয়েছে। পূর্ণাঙ্গ প্যানেলগুলো হলো ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেল, ছাত্রশিবির-সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট, প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের সম্প্রীতির ঐক্য ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ-সমর্থিত শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম।

আংশিক প্যানেল দিয়েছে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন, স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ এবং ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফ্রন্টের সংশপ্তক পর্ষদ। এ ছাড়া অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়ছেন।

জাকসু ও হল সংসদে ভোট দেওয়ার পর আঙুলের ছাপ দেখাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। বীরপ্রতীক তারামন বিবি হলের সামনে, বৃহস্পতিবার দুপুরে
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

পাঁচ প্যানেলের ভোট বর্জন

ভোট গ্রহণ শুরু হয় বৃহস্পতিবার সকাল নয়টায়। সকালের দিকে ভোটার উপস্থিতি তুলনামূলক কম ছিল। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটার উপস্থিতি বাড়তে থাকে। ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীরাও ভোট দিতে ক্যাম্পাসে আসেন। জাকসু ভোটের জন্য গঠিত নির্বাচন কমিশন বৃহস্পতিবার রাতে জানায়, ভোট পড়তে পারে ৬৮ শতাংশের আশপাশে।

আরও পড়ুন

এর আগে নির্বাচনে অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে ভোট গ্রহণের সময় শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন বর্জন করে ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেল। এরপর প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের সম্প্রীতির ঐক্য, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফ্রন্টের সংশপ্তক পর্ষদ, স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ এবং ছাত্রফ্রন্টের একাংশের একটি প্যানেল নির্বাচন বর্জন করে। কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও নির্বাচন বর্জন করেছেন।

ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার কিছু সময় আগে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে সরে আসেন বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত তিন শিক্ষকও।

ইতিহাস যা বলে

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু ৫৪ বছর আগে, ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে জাকসু প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই বছরই জাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭২, ১৯৭৩ ও ১৯৭৪—পরপর তিন বছর জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পরে আর ধারাবাহিকতা থাকেনি।

আরও পড়ুন

১৯৮০, ১৯৮১, ১৯৮৯, ১৯৯০, ১৯৯১ ও ১৯৯২ সালে জাকসু নির্বাচন হয়। ১৯৯২ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে ছাত্রদল একচেটিয়াভাবে জয়লাভ করেছিল। তারা জাকসু ও হল সংসদের ১০৭টি পদের মধ্যে ১০৫টি পেয়েছিল। সব মিলিয়ে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে নির্বাচন হয়েছে ৯ বার। তারপর টানা ৩৩ বছরের অপেক্ষা।

আরও পড়ুন