‘তথ্য আপা’দের কথা শুনতে সরকারের প্রতি আহ্বান

‘তথ্য আপা’দের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে নাগরিক সমাবেশছবি: প্রথম আলো

চাকরি স্থায়ীকরণ বা রাজস্ব খাতে নতুন পদ সৃষ্টি করে স্থানান্তরের দাবিতে ১৭ দিন ধরে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান করছেন ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পের কর্মীরা। শিশুসন্তান নিয়েও অবস্থান করেছেন অনেকে। তবে তাঁদের দাবির প্রতি সাড়া দিয়ে এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কেউ তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।

‘তথ্য আপা’ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে আর বাকি রয়েছে মাত্র ১৭ দিন। এ অবস্থায় আজ শুক্রবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক নাগরিক সমাবেশ থেকে তথ্য আপাদের কথা শোনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

নাগরিক সমাবেশের পক্ষে অবস্থানপত্র পাঠ করেন লেখক ও গবেষক মাহা মির্জা। অবস্থানপত্রে বলা হয়, তথ্য আপাদের কথা শুনতে হবে। অন্যায়ভাবে ১৯৬৮ জন নারীকে চাকরিচ্যুত করা চলবে না। এতে আরও বলা হয়, প্রকল্পের ১ হাজার ৯৬৮ জন কর্মীর কাছ থেকে ৭ বছরে মোট ২০ কোটি ৪২ লাখ টাকার বেশি কেটে নিয়েছে। সেই টাকা ফেরত দিতে হবে। এই টাকা পাওয়ার জন্য ২০২২ সালে তথ্য আপারা আদালতে রিট করেন। আদালতের রায় তাঁদের পক্ষে গেলেও টাকা দেওয়া হয়নি।

অবস্থানপত্রে বলা হয়, দেশের গ্রামীণ নারীরা সরকারি সেবা, যেমন টিকা, ঘর বরাদ্দ, টিন, জাতীয় পরিচয়পত্র হালনাগাদ ইত্যাদি নানাবিধ অনলাইন সেবার জন্য তথ্য আপাদের ওপর ভরসা করে। কোনো সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হলে তথ্য আপাদের পরামর্শ নেয়।

অবস্থানপত্রে আরও বলা হয়, গত ১৫ বছরে ফ্যাসিবাদী আমলে প্রচুর লুটপাটের অংশ হিসেবে মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলোতেও বল্গাহীন লুটপাট চলেছিল। কিন্তু সেই দায় মাঠকর্মীদের নয়। বরং প্রকল্পের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং যাঁরা প্রকল্পটি তৈরি করেন, তাঁদের দায়। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে ‘আওয়ামী আবর্জনা’ হিসেবে অভিহিত করে তথ্য আপারা চাকরিচ্যুতির শিকার হচ্ছেন। কোনো সচিব বা উপসচিব এভাবে চাকরিচ্যুত হচ্ছেন না।

অবস্থানপত্রে অভিযোগ করা হয়, জুলাই গণহত্যার প্রকৃত রাজনৈতিক বিচার না করে, যে কেউ আন্দোলন করতে এলেই তাঁকে ‘আওয়ামী ট্যাগ’ দেওয়া একটি চিহ্নিত প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের। এ কর্মসূচি চলার সময় কর্মীরা প্রধান উপদেষ্টা বরাবর শান্তিপূর্ণভাবে দেখা করতে গেলে তাঁদের ওপর পুলিশ ন্যক্কারজনক হামলা করে।

নাগরিক সমাবেশে স্বাগত বক্তব্যে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য মারজিয়া প্রভা বলেন, যখন নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হচ্ছে, তখন এত নারীর চাকরিচ্যুতি প্রত্যাশিত নয়।

সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপ্রধান সীমা দত্ত, চিকিৎসক হারুন উর রশীদ, সাংস্কৃতিক কর্মী বীথি ঘোষ এবং মানবাধিকারকর্মী জাকিয়া শিশির।

সমাবেশে ঝালকাঠি তথ্যসেবা কর্মকর্তা সঙ্গীতা সরকার বলেন, ‘মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটা মানুষও আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেননি। এটা লজ্জাজনক, দুঃখজনক। নিজেদের অভিভাবকহীন মনে হচ্ছে। কর্মকর্তারা যেন নিজেদের দরকারে প্রকল্প নিয়েছেন, বাণিজ্য করেছেন আর এখন প্রয়োজন শেষে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগদলীয় ট্যাগ লাগিয়ে বিদায় করতে চাইছেন। অথচ আমরা কোনো দলের নয়, আমরা বাংলাদেশ সরকারের।’

সঙ্গীতা সরকার বলেন, তাঁদের দাবি, চাকরি স্থায়ীকরণ করতে হবে অথবা নতুন পদ সৃষ্টি করে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করতে হবে এবং কেটে নেওয়া অর্থ ফেরত দিতে হবে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নতুন প্রকল্পে নিয়োগ পেতে তাঁরা নতুন প্রার্থীদের সঙ্গে আবার পরীক্ষা দিতে চান না।

শিশুসন্তানদের নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে দুজন ‘তথ্য আপা’
ছবি: প্রথম আলো

শিশুদের নিয়ে আন্দোলনে মায়েরা

এদিকে সমাবেশে কয়েকজন তথ্য আপাকে সন্তানসহ দেখা গেছে। কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার তথ্যসেবা কর্মকর্তা খাদিজা আক্তার ও মেঘনা উপজেলার তথ্যসেবা সহকারী রুমি আক্তার দেড় বছর বয়সী এবং নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলা তথ্যসেবা সহকারী আফসানা আক্তার তিন বছর বয়সী সন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন। ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী এমন আরও পাঁচ শিশুকে দেখা গেছে মায়েদের সঙ্গে।

মেঘনা উপজেলার তথ্যসেবা সহকারী রুমি আক্তার বলেন, ২৮ মে থেকে প্রেসক্লাবের সামনে এসে কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন। প্রথম কয়েক দিন টানা অবস্থান ও অনশনে ছিলেন। ঈদের আগে থেকে তাঁরা সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত অবস্থান নেন। এভাবে টানা এত ছোট শিশুকে কারও কাছে রাখা সম্ভব নয় বলে তিনি প্রায়ই সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।

কথা বলতে গিয়ে চোখে পানি চলে এসেছিল দুই সন্তানের মা রুমি আক্তারের। তিনি বললেন, স্বামী অসুস্থ। তাঁর (রুমির) আয়ে চলে সংসার। চাকরি চলে গেলে কী হবে, তা তিনি ভাবতেও পারছেন না।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘জাতীয় মহিলা সংস্থা’র বাস্তবায়ন করা এ প্রকল্পের পুরো নাম ছিল ‘তথ্য আপা: ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন’। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একনেক সভায় প্রকল্পটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘তথ্য আপা: তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়) (২য় সংশোধিত)’।

২০১১ সালে পাইলট আকারে ১৩টি উপজেলায় এ প্রকল্প শুরু হয়। পরে ২০১৮ সালের শেষ দিকে ৪৯২টি উপজেলায় প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। ২০২২ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। পরে তা দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ৩০ জুন করা হয়। গত বছর আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ৩০ জুন করা হয়। সে হিসাবে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে আর ১৭ দিন বাকি।

আরও পড়ুন