পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি পাহাড় ছাড়িয়ে সমতলে
রংপুরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে জড়ো হয়েছেন স্থানীয় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। সেখানে সমাবেশ হচ্ছে। এ সমাবেশ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে। দৃশ্যটা গত ২০ মার্চের।
পার্বত্য জেলা রাঙামাটি থেকে রংপুরের দূরত্ব ৬০০ কিলোমিটারের বেশি। দেশের উত্তর-পশ্চিমের সেই জনপদে দূর পাহাড়ের মানুষের দাবি নিয়ে এমন সমাবেশ ব্যতিক্রমই বটে। রংপুরের সেই সমাবেশের আগে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি একই দাবিতে সমাবেশ হয় চট্টগ্রামে। আর সর্বশেষ সমাবেশ হয় ৫ জুন, ময়মনসিংহে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি নিয়ে এসব সমাবেশের আয়োজক ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’ নামে একটি জোট। এতে আছে বামপন্থী রাজনৈতিক দল বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন। সেখানে বাঙালি সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরাই সংখ্যায় বেশি। এ জোটের সঙ্গে আছে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী পাহাড়ের আঞ্চলিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)।
দেশের সব বিভাগীয় শহরেই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে এমন সমাবেশ করবে এ জোট। আগামী জুলাই মাসে সিলেটে আরও একটি সমাবেশ হতে পারে।
দেশের বাম দলগুলোর মধ্যে নানা প্রশ্নে মতভিন্নতা থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন প্রশ্নে তারা এককাট্টা হয়েছে এবং একসঙ্গে আন্দোলন করছে। আবার সরাসরি নিজেরা না থেকে একটি জোটের মাধ্যমে নিজেদের দাবি পূরণে তাতে শামিল হয়েছে জেএসএস। এই প্রচেষ্টা কতটুকু কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দিহান থাকলেও নির্বাচনের বছরে এই কর্মকাণ্ডকে ইতিবাচক বলেই মনে করছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে গবেষক এবং সেখানকার রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বর্তমান অবস্থা
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর। এ চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের এক-দশমাংশ এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই দশকের সশস্ত্র লড়াইয়ের অবসান হয়। জেএসএসের সশস্ত্র সংগঠন শান্তি বাহিনী অস্ত্র ছেড়ে দেয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ৭২টি ধারাসংবলিত। সরকারের পক্ষ থেকে এখন দাবি করা হয়, এর ৬৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে জেএসএস দাবি করে, পার্বত্য চুক্তির মৌলিক ধারাগুলোই এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী তিন পাহাড়ি জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি বান্দরবানে তিনটি পৃথক জেলা পরিষদ গঠিত হয়। আজ পর্যন্ত সেই জেলা পরিষদগুলো চলছে অনির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে। চুক্তি অনুযায়ী, পার্বত্য এলাকার স্থায়ী বাসিন্দাদের মাধ্যমে একটি ভোটার তালিকা করে তাঁদের ভোটে জেলা পরিষদের নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনো সেই ভোটার তালিকা হয়নি, নির্বাচনও হয়নি। পাহাড়ের মূল যে সমস্যা, সেই ভূমি সমস্যার কোনো সুরাহাই হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষে পার্বত্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তাদের নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে তাঁর ক্ষোভের কথা বলে আসছেন। গত বছরের (২০২২) ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তির ২৫ বছর পূর্তিতে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘চুক্তি স্বাক্ষরের পর আমরা প্রতিদিন, প্রতি মাস, প্রতিটি বছর এর সফল বাস্তবায়ন দেখতে চেয়েছি। সরকারকে সহযোগিতা করতে চেয়েছি। কিন্তু আমাদের তেমন কোনো সহযোগিতা করা হয়নি।’
নতুন এই আন্দোলন কেন
চুক্তির ২৫ বছর পূর্তির সময়ই গত বছর চুক্তি বাস্তবায়নে এ জোট গঠিত হয়। এতে বাম দলগুলোর মধ্যে আছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, দুই জাসদ, বাসদ, ঐক্য ন্যাপ। আর আছে একাধিক নাগরিক সংগঠন।
এ জোট গঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৃহত্তর বাঙালি সমাজের কাছে চুক্তির গুরুত্বটা তুলে ধরা আমাদের মূল উদ্দেশ্য। কারণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত থাকলে আমাদের কারও জন্য সেটা মঙ্গলজনক নয়। এই চুক্তি বাস্তবায়নের সপক্ষে বৃহত্তর জনমত তৈরি আমাদের লক্ষ্য।’
বিভিন্ন দাবিতে জেএসএসের নানা আন্দোলনে বাঙালি প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের একটা সমর্থন দলটি পেয়ে এসেছে। আঞ্চলিক দাবিতে জাতীয় পর্যায়ের মানুষদের একটি অংশকে সম্পৃক্ত করাটা জেএসএসের বিচক্ষণতার অংশ বলে মনে করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে একাধিক বইয়ের লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মোহসিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন এই আন্দোলনে জেএসএসও সম্পৃক্ত থাকছে। কিন্তু মূলধারার জনগোষ্ঠী এবং জাতীয় কিছু দল এ দাবিকে নিজেদের দাবি হিসেবে উপস্থাপন করছে, এটা ইতিবাচক।
এটা নির্বাচনের বছর। এই সময়ে নাগরিক এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য কি জাতীয় নির্বাচনে জেএসএসের দর–কষাকষির পাল্লা ভারী করা—এমন প্রশ্নের জবাবে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’–এর যুগ্ম সমন্বয়কারী ও মানবাধিকারকর্মী জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ আন্দোলনে জেএসএস সহযোগী হিসেবে আছে আরও কয়েকটি দলের মতোই। এখানে আমরা নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য কাজটি করছি। কোনো পক্ষের দর–কষাকষির পক্ষে আমরা নেই।’
এ জোটের উদ্যোগকে ইতিবাচক বলে মনে করলেও কিছু বাম দল ও নাগরিক সংগঠনের এ তৎপরতা কতটুকু কার্যকর হবে, সে বিষয়ে সন্দিহান পার্বত্য রাজনীতির গবেষক অধ্যাপক মং সা নু চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাম দলগুলো শক্তিমত্তায় কমজোর। তারা পাহাড়ের এ দাবি আদায়ে কতটুকু কী করতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে পাহাড়ের মানুষের যৌক্তিক এ দাবি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জানল, সেটাও একটা লাভ।’
যদিও এ আন্দোলনে লাভ–ক্ষতির কোনো হিসাব করছেন না জেএসএসের সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার। তাঁর কথা, ‘আমরা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারকে বলে বলে ক্লান্ত হয়ে গেছি। এবার আমরা দেশের সব প্রান্তে গিয়ে বলতে চাই। তাই এখানে আমাদের সমর্থন আছে।’