বয়স্ক ও বিধবা ভাতার নতুন তালিকা বন্ধ

অর্থ বরাদ্দ না থাকায় এ অর্থবছরে দুটি ভাতার জন্য নতুন করে কাউকে তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে না।

প্রতীকী ছবি

সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত সবচেয়ে বড় কার্যক্রম হচ্ছে ‘বয়স্ক ভাতা’ এবং ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত মহিলা ভাতা’ সংক্ষেপে যা ‘বিধবা ভাতা’ নামে পরিচিত। তবে অর্থ বরাদ্দ না থাকায় এ অর্থবছরে (২০২২-২৩) এ দুটি ভাতার জন্য নতুন করে কাউকে তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে অর্থ বরাদ্দ না থাকার বিষয়টি জানা গেছে।

অধিদপ্তরের জিটুপি (গভর্নমেন্ট টু পারসন) পদ্ধতিতে অর্থাৎ মুঠোফোনের অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা পাঠানোর মোট আট ধরনের ভাতা কার্যক্রমের মধ্যে ‘প্রতিবন্ধী ভাতা’ ছাড়া বাকিগুলোর নতুন করে তালিকাভুক্তি স্থগিত আছে।

ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন এলাকায় জনপ্রতিনিধিরা হাতে লেখা আবেদনপত্র জমা নিলেও তা ভাতার জন্য অনলাইনে চূড়ান্ত তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, বয়স্ক ও বিধবা ভাতার জন্য আবেদন করা ব্যক্তিরা প্রায়ই এসে তালিকাভুক্ত হওয়ার বিষয়ে খোঁজ নেন।

নতুনভাবে অনেকে দরিদ্র হচ্ছে, তাদের বেশি করে সাহায্য প্রয়োজন। তাদের ভাতার আওতাভুক্ত করা দরকার। এই মুহূর্তে অন্য খাত থেকে টাকা এনে হলেও দরিদ্র লোকজনকে সাহায্য করা উচিত।
অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকার, চেয়ারম্যান, সানেম

ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার তারানগর ইউনিয়নের গুইটা গ্রামের বাসিন্দা হালিমা বেগম (৩৯) পাঁচ মাস আগে বিধবা ভাতার জন্য তালিকাভুক্ত হতে তারানগর ইউপি কার্যালয়ে হাতে লেখা একটি আবেদনপত্র দিয়ে আসেন। প্রথম আলোকে হালিমা জানান, মাস দেড়েক আগে খোঁজ নিতে গিয়ে শোনেন, নতুন করে তালিকাভুক্ত বন্ধ রয়েছে। হালিমা বললেন, ‘অনেক সমস্যায় আছি। জায়ের বাড়িতে কাজ করে মাসে দুই হাজার টাকা পাই। ভাতা পাইলে উপকার হইতো।’

আরও পড়ুন

রাজধানীর কল্যাণপুরে ১ নম্বর পোড়াবস্তির বাসিন্দা আবদুল মোতালেব (৬৯) জানান, বয়স্ক ভাতার জন্য দফায় দফায় আবেদন জমা দিয়েছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে। মেয়ের সংসারে থাকেন। আশায় আছেন ভাতার তালিকায় তাঁর নাম উঠবে।

নতুন করে ভাতাভুক্ত (প্রতিবন্ধী ভাতা ছাড়া) করা বন্ধ রয়েছে কি না জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, এটাকে বন্ধ না বলে সাময়িক স্থগিত বলা যায়। ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়িয়ে ভাতা একই রাখা হবে, নাকি ভাতাভোগীর সংখ্যা একই রেখে ভাতার অঙ্ক বাড়ানো হবে, তা চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। তবে অধিদপ্তর ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর পক্ষে।

কবে নাগাদ নতুন করে ভাতাভোগী নেওয়া হবে জানতে চাইলে আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল বলেন, এটা নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় জানাতে পারবে।

যোগাযোগ করা হলে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান গতকাল সোমবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ভাতাভুক্ত করা বন্ধ নেই। ২৬২ উপজেলায় বয়স্ক ও বিধবা ভাতা শতভাগ করার কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। এসব কাজ শেষ করে নতুন করে ভাতাভোগী নেওয়া হবে। সেটা কবে নাগাদ হবে জানতে চাইলে বলেন, শতভাগ উপজেলা হালনাগাদ করার কাজটা আগে শেষ হোক।

মাসে প্রয়োজন হতো ৬১ কোটি ৩০ লাখ টাকা

সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে বয়স্ক ভাতা ও পরের বছর থেকে বিধবা ভাতা কর্মসূচি চালু হয়। কয়েক বছর ধরে এ দুটি ভাতার ক্ষেত্রে বছরে তিন থেকে পাঁচ লাখ করে সংখ্যা বাড়ানো হয়। তবে বয়স্ক ভাতার ক্ষেত্রে গত অর্থবছরে (২০২১-২২) সর্বোচ্চসংখ্যক ৮ লাখ ১ হাজার নতুন ভাতাভোগী তালিকাভুক্ত করা হয়। একই অর্থবছরে বিধবা ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হয় ৪ লাখ ২৫ হাজার। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বয়স্ক ভাতাভোগীর মোট সংখ্যা ৫৭ লাখ ১ হাজার। আর বিধবা ভাতাভোগীর সংখ্যা ২৪ লাখ ৭৫ হাজার।

আরও পড়ুন

গত অর্থবছরে এ দুটি ভাতার ক্ষেত্রে বরাদ্দ যা ছিল, এবার তাই-ই আছে। বয়স্ক ভাতা খাতে ৩ হাজার ৪৪৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা এবং বিধবা ভাতার ক্ষেত্রে ১ হাজার ৪৯৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। যদি এ অর্থবছরেও এ দুটি ভাতার ক্ষেত্রে আগের মতো (২০২১-২২) ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হতো, তাহলে ১২ লাখ ২৬ হাজার জনের জন্য মাসে প্রয়োজন হতো ৬১ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

এ দুটি ভাতার ক্ষেত্রে সাত বছর ধরে মাসে ৫০০ টাকা করে তিন মাস পরপর দেড় হাজার টাকা ভাতা পান তালিকাভুক্তরা। পুরুষদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৬৫ বছর এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৬২ বছর বয়সীরা বয়স্ক ভাতার জন্য তালিকাভুক্ত হন।

সরকারের ১২০টি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মধ্যে ৪৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় এ কর্মসূচিতে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা বেড়েছে

সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, এ অর্থবছরে ভাতাভোগীর সংখ্যা ১ কোটি ৮ লাখের বেশি। এর অধিকাংশই ‘বয়স্ক ভাতা’, ‘বিধবা ভাতা এবং ‘প্রতিবন্ধী ভাতা’। এ অর্থবছরে প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা ৩ লাখ ৫৭ হাজার বেড়ে হয়েছে ২৩ লাখ ৬৫ হাজার জন। ভাতার পরিমাণ ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৮৫০ টাকা করা হয়েছে।

এ ছাড়া অন্যান্য ভাতাভোগীর মধ্যে ‘চা–শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি’র জন্য শ্রমিকসংখ্যা ১০ হাজার বাড়িয়ে ৬০ হাজার করা হয়েছে। তবে এই কর্মসূচির আওতায় চা-শ্রমিক পরিবারপ্রতি বছরে এককালীন পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়। একটি পরিবার এক বছর সহায়তা পেলে পরের বছর অন্য পরিবার পায়।

বাকি চারটি ভাতা কর্মসূচি হচ্ছে, প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি, হিজড়া, বেদে এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি। এ কর্মসূচিগুলোর ভাতা ও উপবৃত্তির অংশটুকু জিটুপি পদ্ধতিতে দেওয়া হয়। এই কর্মসূচিগুলোর প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ উত্তর সহায়তার সংখ্যা গত অর্থবছরের চেয়ে কমেছে।

সার্ভার বন্ধ

নতুন ভাতাভুক্ত করা বন্ধ থাকায় অনলাইনে আবেদন জমা নেওয়ার সার্ভার বন্ধ রাখা হয়েছে। বরিশাল জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বরিশালে মোট ৯টি উপজেলা ও ১টি পৌরসভা রয়েছে। সেগুলো শতভাগ বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতার আওতাভুক্ত। নির্দেশনা না থাকায় এ বছর নতুন করে এ দুটি ভাতার জন্য আবেদন জমা নেওয়া হচ্ছে না।

প্রতিবন্ধী ভাতার ক্ষেত্রে বর্ধিত কোটায় ১০ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনলাইনে আবেদন ফরম নেওয়া হয়। তবে বরিশালের মতো কিছু জেলায় চাহিদা অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তি পাওয়া না যাওয়ায় দ্বিতীয় দফায় আবেদন নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

চাঁদপুরের মোট ৮টি উপজেলার মধ্যে ৫টি উপজেলা শতভাগ বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতার আওতাভুক্ত। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা শাহাদত হোসেন বলেন, এ বছর প্রতিবন্ধী ভাতা ছাড়া আর কোনো ভাতার ক্ষেত্রে নতুন আবেদন জমা নেওয়া হচ্ছে না। তিনি জানান, তাঁর উপজেলায় ১৬ হাজার ৫৮৮ জন বয়স্ক ভাতা এবং ৮ হাজার ৯৬ জন বিধবা ভাতা পাচ্ছেন। গত অর্থবছর নতুন আবেদন নেওয়া হয়েছিল। তখন এ দুটি ভাতার ক্ষেত্রে ৬০০ জনকে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।

অনেকে এসে খোঁজ নিয়ে যান

ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার তারানগর ইউপি চেয়ারম্যান মো. মোশারফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর এলাকায় বয়স্ক ও বিধবা ভাতার পুরোনো ৪২টি আবেদন জমা রয়েছে। এখন আরও নতুন আবেদন জমা হচ্ছে। নতুন তালিকাভুক্তির বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নির্দেশনা এলেই তাঁরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন। তিনি বলেন, ‘প্রায়ই লোকজন এসে খোঁজ নিয়ে যান তাঁর আবেদনটির কোনো ব্যবস্থা হলো কি না। আমরা যা সত্য, তা–ই জানাই তাঁদের। ভাতার টাকা দিয়ে অনেকে ওষুধ কেনেন, নিজের খরচ চালান।’

রাজধানীর কল্যাণপুর কাউন্সিলর কার্যালয়ের সহকারী শামীমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে তাঁদের কাছে বয়স্ক ভাতার চাহিদা চাওয়া হয়নি। চারটি প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ডের জন্য নাম চাওয়া হয়েছিল। কিছুদিন আগে তা দেওয়া হয়েছে। তবে কাউন্সিলর কার্যালয়ে বয়স্ক ভাতার জন্য কেউ আবেদন জমা দিতে এলে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না, জমা রাখা হচ্ছে। উল্লেখ্য, সিটি করপোরেশন এলাকায় বিধবা ভাতা নেই।

এখন লোকের বেশি করে সহায়তা প্রয়োজন

এই মুহূর্তে সামাজিক সুরক্ষা খাতে কোনো ধরনের সংস্কার আনা উচিত নয় বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) চেয়ারম্যান অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, নতুন ভাতাভোগী তালিকাভুক্ত না করার কারণ হতে পারে ভাতা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় সমস্যা থাকা অথবা বাজেট বরাদ্দ না থাকা। হয়তো সরকার খরচের সময়টাকে দীর্ঘায়িত করতে চাইছে।

বজলুল হক খন্দকার বলেন, এখন মানুষ মূল্যস্ফীতির বড় ধাক্কায় পড়েছে, কেনাকাটার সক্ষমতা কমে গেছে। নতুনভাবে অনেকে দরিদ্র হচ্ছে, তাদের বেশি করে সাহায্য প্রয়োজন। তাদের ভাতার আওতাভুক্ত করা দরকার। এই মুহূর্তে অন্য খাত থেকে টাকা এনে হলেও দরিদ্র লোকজনকে সাহায্য করা উচিত।