মা নাফিজাকে নতুন শ্বশুরবাড়ি পাঠাল শাহবাজ

বিয়ের অনুষ্ঠানে মা নাফিজা রহমানের সঙ্গে ছেলে শাহবাজ আহমেদছবি: নাফিজার সৌজন্যে

কনের শাড়ির রং সবুজ। এর সঙ্গে মিলিয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া শাহবাজ আহমেদ (জিত) পাঞ্জাবির সঙ্গে ঝলমলে একটি সবুজ কোটি পরেছে। বিয়ের সাজে মেয়েকে বাবা যেমন হাত ধরে মঞ্চের দিকে নিয়ে যান, শাহবাজও তেমন কনের হাত ধরে হেঁটেছে। মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর আগে বাবার যেসব ভূমিকা থাকে, তার সবই পালন করেছে শাহবাজ।

কনের নাম নাফিজা রহমান (মৌ)। আর শাহবাজ হলো নাফিজার কিশোর ছেলে। এই ছেলেই বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা হাসিমুখে পালন করে মাকে নতুন শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়েছে। মা শ্বশুরবাড়িতে যখন যাচ্ছেন, তখন অবশ্য ছেলে কান্না সামলাতে পারেনি।

মায়ের বিয়ের আগে প্রস্তুতি পর্ব থেকেই নানাজনের ‘অ্যাই, তোর মায়ের নাকি বিয়ে’—এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে শাহবাজকে। শাহবাজ বেশ ভালোভাবেই এর উত্তর দিয়েছে। এই মায়ের বয়স এখন ৩২ আর ছেলের ১৭ বছর।

নাফিজা বাংলাদেশে অবস্থিত আইভরিকোস্টের কনস্যুলেট অফিসে কর্মরত। তিনি একজন প্রশিক্ষক। ভাষাশিক্ষার নতুন পদ্ধতি ডুয়োলিংগো, করপোরেট ও লিডারশিপ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন তিনি।

সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী ছেলে শাহবাজকে নিয়ে আগের শ্বশুরবাড়ি থেকে মা-বাবার কাছে ফিরে এসেছিলেন নাফিজা। এরপর ১২ বছর ধরে ‘সিঙ্গেল মাদার’ হিসেবে ছেলেকে বড় করেছেন। ছেলে প্রায়ই মাকে বলত, তিনি যেন আরেকটা বিয়ে করে নিজের জীবনকে গুছিয়ে নেন। মায়ের বিয়ে নিয়ে ছেলের কোনো আপত্তি তো নেইই, উল্টো সেটাই সে চায়—এমনটা নিশ্চিত হয়েই নাফিজা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন।

৯ ফেব্রুয়ারি দুই পরিবারের সদস্যসহ বন্ধু-স্বজনদের উপস্থিতিতে ঘটা করে বিয়ে হয়েছে নাফিজার। তিনি বললেন, ‘ছেলে হলুদের অনুষ্ঠানে নেচেছে। আমার বাবা হাবিবুর রহমান মারা গেছেন ২০২০ সালে। বাবা বেঁচে থাকলে আমার বিয়েতে যা যা করতেন, তাই করেছে আমার ছেলে।’

আরও পড়ুন
মা-বাবার মাঝে হাসিমুখে শাহবাজ আহমেদ
ছবি: নাফিজার সৌজন্যে

নাফিজা বলেন, ‘ছেলে রাজধানীর লালমাটিয়ায় এবং আমার শ্বশুরবাড়ি গুলশানে—দুই জায়গাতেই যাওয়া-আসা করবে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার পর কোচিং করাসহ ছেলে আবার তার দৈনন্দিন কাজে ফিরেছে। বিয়ের পর সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) রাতে মায়ের বাসায় প্রথম গেলাম। ছেলে আমাদের দেখে খুশি হয়েছে।’

নাফিজার স্বামী রাকিব সিদ্দিক ব্যবসায়ী। ছেলে শাহবাজ মা-বাবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে ছবি তুলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এই দম্পতির পাশাপাশি নানাজনের শুভেচ্ছাবার্তা পাচ্ছে শাহবাজও।

নাফিজা বললেন, ‘আমার এ বিয়েকে উদাহরণ হিসেবে দেখছি। আমাদের সুস্থ, পারিবারিক বন্ধন যাতে অটুট থাকে, সবার কাছে সে দোয়া চাই।’ নাফিজা তাঁর আগের বিয়েসহ বিভিন্ন বিষয়ে এখন আর কথা বলতে চান না।

নাফিজা ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি ভাষা নিয়ে মাস্টার্স করেছেন। পরে রাশিয়া থেকে বিশ্ব অর্থনীতিতে সম্পন্ন করেছেন দ্বিতীয় মাস্টার্স। ২০২১ সালে রাশিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন।

আরও পড়ুন

শাহবাজ ছোট থেকেই তার নানি মীর আফরোজা খাতুন ও মামা মুশফিকুর রহমানের কাছে বড় হয়েছে। মা নাফিজাকে কাছে পেয়েছে কম। পড়াশোনা, নাচের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, লিডারশিপ বা নেতৃত্ব বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়াসহ ব্যস্ততা নাফিজার পিছু ছাড়েনি কখনো। তবে ছোট থেকেই ছেলে মায়ের কষ্ট বুঝতে শিখেছে। মায়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সব সময় ছিল এবং আছে বলে জানালেন নাফিজা। কথা বলতে চাইলে শাহবাজ লাজুক হেসে কথা বলবে না বলে জানায়।

নাফিজা জানালেন, তাঁর নানি মীর আমেনা শামসুদ্দিনের আদর্শে তিনি বড় হয়েছেন। তাঁর কাছ থেকেই নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি আয়ত্ত করেছেন। আর চলার পথে সব সময় পাশে পেয়েছেন বাবা, মা, ভাই ও যৌথ পরিবারের অন্য সদস্যদের। বললেন, পরিবার পাশে না থাকলে হয়তো চলার পথে থেমে যেতে হতো। কিন্তু তা হয়নি, নিজের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পেয়েছেন। মা ও নানি শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নেন।

উইমেন লিডারশিপ ক্যাটাগরিতে ‘রাইজিং ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’ পেয়েছেন নাফিজা। গত বছরের মার্চে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দুবাইয়ের ইয়ুথ গ্লোবাল পার্লামেন্টের সম্মাননাও পেয়েছেন তিনি। নেক্সট জেনারেশন ক্যাটাগরিতে পেয়েছেন এমএন মাল্টিমিডিয়া আইকনিক অ্যাওয়ার্ড ২০২২। ২০১৬ সালে চীনে সিয়াস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। একই বছর পান রোটারি ইয়ুথ লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড। জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল, ঢাকা ইয়াংয়ের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ছোট্ট শাহবাজের সঙ্গে মা নাফিজা (বাঁয়ে)। বিয়ের অনুষ্ঠানে মায়ের হাত ধরে মঞ্চে নিয়ে যাচ্ছে শাহবাজ
ছবি: নাফিজার সৌজন্যে
আরও পড়ুন

পাশাপাশি নাফিজা একজন ডুওলিংগো এক্সপার্ট। এ বিষয়ে গত বছর তাঁর একটি বই প্রকাশিত হয়েছে, নাম-‘ডুওলিংগো শিখি নাফিজার সাথে’।

নাফিজা বললেন, ‘একসময় ছেলেকে নিয়ে সংগ্রাম করেছি। এই ছেলেই এখন আমার অভিভাবক হয়ে গেছে! ছেলে আমার জন্য অনেক সেক্রিফাইস (ত্যাগ শিকার) করেছে।’