প্রভোস্ট ও হাউস টিউটররা যেন সর্বোচ্চ সময়টুকু দেন, নিশ্চিত করতে হবে: হাইকোর্ট

হাইকোর্ট
ফাইল ছবি

প্রতিটি হল বা হোস্টেলে প্রভোস্ট ও হাউস টিউটরের মতো পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক থাকেন, তাঁদের উপস্থিতি অপ্রত্যাশিত ঘটনা কমাতে পারে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট। প্রভোস্ট ও হাউস টিউটররা (আবাসিক শিক্ষক) যেন সর্বোচ্চ সময়টুকু দেন, তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করার কথাও বলেছেন হাইকোর্ট।

বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বুধবার এক আদেশে এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।

কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) হলে ফুলপরী খাতুনকে নির্যাতনের ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিল করার পর কয়েক দফা নির্দেশনাসহ আজ আদেশ দেন আদালত। কিছু উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থী দলের ভাবমূর্তি নষ্টের পাশাপাশি ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তির ইতিহাস নষ্ট করছেন বলেও আদালতের পর্যবেক্ষণে এসেছে।  

পর্যবেক্ষণে বলা হয়, হল বা হোস্টেলের এক ভবনে বহু শিক্ষার্থী থাকেন। শিক্ষার্থীদের আবাসন–সংকটের বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে মনে রাখতে হবে। প্রতিটি হল বা হোস্টেলে পর্যাপ্তসংখ্যক প্রভোস্ট ও হাউস টিউটরের মতো শিক্ষক থাকেন। তাঁদের উপস্থিতি অপ্রত্যাশিত ঘটনা কমাতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা যায়, এই শিক্ষকেরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে আন্তরিক নন। এমনকি সংশ্লিষ্ট হলে সর্বোচ্চ সময়টুকু কাটান না; বিশেষত রাতের পালায়। প্রভোস্ট ও হাউস টিউটররা যেন সর্বোচ্চ সময়টুকু দেন, তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। তাঁরা প্রয়োজন হলে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তাও নিতে পারেন।

হাইকোর্টের আদেশে ‘এ এস এম মাহাদী হাসান এবং অন্যান্য বনাম সরকার’ শীর্ষক মামলায় ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দেওয়া রায়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়। এটি সংক্ষেপে বুয়েট মামলা (র‍্যাগিং নিয়ে) নামে পরিচিত। রায়ের পর্যবেক্ষণ টেনে আদালত বলেন, এ ধরনের র‍্যাগিং যেটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নবাগতদের পরিচিতি অনুষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। এখন র‍্যাগিংয়ের নামে কিছু উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থী ফৌজদারি অপরাধ সংগঠন করছেন। ওই রায়ে র‍্যাগিংকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রায়ে র‍্যাগিংয়ের নামে নির্যাতনের মতো কার্যক্রম রোধে ছয় দফা নির্দেশনাও তুলে ধরা হয় আজকের আদেশে।

ফুলপরীকে নির্যাতনের ঘটনায় ছাত্রলীগের পাঁচ নেতা-কর্মী জড়িত থাকার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত তিন সদস্যের কমিটির প্রতিবেদনে প্রভোস্ট ও হাউস টিউটরসহ কয়েকজনের দায়িত্বে চরম অবহেলা ও গাফিলতির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর আদালত আজ পর্যবেক্ষণ ও কয়েক দফা নির্দেশনাসহ আদেশ দেন।

এ ছাড়া পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা খবরে দেখা যাচ্ছে, সম্প্রতি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্টভাবে আবাসিক হল ও হোস্টলে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয়ের অপব্যবহার করে অপ্রত্যাশিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছেন। কলেজজীবন পেরোনোর সময় তাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরে ঢুকে নিষ্পাপ শিক্ষার্থী, বিশেষত নবাগতদের অপমান ও নির্যাতন করেন। এ ধরনের কিছু অবাধ্য ছাত্র শিক্ষার মানসম্মত পরিবেশ নষ্ট করছেন। এমনকি দলীয় শৃঙ্খলাও ভঙ্গ করছেন। দলের ভাবমূর্তি নষ্টের পাশাপাশি ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তির ইতিহাস নষ্ট করছেন।  

গত ১২ ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে আটকে রেখে ফিন্যান্স বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফুলপরীকে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেন। তাঁর সাহসী ভূমিকা দেশে আলোচনার জন্ম দেয়।

এই ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন যুক্ত করে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা চেয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইবির সাবেক শিক্ষার্থী গাজী মো. মহসীন। পরদিন শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দিয়ে কয়েক দফা নির্দেশনাসহ আদেশ দেন।

আরও পড়ুন

এর মধ্যে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টিও ছিল। এই কমিটিতে প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা, জেলা জজ মনোনীত বিচার বিভাগীয় একজন কর্মকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী অধ্যাপককে রাখতে বলা হয়। তিন সদস্যের এই কমিটির প্রতিবেদন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে আদালতে জমা দিতে বলা হয়। সে অনুসারে গতকাল মঙ্গলবার রাষ্ট্রপক্ষ প্রতিবেদন দুটি আদালতে উপস্থাপন করে।

ফুলপরীকে নির্যাতনের ঘটনায় ছাত্রলীগের পাঁচ নেতা–কর্মী জড়িত থাকার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত তিন সদস্যের কমিটির প্রতিবেদনে প্রভোস্ট ও হাউস টিউটরসহ কয়েকজনের দায়িত্বে চরম অবহেলা ও গাফিলতির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর আদালত আজ পর্যবেক্ষণ ও কয়েক দফা নির্দেশনাসহ আদেশ দেন।

আদালতে রিট আবেদনকারী গাজী মো. মহসীন এবং রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ফারহানা পারভীন ও মো. আবুল হাসান শুনানিতে ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক।

আরও পড়ুন

নির্দেশনায় আদালত ফুলপরীকে নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত বলে তদন্ত প্রতিবেদনে নাম আসা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরীসহ পাঁচ ছাত্রীকে (সানজিদার অনুসারী) সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। অপর চার ছাত্রী হলেন হালিমা আক্তার, ইসরাত জাহান, তাবাসসুম ইসলাম ও মোয়াবিয়া জাহান। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলের প্রভোস্ট শামসুল আলমকে অবিলম্বে প্রত্যাহার করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়। আদেশের পর আজই তাঁকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

অপর নির্দেশনায় ঘটনার সময় ফুলপরীর ভিডিও ধারণকারী শিক্ষার্থী হালিমা আক্তারের মুঠোফোন উদ্ধার ও ধারণ করা ভিডিও সংরক্ষণ করে আদালতে দাখিল করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফুলপরী নির্ভয়ে, স্বাভাবিকভাবে নিয়মিত ক্লাস করতে পারেন—সে জন্য তিন দিনের মধ্যে তাঁর পছন্দ অনুসারে তাঁকে হলের যেকোনো কক্ষে আসন বরাদ্দ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ফুলপরীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জরুরি ভিত্তিতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে কুষ্টিয়া ও পাবনার পুলিশ সুপারসহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তদন্ত প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালত ৮ মে প্রয়োজনীয় আদেশের জন্য দিন ধার্য রেখেছেন। এই সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন।

আরও পড়ুন