পথ দেখিয়ে–অনুপ্রেরণা জুগিয়ে সম্মাননা পেলেন ১০ তরুণ

স্টারশিপ ইন্সপায়ারিং টেন আয়োজনে অতিথি ও বিচারকমণ্ডলীর সঙ্গে বিজয়ী ১০ তরুণ। স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের এই উদ্যোগের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার ছিল প্রথম আলো ডটকম। বনানী, ঢাকা, ২৭ সেপ্টেম্বর
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

সমাজে এমন কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা নিজেরা তো এগিয়ে যানই, অনেককে সঙ্গে নেন, আরও বহুজনকে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখান, অনুপ্রেরণা জোগান। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠা তরুণ প্রজন্মের তেমনি ১০ জনকে তাঁদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সম্মাননা দেওয়া হলো।

আজ শনিবার শরতের শেষ বিকেলে ‘স্টারশিপ ইন্সপায়ারিং টেন ২০২৫’ নামের এক আনন্দঘন রুচিস্নিগ্ধ অনুষ্ঠানে তাঁদের হাতে স্বর্ণপদক, সনদ ও দুই লাখ টাকার চেক তুলে দেওয়া হয়। রাজধানীর বনানীতে হোটেল শেরাটনের বলরুমে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের এ উদ্যোগের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার ছিল প্রথম আলো ডটকম।

অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’–এর সঙ্গে ঈগল ড্যান্স ট্রুপের শিল্পীদের সমবেত নৃত্য পরিবেশনা দিয়ে। এরপর মঞ্চে এসে দর্শকদের স্বাগত জানান দুই উপস্থাপক কনটেন্ট ক্রিয়েটর শুভাশীষ ভৌমিক ও কণ্ঠশিল্পী দোলা রহমান। অনুষ্ঠানে বড় ডিজিটাল পর্দায় দেখানো হয় ‘স্টারশিপ ইন্সপায়ারিং টেন’ আয়োজনের সার্বিক পরিক্রমার তথ্যচিত্র।

‘স্টারশিপ ইন্সপায়ারিং টেন’ সম্মাননা অনুষ্ঠানে আগত অতিথিরা। ঢাকা, ২৭ সেপ্টেম্বর
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

এবার প্রথমবারের মতো ‘স্টারশিপ ইন্সপায়ারিং টেন’ সম্মাননা দেওয়া হলো। এর কার্যক্রম শুরু হয়েছিল চলতি বছরের জুলাই মাসে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, পরিবেশ, সামাজিক উদ্যোগ, সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতা, সেবা খাত, উৎপাদন ও শিল্প এবং অন্যান্য খাতে ১০ জনকে সম্মাননা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আবেদন জমা পড়েছিল ৪১৬টি। সেখান থেকে প্রাথমিক বাছাইয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন ৪৩ জন। তাঁদের মধ্যে বিচারকেরা সেরা ১০ জনকে নির্বাচিত করেন।

আরও পড়ুন

নির্বাচিতরা হলেন পালকি মোটরসের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মোস্তফা আল মমিন (প্রযুক্তি উদ্যোগ), টিম ব্যর্থর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক মুরশিদুল আলম ভূঁঞা (সামাজিক উদ্যোগ), অনলাইন এডুকেশন কনটেন্ট ক্রিয়েটর মুনজেরিন শহীদ (অনলাইন শিক্ষা), রিদ্মিক কি-বোর্ডের উদ্ভাবক মো. শামীম হাসনাত (সফটওয়্যার প্রযুক্তি), নকরেক আইটি ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা সুবীর নকরেক (ফ্রিল্যান্সিং), রোবোলাইফ টেকনোলজিসের প্রতিষ্ঠাতা জয় বড়ুয়া লাভলু (রোবোটিক প্রযুক্তি), চলচ্চিত্র নির্মাতা রায়হান রাফী (চলচ্চিত্র নির্মাণ), মজার ইশকুলের প্রতিষ্ঠাতা আরিয়ান আরিফ (সামাজিক উদ্যোগ), ফিলাইটের উদ্ভাবক মো. তাসনিমুল হাসান তাওহীদ (কৃষিপ্রযুক্তি) এবং ফুটবলার ঋতুপর্ণা চাকমা (ক্রীড়া)।

‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম…’ নজরুলসংগীতের সঙ্গে ঈগল ড্যান্স ট্রুপের নৃত্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। ঢাকা, ২৭ সেপ্টেম্বর
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

স্টারশিপ ইন্সপায়ারিং টেনের বিচারকমণ্ডলীর প্রধান ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার। সদস্য ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারপারসন সেঁজুতি রহমান।

তরুণদের সম্মাননা জানানোর এ উদ্যোগের তিনটি কারণ ছিল বলে জানান স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের চিফ মার্কেটিং অফিসার শোয়েব মো. আসাদুজ্জামান। মঞ্চে এসে তিনি বললেন, গত বছর দেশে যে এক বড় রকমের পরিবর্তন ঘটেছে, তাতে প্রধান ভূমিকা ছিল তরুণদের। তরুণেরাই সাধারণত পরিবর্তনের প্রধান উদ্যোগী হন, এ কারণে তাঁদের সম্মাননা দেওয়া। অন্য কারণটি হলো, ‘আমাদের দেশে সাধারণত দেখা যায়, গুণীজনেরা সম্মানিত হন তাঁদের জীবনের শেষ পর্যায়ে। অনেক গুণী জীবদ্দশায় তাঁর কাজের স্বীকৃতি পান না, মরণোত্তর পুরস্কার পান। এই রীতি থেকে সরে এসে তরুণদের কাজের স্বীকৃতি দেওয়া।’

তৃতীয় কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ‘তরুণ প্রজন্মকে সম্মানিত করে তাঁদের প্রতি দায়িত্ব তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা। এসব কারণে আমাদের লক্ষ্য ছিল সমাজ ও দেশের জন্য কল্যাণকর উদ্ভাবন এবং ইতিবাচক প্রভাব রাখার মতো তরুণদের স্বীকৃতি দেওয়া।’

বিজয়ীদের হাতে সম্মাননা পুরস্কার তুলে দেওয়ার ফাঁকে কথা বলেন (বাঁ থেকে) প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, ওরাকলের কান্ট্রি ম্যানেজিং ডিরেক্টর রুবাবা দৌলা এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আফজাল হোসেন। ঢাকা, ২৭ সেপ্টেম্বর
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

বিচারকমণ্ডলীর প্রধান সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার বলেন, বিজয়ীদের বাছাই করা একটি দারুণ অভিজ্ঞতা ছিল। প্রত্যেক প্রার্থীই অনন্য প্রতিভা এবং সমাজে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখেন।

বিচারক হাবিবুল বাশার বলেন, সেরা ১০ জনকে নির্বাচন করার সময় তাঁদের অর্জন, নতুনত্ব এবং কাজের ধারাবাহিকতা বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়েছে। তাঁদের গল্প শুনে তিনি নিজেও অনুপ্রাণিত হয়েছেন।

এরপর শুরু হয় এ বছরের সেরা ১০ বিজয়ীকে সম্মাননা জানানোর পালা। প্রত্যেকের নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পর্দায় তাঁদের কাজের পরিচিতি তুলে ধরা হয়। বৈদ্যুতিক গাড়ি ‘পালকি’র উদ্যোক্তা মোস্তফা আল মমিন, সামাজিক উদ্যোগ ‘টিম ব্যর্থ’র প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক মুরশিদুল আলম ভূঁঞা ও অনলাইনে শিক্ষা বিস্তারের জন্য মুনজেরিন শহীদের হাতে পদক, সনদ ও অর্থের চেক তুলে দেন সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার, অভিনয়শিল্পী অপি করিম ও স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের অপারেশন ডিরেক্টর হাফিজ সিকান্দার।

‘প্রযুক্তি উদ্যোগ’ ক্যাটাগরিতে পালকি মোটরসের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মোস্তফা আল মমিনের হাতে পুরস্কার তুলে দেন স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের অপারেশন ডিরেক্টর হাফিজ সিকান্দার। এ সময় মঞ্চে ছিলেন বিচারকমণ্ডলীর প্রধান ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার । ঢাকা, ২৭ সেপ্টেম্বর
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

বিজয়ীরা তাঁদের সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া জানান। এ পর্যায়ে অপি করিম বলেন, তরুণদের কাজের স্বীকৃতি জানিয়ে সম্মাননা জানানোর এই আয়োজন তাঁদের যেমন নিজের কাজের প্রতি আরও দায়িত্বশীল করবে, তেমনি অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করবে।

এ পর্যায়ে অনুষ্ঠান উপভোগ্য করে তুলতে গান শোনাতে মঞ্চে আসেন শুভেন্দু দাস ও সানজিদা মাহমুদ নন্দিতা। তাঁরা দ্বৈত কণ্ঠে শোনান, ‘এই যে হেথায় কুঞ্জছায়ায় স্বপ্ন মধুর মোহে’। গানের পরে আবার সম্মাননা জানানোর পালা।

ফুটবলার ঋতুপর্ণা চাকমার হাতে পদক তুলে দেন জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার। এ সময় মঞ্চে ছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। ঢাকা, ২৭ সেপ্টেম্বর
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

রিদ্মিক কি-বোর্ডের উদ্ভাবক মো. শামীম হাসনাত, ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষক সুবীর নকরেক, ‘রোবোটিক হাত’–এর উদ্ভাবক জয় বড়ুয়া লাভলু ও চলচ্চিত্র নির্মাতা রায়হান রাফীর হাতে সম্মাননা পুরস্কার তুলে দিয়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, তরুণ প্রজন্মকে আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত হতে হলে প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। অভিনয়শিল্পী আফজাল হোসেন বলেন, সবাইকে ভালো মানুষ হতে হবে। ওরাকলের কান্ট্রি ম্যানেজিং ডিরেক্টর রুবাবা দৌলা নারীদের উদ্দেশে বলেন, নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে আসতে হবে। প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ তরুণদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথের বাধা দূর করার জন্য গণমাধ্যমের ভূমিকার প্রতি গুরুত্ব দেন।

‘অনলাইন শিক্ষা’ ক্যাটাগরিতে অনলাইন এডুকেশন কনটেন্ট ক্রিয়েটর মুনজেরিন শহীদ সম্মাননা গ্রহণ করেন অভিনয়শিল্পী অপি করিমের হাত থেকে। ঢাকা, ২৭ সেপ্টেম্বর
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

শেষ তিন বিজয়ীকে সম্মানিত করার আগে অনুষ্ঠানে বৈচিত্র্য যোগ করতে ছিল এক ব্যতিক্রমী আয়োজন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই অতিথিদের হাতে দেওয়া হয়েছিল ‘কিউআর কোড’ ছাপা একটি কাগজ। অনুষ্ঠানের সঞ্চালকেরা জানালেন, অতিথিরা তাঁদের সেলফোনের কিউআরকোড স্ক্যানার দিয়ে ওই কোডটি স্ক্যান করলেই তাঁর জীবনের কে সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী, এই প্রশ্ন আসবে। নিজের অনুপ্রেরণাদাতার নাম লিখলে মঞ্চের ডিজিটাল পর্দায় সেই নাম ভেসে উঠবে। অনেকে অনেকের নাম পাঠিয়েছেন। তবে দেখা গেল, সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন ‘মা’।

‘চলচ্চিত্র নির্মাণ’ ক্যাটাগরিতে চলচ্চিত্র নির্মাতা রায়হান রাফীর হাতে সম্মাননা তুলে দেন ওরাকলের কান্ট্রি ম্যানেজিং ডিরেক্টর রুবাবা দৌলা। ঢাকা, ২৭ সেপ্টেম্বর
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

এরপর আবার সম্মাননা জানানোর পালা। মঞ্চে আসেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা আনন্দিত যে এ উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের এসব প্রতিভাবান তরুণকে সম্মানিত করা ও তাঁদের তুলে ধরা সম্ভব হলো। তাঁদের সাফল্য শুধু নিজস্ব জীবনে নয়, সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে এবং পরিবর্তনের বার্তা ছড়িয়ে দেবে। আশা করি, তাঁরা নতুন প্রজন্মকে আরও স্বপ্ন দেখাতে এবং এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করবেন।’

পুরস্কার বিতরণে মতিউর রহমানের সঙ্গে ছিলেন হাবিবুল বাশার। তাঁরা সামাজিক উদ্যোগ ‘মজার স্কুল’–এর প্রতিষ্ঠাতা আরিয়ান আরিফ, কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবক মো. তাসমিনুল হাসান তাওহীদ এবং ফুটবলার ঋতুপর্ণা চাকমার হাতে পদক তুলে দেন। অতিথিদের সঙ্গে বিজয়ীদের ছবি তোলা আর হালকা খাবারের সঙ্গে চা-কফির উষ্ণতায় সমাপ্তির রেখা টানা হয়েছিল অনুপ্রেরণাময় এ আয়োজনের।