শিশু নির্যাতনের ঘটনার ৭৬ শতাংশই যৌন নিপীড়নের

ন্যায়বিচারের পথে বাধা এবং নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারি–বেসরকারি কর্মকৌশলের কথা উঠে এসেছে গবেষণা প্রতিবেদনে।

শিশু নির্যাতনপ্রতীকী ছবি

অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলছিল ছেলে শিশুটি। বৃষ্টি এলে খেলা ছেড়ে শিশুরা একটি বাসায় বসে টেলিভিশন দেখছিল। সেখান থেকে এক ব্যক্তি ওই শিশুকে ডেকে নিয়ে ১০ টাকা ও চকলেট দেন এবং নিজের ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করেন। ঘটনাটি গত বছরের আগস্টের। ঘটনার পরপর ৭ বছরের শিশুটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়। অভিযুক্ত ওই ব্যক্তি এখন কারাগারে আছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নতুন একটি গবেষণার তথ্য বলছে, শুধু ঢাকা মহানগরে যত শিশু নির্যাতনের শিকার হয়, তার প্রায় ৭৬ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার। আর এই শিশুদের মধ্যে ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশু বেশি।

‘শিশু যৌন নির্যাতন: ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে দায়েরকৃত মামলার ওপর একটি গবেষণা’ শীর্ষক ওই গবেষণায় ঢাকা শহরের অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সী স্কুল ও কলেজের ১০০ শিক্ষার্থী এবং ৫০ পথশিশুর ওপর জরিপ চালানো হয়। এতে ২৫টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে।

শিশু আইন-২০১৩ অনুযায়ী ‘অনূর্ধ্ব ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সী সবাই শিশু হিসেবে গণ্য হইবে।’

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের ৯০ জন অর্থাৎ ৬০ শতাংশ শিশু কোনো না কোনো নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ২১ শতাংশ মানসিক নির্যাতন এবং ৩ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এই শিশুরা পরে খাবারে অরুচি, নিদ্রাহীনতা, আত্মগ্লানি, স্বাধীনভাবে চলাচল করতে না পারা, হতাশা, হীনম্মন্যতা, দুশ্চিন্তা, লজ্জা ও ভয়ের মতো মানসিক সমস্যায় ভোগে।

  আপত্তিকর স্পর্শের শিকার বেশি

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তাদের মধ্যে প্রায় ৭৪ শতাংশ শিশু আপত্তিকর স্পর্শের শিকার হয়েছে। প্রায় ৩৪ শতাংশ শিশুকে জোর করে অশ্লীল জিনিস দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, ২৮ শতাংশ শিশুকে যৌনাঙ্গ স্পর্শের মাধ্যমে নির্যাতন করা হয়েছে এবং প্রায় ২৪ শতাংশ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

যৌন নির্যাতনের কারণ ও নির্যাতনকারী কারা

প্রতিবেদনে যৌন নির্যাতনের পেছনে তিনটি কারণকে প্রধান হিসেবে চিহ্নিত করেছে শিশুরা। এগুলো হলো—পুরুষালি মানসিকতা (সেক্স ড্রাইভ) (৫৮ শতাংশ), যৌন আনন্দ (প্রায় ৬০ শতাংশ) এবং শারীরিক সৌন্দর্য (১২ শতাংশ)।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশুরা (৩৯ শতাংশ) অপরিচিত ব্যক্তির হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অনেকে আবার নিকটতম ও দূরসম্পর্কের আত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধু অর্থাৎ পরিচিতজনদের মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। প্রায় ১২ শতাংশ শিশু চাচা–মামার মাধ্যমে, ৬ শতাংশ চাচাতো–মামাতো ভাইয়ের মাধ্যমে, ৯ শতাংশ দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের মাধ্যমে এবং ৪ শতাংশের বেশি শিশু বন্ধুর মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

গবেষণায় নেতৃত্ব দেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক। গত সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পারিবারিকমণ্ডলে শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে শিশু কার সঙ্গে মেশে ও চাকরিজীবী মা–বাবারা কার কাছে সন্তান রেখে যান, সেদিকে নজর দিতে হবে। শিশুর সঙ্গে মা–বাবার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে হবে, যাতে তারা যেকোনো বিষয়ে কথা বলতে সংকোচবোধ না করে।

আরও পড়ুন

নির্যাতনের ঝুঁকিপূর্ণ সময়

ঢাকা মহানগর পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের গত চার বছরের ( ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টম্বর) মামলা থেকে নির্যাতনের ২৫টি ঘটনার অভিযোগপত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দেখা গেছে, ঢাকা শহরে ১৪ থেকে ১৬ বছরের শিশুরা সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে, এ হার ৫৩ শতাংশের বেশি। ২৫টি মামলার মধ্যে ৮টি ধর্ষণের ও বাকিগুলো ধর্ষণচেষ্টা ও শ্লীলতাহানির। ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী শিশুরা একাধিকবার ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সীরা দিন ও রাতের বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনে শিকার হয়েছে। তবে তিন থেকে ছয় বছর বয়সীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সময় বেলা ২টা থেকে বিকেল ৪টা। ৮ থেকে ৯ বছর বয়সীদের জন্য রাত ৮টা থেকে রাত ১২টা ৪০ মিনিট। শিশুরা নির্যাতনের কথাটি প্রধানত মা ও বন্ধুদের জানিয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হুমায়রা পারভীন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বিভাগে এখন ৮০টির মতো মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ২০টির মতো মামলায় ভুক্তভোগী শিশু। দেখা যায়, চাকরিজীবী মা–বাবা কার কাছে সন্তান রেখে যাবেন, সে বিষয়ে ততটা সচেতন নন।

আরও পড়ুন

৬৬ শতাংশই থানায় অভিযোগ করেনি

যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুদের মাত্র ৩৪ শতাংশ থানায় গেছে। প্রধানত সচেতনতার অভাব ও পুলিশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার কারণে ৬৬ শতাংশ পুলিশের সহায়তা চায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া ভুক্তভোগীদের মামলা না করার কারণ হিসেবে ৪৩ শতাংশ ক্ষেত্রে দুর্বল সামাজিক-আর্থিক অবস্থা, ১৭ শতাংশ ক্ষেত্রে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ এবং রাজনৈতিক প্রভাবকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

জরিপে অংশ নেওয়া বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সাক্ষীর অভাব, অপর্যাপ্ত প্রমাণ, মেডিকেল প্রতিবেদন তৈরিতে দেরি ধর্ষণ মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিচারব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ের দুর্নীতিও ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট বাধা।

ডিসি হুমায়রা পারভীনের মতে, পুলিশের প্রতি অনাস্থা নয়, লোকলজ্জা, দীর্ঘ সময় ধরে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে না থাকতে চাওয়ায় বিচার না চাওয়ার ক্ষেত্রে বড় কারণ।

মূল গবেষক অধ্যাপক উমর ফারুক বলেন, শিশু নির্যাতন পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। অনুকূল পরিবেশে পরিপূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে একটি শিশুর বেড়ে ওঠা ও বেঁচে থাকার সুযোগ সমাজ ও রাষ্ট্রকে দিতে হবে।