চট্টগ্রামে ফলের দাম সাধারণের ‘নাগালের বাইরে’
চট্টগ্রাম নগরের শাহ ওয়ালী উল্লাহ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা বোরহান উদ্দিন। সম্প্রতি আক্রান্ত হয়েছিলেন ভাইরাসজনিত জ্বরে। চিকিৎসক তাঁকে কিছু ফল খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সে অনুযায়ী গতকাল শুক্রবার সকালে বহদ্দারহাট বাজারে এসেছিলেন ফল কিনতে। তবে ফলের দাম শুনে হোঁচট খান তিনি।
বোরহান উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গত বুধবার থেকে জ্বর কিছুটা কমলেও শারীরিক দুর্বলতা এখনো আছে। চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছেন প্রচুর পরিমাণে ফলের রস খেতে। তাই মাল্টা কিনতে এসেছেন বাজারে। কিন্তু এক মাস আগেও যে মালটা ২৮০ টাকায় কিনেছিলেন, আজ (শুক্রবার) তাঁকে কিনতে হলো ৩৫০ টাকা কেজি দরে।
গতকাল নগরের ফলের বাজারগুলোয় প্রতি কেজি মাল্টা ৩৫০, কমলা ৩২০, আপেল ২৫০ ও ডালিম ৪৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। অথচ গত জুন মাসের শুরুতে প্রতি কেজি কমলা ছিল ১৫০ টাকা, মাল্টা ছিল ২০০ থেকে ২২০ টাকার মধ্যে। এ ছাড়া ডালিম ও আপেলের দাম মানভেদে বেড়েছে ৮০ টাকার বেশি। গতকাল ভ্যানে প্রতিটি ডাব বিক্রি হয়েছে ন্যূনতম ১০০ টাকায়। অথচ জুন মাসে দেশি এ ফলের প্রতিটি বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৬০ টাকায়।
বাচ্চাদের জন্য কমলা নিতে চেয়েছিলাম। দাম শুনে আর নিইনি। পেয়ারা নিয়েছি এক কেজি। সেটিও ৭০ টাকা দরে।
একদিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছে না, অন্যদিকে বাড়ছে ভাইরাসজনিত জ্বরের রোগী। এতে ফলমূলের চাহিদা বেড়েছে। চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গুতে রোগীর শরীরে প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকার পরিমাণ কমে যায়। এ ক্ষেত্রে মাল্টা, কমলা, ডালিমসহ বিভিন্ন ফলের রস শরীরে অণুচক্রিকার পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে।
তবে দাম বাড়ায় অধিকাংশ ক্রেতাই ফল কিনতে পারছেন না। যাঁরা কিনছেন, তাঁরা পরিমাণে কম কিনছেন। নিম্ন আয়ের ক্রেতারা দেশীয় ফলের বাইরে অন্য কিছু কিনতে পারছেন না।
নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় কমলা ও মাল্টার দাম শুনছিলেন স্কুলশিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান। তবে দাম শুনে আর কেনা হয়নি তাঁর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাচ্চাদের জন্য কমলা নিতে চেয়েছিলাম। দাম শুনে আর নিইনি। পেয়ারা নিয়েছি এক কেজি। সেটিও ৭০ টাকা দরে।’
বেড়েছে আমদানি খরচ
দেশে বর্তমানে মাল্টা, কমলা, ডালিম, আপেলসহ অনেক ফল আমদানি করা হয়। দেশে ডলার-সংকট দেখা দেওয়ায় গত বছরের ২৩ মে ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এতে খরচ বেড়েছে আমদানিতে।
চট্টগ্রামের কদমতলী এলাকার ফল আমদানিকারক মোহাম্মদ ইউনুস প্রথম আলোকে বলেন, শুধু প্রতি কেজি মাল্টাতেই আমদানি খরচ বেড়েছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া ও পর্যাপ্ত ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারার কারণে খরচ বেড়েছে ব্যবসায়ীদের।
ফলমূলকে বিলাসবহুল খাদ্য হিসেবে রূপান্তর করা হয়েছে উল্লেখ করে মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, এ কারণে সাধারণ মানুষ ফল কিনে খেতে পারছে না।
আমদানিকারকদের মতে, দেশীয় উৎপাদন দিয়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। গত বছরের তুলনায় আমদানি কমেছে কমলা, মাল্টা ও ডালিমের। যা আমদানি হচ্ছে, তাতেও খরচ বেশি হচ্ছে। ফলে দাম বাড়ছে। আমদানির তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ফল আমদানি হয়েছিল প্রায় ৮১ কোটি কেজি। অন্যদিকে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ফল আমদানি হয়েছে ৫৮ কোটি ৬০ লাখ কেজি। অর্থাৎ এক বছরে আমদানি কমেছে প্রায় সাড়ে ২৭ শতাংশ।
চট্টগ্রাম ফল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. তৌহিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ার ব্যবসায়ীরা আমদানি করতে পারছেন না। আমদানি কমে যাওয়ায় বাজারে ফলের দাম কমছে না।
পাইকারি-খুচরায় ফারাক বেশি
চট্টগ্রাম নগরের বৃহত্তর ফলের আড়ত কদমতলীর ফলমন্ডি এলাকা। গতকাল এই আড়তে প্রতি কেজি মাল্টা বিক্রি হয়েছে ২৭০ থেকে ৩০০ টাকায়। এ ছাড়া প্রতি কেজি কমলা ২৫০, আপেল ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা এবং ডালিম ২৭০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ খুচরা ও পাইকারিতে দামের পার্থক্য ৫০ থেকে ৭০ টাকা। বিক্রেতাদের ভাষ্য, পরিবহন খরচ বেড়েছে। এ ছাড়া অনেক ফলই পচে যায়। তাই খরচ মেটাতে হিসাব করে দাম নির্ধারণ করা হয়।
নগরে বিভিন্ন এলাকায় ডাবের দাম নিয়ন্ত্রণে এরই মধ্যে অভিযান পরিচালনা করেছে জেলা প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর। এ সময় জানা গেছে, প্রতিটি ডাবের ক্রয়মূল্য ৫০ টাকার আশপাশে। তবে বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার বেশি দামে।
চট্টগ্রাম কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ কৃষিবিপণন কর্মকর্তা শাহ মোহাম্মদ মোর্শেদ কাদের প্রথম আলোকে বলেন, কৃষি বিপণন আইন অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মুনাফা করতে পারবেন। এর বেশি আদায় করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ফলের বাজার তদারকিতে এ ধরনের কিছু পাওয়া গেলে জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।