সুদিনের আশায় দিলারা জামান

দিলারা জামানছবি: প্রথম আলো

১৯৮৫ সালে দেখেছিলাম বিটিভিতে, হুমায়ূন আহমেদের লেখা ধারাবাহিক নাটক এইসব দিনরাত্রি। ৪০ বছর আগে দেখা সেই নাটকের একটা সংলাপ আজও মনে আছে। ‘বউমা, তুমি কেমন মেয়ে বলো তো, রফিকের না হয় বুদ্ধিশুদ্ধি নেই, তুমি তো লেখাপড়া জানা শিক্ষিত মেয়ে, বলা নেই, কওয়া নেই, একটা বেকার ছেলের সঙ্গে হুট করে চলে এলে।’

এই সংলাপ ছিল দিলারা জামানের কণ্ঠে। নাটকে তিনি ছিলেন বুলবুল আহমেদ আর আসাদুজ্জামান নূরের মা। ১৯৪২ সালে জন্ম তাঁর, তার মানে নাটকটি যখন হচ্ছে, তখন তাঁর বয়স ৪৩-এর বেশি নয়। অত অল্প বয়সে বুলবুল আহমেদের মতো মানুষদের মা চরিত্রে কি তাঁকে মানাবে? তাঁর মনে দ্বিধা ছিল। নাটকের প্রযোজক মুস্তাফিজুর বললেন, অভিনয়কুশলতা দিয়ে বয়সের বাধা অতিক্রম করা যাবে। হলোও তা-ই। শফিকরূপী বুলবুল আহমেদের মা, ডলি জহুরের শাশুড়ি, আর লোপার দাদি হিসেবে দর্শক তাঁকে গ্রহণ করল। ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল সেই ধারাবাহিক। দিলারা জামানের চরিত্র ছিল ভীষণ রাগী।

আরও পড়ুন

সেই সব দিনের স্মৃতিচারণা করছিলেন দিলারা জামান। জুলাই ২০২৫-এর শেষ ভাগে একদিন আমরা ভিডিও সাক্ষাৎকার নিতে হাজির হই দিলারা জামানের উত্তরার বাসায়। অনুষ্ঠানের নাম ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো। এই অনুষ্ঠানে দেশের অগ্রগণ্য, পথিকৃৎ ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, জীবনের অভিজ্ঞতার গল্প শোনান বরেণ্য মানুষেরা।

দিলারা জামান বলছিলেন, তখন তিনি শিক্ষকতা করেন ঢাকার শাহীন স্কুলে। একদিন তাঁর এক অল্প বয়সী ছাত্রী তাঁকে জিজ্ঞাসা করে, টিচার, আপনি টুনির সঙ্গে এত রাগারাগি করেন কেন? দিলারা জামানের মনে সেই প্রশ্নটা দাগ কাটে। নাটকের শুটিংয়ে চুপটি করে বসে ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। দিলারা জামান তাঁকে বলেন, ‘হুমায়ূন ভাই, আপনি আমাকে কেমন চরিত্র দিলেন যে আমার ছোট্ট ছাত্রীও আমাকে অভিযুক্ত করে!’ হুমায়ূন আহমেদ উত্তর দেন একটা বাক্যে, তার মানে বুঝতে পারছেন, আপনার অভিনয় সার্থক হয়েছে।’

দিলারা জামানের জন্ম বর্ধমানে। পিতা রফিকউদ্দিন আহমদ ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। বদলি হয়ে গেলেন আসানসোলে। তখন তাঁর বয়স ৪ কি ৫। সেই বয়সের কথাও তাঁর মনে পড়ে। বারান্দায় পাটি বিছিয়ে শুয়ে থাকতেন। বাবা গান গাইতেন, আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই। চাঁদ উঠত। চাঁদের আলোয় আকাশ হয়ে উঠত আগুনরাঙা। তাঁর মা বলতেন, কয়লাখনিতে আগুন লেগেছে।

যশোরে পড়তেন মোমিন গার্লস স্কুলে। ছোটবেলায় দুষ্টুমি করতেন, আম কুড়াতে দৌড়াতেন ঝড়ের দিনে, পেয়ারাগাছে উঠে পড়শির পেয়ারা চুরি করতে গিয়ে ধরাও পড়েছেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় এলেন, নামলেন ফুলবাড়িয়া স্টেশনে। বাংলাবাজার স্কুলে পড়তেই নাটক করতে শুরু করেন। ‘ছুটি’ গল্পে ফটিকের মা হয়েছিলেন। তখন নিউমার্কেট তৈরি হচ্ছে, ধানমন্ডিতে ভীষণ লাল রঙের ধুলা উড়ত। প্রথম টেলিভিশনে নাটক করেন ১৯৬৬ সালে, ত্রিধারা

১৯৬৩ সালে বিয়ে হয়। তখন তিনি ছাত্রী। আর বর হলেন ফখরুজ্জামান চৌধুরী, বাংলা একাডেমির ফেলো। পরিচয় হয়েছিল বাংলা একাডেমিতে নতুন লেখকদের লেখা পড়া আর আলোচনার আসরে। দিলারা জামান সেদিন আসেননি, দিলারার এক লেখার সমালোচনা করেছিলেন ফখরুজ্জামান চৌধুরী। বলেছিলেন, লেখক সিরিয়াস নন। কে এমন কড়া কথা বলল, দেখা করতে গেলেন দিলারা। পরিচয়সূত্র থেকে ভালো লাগা। দিলারা জামানের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, তখন তিনি চিঠি লিখলেন, তোমার বন্দিনী রাজকন্যাকে উদ্ধার করো। এক বস্ত্রে বের হয়ে গিয়েছিলেন দিলারা। সরদার জয়েনউদ্দীন আর জিয়া হায়দার, দুই বিখ্যাত সাহিত্যিকব্যক্তিত্ব বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন।

৫১ বছরের বিবাহিত জীবনের পর ২০১৪ সালে ফখরুজ্জামান চৌধুরী পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তাঁদের দুই মেয়ে বিদেশে থাকেন। ছেলে আশিক আশফাক তাঁর সঙ্গে উত্তরার বাসায় থাকেন।

দিলারা জামান বিদেশে গিয়েছিলেন মেয়েদের কাছে। মন টেকে না। ফিরে এসেছেন দেশে। নাটকের ছেলেমেয়েদেরই নিজের ছেলেমেয়ে মনে করেন। বলেন, ‘বিদেশে থাকলে বোঝা যায়, দেশ কী। আমাদের একটা পতাকা আছে, দেশ আছে, সে যে কত বড় ব্যাপার।’ তবে তিনি আগেকার দিনের টেলিভিশন নাটকের পারিবারিক গল্পগুলোর অভাব আজকের দিনে ভীষণ অনুভব করেন। বলেন, ‘ওই সব নাটক আমাদের পারিবারিক বন্ধনকে শক্ত করতে উদ্বুদ্ধ করত। এখন যে সবাই বড় বেশি একা হয়ে যাচ্ছে।’

দেশ নিয়ে ভীষণ আশাবাদী দিলারা জামান বলেন, ‘আমাদের তরুণদের মধ্যে যে প্রতিভা, যে আশ্চর্য একটা ক্ষমতা, তারা আছে, তারা সত্যকে বেছে নেবেই এবং সত্যের দিকে এগিয়ে যাবে। এবং আমরা এখন ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। একমাত্র আশা যে ওরা আমাদের জন্য সুন্দর দিন আনবে। আমরা আসলে...অত কিছু চাই না। সবাই যেন দুই বেলা খেতে পারে সুন্দরভাবে, ন্যায়বিচার পায়, তাদের জীবনের নিরাপত্তাটা থাকে। আমি নিশ্চিত যে সেসব সুন্দর দিন আমাদের আসবে এবং আমি সেটা দেখেই মরতে চাই।’

দিলারা জামান দীর্ঘজীবী হোন, আরও বহুদিন আমাদের মধ্যে থেকে সৌন্দর্য ও শিল্পের সাধনা করতে থাকুন। দেশ, দেশের মানুষ ও সমাজ আরেকটু সুন্দর হোক।

  • আনিসুল হক, কথাসাহিত্যিকসাংবাদিক