সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি প্রথম আলোর আয়োজনে ক্রাউন সিমেন্ট ‘অভিজ্ঞতার আলো’ শীর্ষক বিশেষ সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে। এ অনুষ্ঠানে আমরা বাংলাদেশের প্রাজ্ঞজন, বাংলাদেশের পথিকৃৎ ব্যক্তিদের কাছে যাই এবং তাঁদের কথা শুনি, জীবনের অভিজ্ঞতা শুনি, যাতে আমরা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁদের এই অভিজ্ঞতার আলো রেখে যেতে পারি। আপনারা শুনে খুশি হবেন যে আমরা এসেছি (২০ জুলাই, ২০২৫) বিখ্যাত এবং আমাদের খুবই প্রিয় একজন ব্যক্তিত্বের কাছে, যিনি চলচ্চিত্র-টেলিভিশন-মঞ্চ সব জায়গায় অভিনয় করেছেন। আবার তাঁকে শিক্ষা-ব্যক্তিত্ব বলা যাবে; কারণ তিনি শিক্ষক ছিলেন। আমাদের খুবই প্রিয় ব্যক্তিত্ব-‘টেলিভিশনের মা’ হিসেবে যিনি বেশি খ্যাতিমান। আমরা এসেছি একুশে পদকপ্রাপ্ত ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত দিলারা জামানের কাছে। দিলারা আপা, আপনাকে প্রথম আলোর এই বিশেষ অনুষ্ঠানে স্বাগত জানাই। আপনি কেমন আছেন?
দিলারা জামান: এ মুহূর্তে অনেক ভালো আছি। এত আলো ঝলমলে সবকিছু! যেটা সব সময় চাই কিন্তু সেটা তো সম্ভব না; পাইও না। এ মুহূর্তটা আমার কাছে অনেক ভালো ও অনেক আনন্দের।
আপনাকে ধন্যবাদ এই আনন্দ প্রকাশ করার জন্য। আমরা জানি যে আপনি ১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন। সে ক্ষেত্রে আপনার বয়স ৮৩ পূর্ণ হয়েছে। আর আপনার জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত ভারতের বর্ধমানে।
দিলারা জামান: বর্ধমান। বাবার চাকরিস্থল ছিল। বাবা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। এখনকার যে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস সেটা না। তখন ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল ছিল...আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। সেখান থেকে পাস করে আব্বা ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিলেন এবং বর্ধমানে তাঁর প্রথম পোস্টিং হয়।
তার মানে কি এটা কি ঢাকার আহসানউল্লাহ, যেটা পরে বুয়েট হলো, সেটাই?
দিলারা জামান: সেটাই।
তাঁর বাড়ি কি আসলে যশোর এলাকাতেই ছিল?
দিলারা জামান: না। আমাদের দেশের বাড়ি সবকিছু হলো নোয়াখালীতে এবং খুব কনজারভেটিভ পরিবারে। আমার দাদা তাঁর ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। আমার আব্বাকে ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছেন। আমার দুই জ্যাঠা শিক্ষক ছিলেন। আমার ছোট জ্যাঠা পণ্ডিত ছিলেন—নাসিরউদ্দিন পণ্ডিত। নাসির পণ্ডিত ডাকা হতো তাঁকে। এ রকম আরকি! পরিবারটা খুবই শিক্ষিত, যার জন্য আমি নিজে খুব গর্ববোধ করি।
আপনার আব্বার নাম কী?
দিলারা জামান: রফিকউদ্দিন আহমেদ।
তারপর আপনার বর্ধমানে জন্ম হলো। আপনার আব্বার বদলির চাকরি, তাই সেখান থেকে আসানসোলে গেলেন। তখন আপনার বয়স কত?
দিলারা জামান: তখন আমি খুব ছোট—চার কি পাঁচ বছর বয়স। পরে বইতে পড়েছিলাম যে আসানসোল আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের জন্মস্থান। তখন তো এ রকম ইলেকট্রিসিটি ছিল না। সন্ধ্যায় ভাত খেয়েই আমরা বারান্দায় যেতাম। বারান্দাটা ছিল টালির, আর সেখানে পাটি বিছিয়ে আমরা শুয়ে থাকতাম। আকাশে চাঁদ উঠত। আব্বা কাজ থেকে ফিরে আসতেন। তাঁর গলা ছিল খুব সুন্দর। আব্বা প্রায়ই গান গাইতেন--‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’। আর গল্প হতো...অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ পেছনের আকাশটা একদম লাল হয়ে যেত, আম্মা বলতেন, হেই কয়লাখনিতে আগুন লেগেছে, কয়লাখনিতে আগুন লেগেছে। পরে জানলাম যে ওখানে কয়লাখনি আছে... তখন নিজেকে খুব গর্বিত মনে হলো যে আমি নজরুল ইসলামের সেই জায়গায় ছিলাম।
তারপরে আপনারা চলে এলেন। ’৪৭–এর পরে যশোরে।
দিলারা জামান: ’৪৭–এ দেশ ভাগ হলো। পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান হয়ে গেল।
ওই স্মৃতি তো আপনার থাকার কথা না।
দিলারা জামান: না, তবু আছে। কিছু কিছু আছে। পাঁচ বছর বয়সে আমার মনে আছে যখন হাওড়া ব্রিজে... খুব রায়ট হয়েছিল, হ্যাঁ কাটাকাটি, হিন্দু–মুসলমানে। তো যখন হাওড়া ব্রিজ দিয়ে যাচ্ছিলাম, আমার মনে আছে তখন ট্রেনের জানালাগুলো ছিল কাঠের, খড়খড়ি দেওয়া। সেগুলো এমনি করে তুলে আবার এভাবে ফাঁক করে রাখা যেত, পুরোপুরি খোলা যেত না। তখন আম্মা-আব্বা তাড়াতাড়ি জানালার খড়খড়িগুলো নামিয়ে দিলেন।
ওটা যেন দেখতে না হয়...
দিলারা জামান: হ্যাঁ! দেখতে না হয়, বীভৎসতা দেখতে না পাই। আমি আর আমার ছোট ভাই কামাল। ও তখন হয়তো আড়াই বছর বয়সের হবে। ওই বিষয়টা মনে আছে যে আমি বাইরে দেখতে চাচ্ছি। ট্রেনে করে যাচ্ছি— একটা নতুন অভিজ্ঞতা। কিন্তু ওই যে দেখতে পেলাম না; সেই কষ্টটা রয়ে গেল। পরে বড় হয়ে আম্মার মুখে শুনেছি যে এ কারণে জানালা নামিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে দেখতে না হয়।
যশোরে এসে যশোরেই কি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হলেন।
দিলারা জামান: ভর্তি হলাম মোমেন গার্ডেন স্কুলে। হেঁটে হেঁটে যেতাম সেই স্কুলে। পরে বহু বছর পরে আমি আমার সে পুরোনো জায়গায় গিয়েছিলাম। আমার একটা বায়োগ্রাফি করবে ওরা, ওখানে শুটিংয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমার পুরোনো বাসাটা খুঁজতে গিয়েছিলাম…কিন্তু আর চিনতে পারলাম না। ষষ্ঠিতলা পাড়ায় থাকতাম। ছোটবেলায় ট্রেনের হুইসেল শুনলেই দৌড়ে চলে যেতাম স্টেশনে। মাত্র এক-দুই মিনিট লাগত পৌঁছাতে। দাঁড়িয়ে থাকতাম, ট্রেনটা চলে যেত, আর বাতাসে আমার ফ্রক উড়ত। সেই স্মৃতিগুলো এখনো মনকে আন্দোলিত করে।
তো ষষ্ঠিতলা পাড়ায় আমি আমার সেই বাড়িটা খুঁজছিলাম। আমাদের বাসার সামনে দুটো নারকেলগাছ ছিল। কিন্তু সেই বাসা আর খুঁজে পেলাম না। খুঁজতে খুঁজতে আমি বললাম, এখানেই তো বিখ্যাত পরমাণুবিজ্ঞানী ড. শমশের আলী আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। আমি আর তাঁর ভাই ঝড় আসতে দেখলেই দৌড়ে যেতাম আম কুড়াতে। একদিন এমনই যাচ্ছি, উনি তো ছোটবেলা থেকেই খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলেন, হঠাৎ বললেন, ‘এই লিলি (আমার ডাকনাম লিলি), কী জন্য এসেছ? দুষ্টু মেয়ে! পড়াশোনা নেই? আম কুড়াতে যাওয়া, তাই না?’
তাঁদের তখন বাড়ি থেকে ধান আসত, চাল আসত। সেই গরুর গাড়িটা ছিল। তিনি বললেন, চাকার সঙ্গে বেঁধে রাখব কিন্তু। অনেক বছর পরে আমার ওসব কথা মনেটনে নেই, একটা অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি হয়েছিলেন, আমি ওখানে গিয়েছি। তিনি বক্তৃতায় বলছেন, আজকে যে বিখ্যাত মহিলাটি এখানে বসে আছেন আমার পাশে, তাঁকে একদিন আমি ছোটবেলায় বকা দিয়েছিলাম। আমি তাকিয়ে আছি। ওর ডাকনাম লিলি এবং সে খুব দুষ্টু ছিল, পেয়ারাগাছে উঠত, ঝড় এলে আম কুড়ানোর জন্য দৌড়ে চলে যেত আমার ছোট ভাই তোতাকে নিয়ে।
আমি অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি…আমার যে কী ভালো লাগছিল তখন। সেসব স্মৃতি মনে পড়ে। আমি খুবই দুষ্টু ছিলাম। আমাকে গাছে উঠিয়ে দিত পেয়ারা পাড়ার জন্য। একদিন আমি পেয়ারা পেড়ে কোঁচড়ে নিচ্ছি। আর দূরে থেকে গাছের মালিক বলছেন, কে রে বাগানে? আর নিচে যারা ছিল, আমার সব ছেলে বন্ধুটন্ধু সব দৌড়ে পালিয়েছে। আমি তো আর নামতে পারি না গাছ থেকে। তিনি এসে বললেন, এই মেয়ে, নামো, নামো। তারপর আমি নেমে এসেছি। আমাকে ধরে ওই কোঁচড়ে পেয়ারাসহ নিয়ে সোজা আমাদের বাসায় চলে এল। এসে বলছিলেন, এই যে রফিক সাহেবের ওয়াইফ, আসেন, বাইরে আসেন। এই মেয়ে যদি গাছে থেকে পড়ে হাত-পা ভাঙত তাহলে কী হতো, ওকে আর বিয়ে দিতে পারতেন? আর আমি দোষী হতাম। আমি তখন মানেটা অত গুরুত্ব দিয়ে বুঝিনি। এখন মনে হয়—কত সুন্দর ছিল আমাদের সেই ছেলেবেলা। এখন যখন বাচ্চাদের দেখি সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে। একটু মাঠ নেই খেলার। আকাশ নেই। কখন মেঘ জমে, কখন আতাগাছটায় আস্তে আস্তে সবুজ আতাফলটার ভেতরে একটু একটু করে মৌ জমতে জমতে মিষ্টি আতা হয়, সেই দিনগুলো জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। আর মাঝেমধ্যে খুব কান্না পায়, যদি ওই জীবনগুলো আবার ফিরে পেতাম।
আতা ফুলের একটা খুব সুন্দর গন্ধ আছে।
দিলারা জামান: আতা ফলের, হ্যাঁ।
ফুলেরও গন্ধটা খুব সুন্দর।
দিলারা জামান: হ্যাঁ, ফুলের গন্ধও। আমাদের বাসায় এ রকম একটা আতাগাছ ছিল। আমি তাকিয়ে থাকতাম। আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে আতাটা। আর এত বড় বড় আতা। এখন কিন্তু দেখা যায় না অত বড় আতা… তো সেই আতার স্বাদটা এখনো যেন মুখে লেগে আছে।
তারপরে আপনারা ঢাকায় এলেন। আপনি যে বাংলাবাজার স্কুলে পড়লেন, সেটা কত সালে?
দিলারা জামান: ১৯৫৪ সালে প্রথম ঢাকায় এলাম। ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে ঘোড়ার গাড়িতে করে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছালাম। আমরা পলাশীতে গভর্নমেন্ট কোয়ার্টারে থাকতাম—ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আর ইউনিভার্সিটির পাশে। সেখানে আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন আসমা আহমেদ (পরে টেলিভিশনের সংবাদপাঠিকা)। তাঁর বাবা ইনাম আহমেদ, যিনি সে সময় (পাকিস্তান আমলে) প্রায় সব ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করতেন—ডাকাত–টাকাত এসব চরিত্র।
আর যখন ঢাকায় এলাম, তখন প্রথম ওই নিউমার্কেটটা তৈরি হচ্ছে। হেঁটে হেঁটে যেতাম নিউমার্কেটে। দেখতাম কী বিরাট গেট হয়েছে! সেই গেট তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। এখন অবাক লাগে যে সেই ঢাকা…
নিউমার্কেটের পেছনে ছিল আজিমপুর। না, আসলে পেছনে ছিল ধানমন্ডি; তখনও মাটির রাস্তা। আমাদের একজন ছাত্রী ওই দিকে থাকত। এখন হয়তো ওটা এক নম্বর বা দুই নম্বর রোড হবে। মনে আছে, নিউমার্কেটের পাশ দিয়ে যখন আমাদের বাসটা যেত তাকে তুলতে, তখন আমরা সবাই বাসের জানালা তুলে দিতাম। কারণ মাটি উড়ে এসে ভেতরে ঢুকত; লাল মাটির ধুলো।
সেই নিউমার্কেট আর আশপাশের এখনকার অবস্থা দেখলে মনে হয়, সেই ’৫৪ সালের ঢাকা আর এখনকার ঢাকা! ওখান থেকে বাস আসত সকালবেলায়। আমাদের সকালে বাসে করে নিয়ে যেত স্কুলে। স্কুলে যেতাম আবার বিকেলে ফিরতাম।
পলাশী থেকে এই বাংলাবাজারের কাছে যে বাংলাবাজার স্কুল সেখানে যেতেন?
দিলারা জামান: হ্যাঁ, সেখান থেকে ম্যাট্রিক পাস করলাম ’৫৮ সালে। আমার সঙ্গের অনেকে পরবর্তী জীবনে অনেক নামী মানুষ হয়েছেন। ফেরদৌসী রহমান ছিলেন আমাদের স্কুলে, তারপরে কাজী ইদ্রিসের তিনটা মেয়ে পড়ত, কাজী মদিনাদের তিন বোন, এদের সেখানে পেয়েছি। এ রকম অনেকেই ছিল ওই স্কুল থেকে পাস করেছে। মিসেস নন্দী আমাদের হেডমিস্ট্রেস ছিলেন। তারপরে লুৎফুন্নেসা...তো এসব বিখ্যাত মানুষের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি। সে জন্য নিজেকে অনেক গর্বিত মনে হয়।
আর প্রথম মঞ্চে নাটক করলেন নুরুল মোমেনের পরিচালনায়, এটা মনে আছে?
দিলারা জামান: সেটা ইডেন কলেজে যখন পড়ি তখন। তার আগে স্কুলে ওই যে ম্যাট্রিকের ফেয়ারওয়েলের সময় নাটক করা হতো। নাটক, গানটান দিয়ে একটা অনুষ্ঠান করা হতো মেয়েদের ফেয়ারওয়েল দেওয়ার জন্য। আমি তখন নাইনে পড়ি। তখন শরৎচন্দ্রের একটা গল্প ছিল আমাদের বইতে—‘মামলার ফল’। ওই গল্পটাকে একটা নাট্যরূপের মতো দিয়ে ওটাকেও আমরা মঞ্চস্থ করি। ওখানে ফটিকের মামি হয়েছিলাম আমি।
ফটিকের মামি তো ‘ছুটি’ গল্পে। ‘মামলার ফল’ নিশ্চয় আরেকটা গল্প?
দিলারা জামান: ‘মামলার ফল’ আরেকটা গল্প। তবে আমার মনে আছে আমি একটা দজ্জাল মহিলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম।
তাহলে এটা ‘ছুটি’, রবীন্দ্রনাথের।
দিলারা জামান: হ্যাঁ, মঞ্চে উঠে (অভিনয় করেছিলাম)। এখন মনে হয় যে ওটা কোনো অভিনয় হয়নি, কিচ্ছুই হয়নি, গড়গড় করে সংলাপগুলো বলে নেমে এসেছি। কিন্তু সবাই বলছে, না অনেক ভালো করেছে। দিলারা অনেক ভালো করেছে। এই যে মনের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস হলো…
তখন কিন্তু মেকআপের জন্য এত সুন্দর কিছু পাওয়া যেত না। ওই শাঁখারী বাজার থেকে চকের গুঁড়া আর সিঁদুর এনে সেটা মেখে মুখটা সুন্দর করে সাজানো হতো। ও রকম করে আমাকে সাজিয়েছে। তো আমি ওই সাজ নিয়ে যখন গাড়িতে করে বাসায় ফিরছিলাম, তখন সারাক্ষণ মুখটা এভাবে জানালা দিয়ে বাইরে বের করে রেখেছিলাম। সবাই দেখুক যে আমি কিছু একটা করেছি। ওই কথা মনে হলে এখনো নিজে নিজে খুব হাসি যে সেই সময় কী রকম ছিল অবস্থা। আর আজকে তো কত আধুনিক সময় একদম চেহারাই বদলে দেয় মেকআপ দিয়ে। তারপরে একজনকে হয়তো চেনাই যায় না। তার গেটআপ সব চেঞ্জ হয়ে যায় এই মেকআপের কল্যাণে।
আপনি ‘মায়াবী প্রহর’ নামে আলাউদ্দিন আজাদের লেখা একটা নাটক করেছিলেন। মনে আছে এটার নাম।
দিলারা জামান: মায়াবী প্রহর। হ্যাঁ, মনে আছে।
আরেকটা নাটক করেছিলেন ‘ত্রিধারা’।
দিলারা জামান: হ্যাঁ, ত্রিধারা।
‘ত্রিধারা’ মনে হয় টেলিভিশনে প্রথম করেন ১৯৬৬ সালে।
দিলারা জামান: ’৬৬ সালে। ওটাই প্রথম নাটক। আর তখন নাটক কিন্তু একদম ডাইরেক্ট টেলিকাস্ট হতো। সরাসরি মঞ্চের মতো। আর সবচেয়ে কষ্টের ছিল ক্যামেরা ফিক্স করা, দুটো ক্যামেরা ফিক্সড করা থাকত। আমাকে মনে রাখতে হবে যে আমি এক হাত এদিকে যাব বা এক হাত পেছনে আসব। এই এক হাত যদি একটু ওদিকে চলে যাই, বা এক বিঘত চলে যাই; তাহলে আউট অব ক্যামেরা। এটা মনে রেখে, আবার সংলাপগুলো ...মাথায় রাখার মতো, অনেক দিন ধরে রিহার্সেল হতো মঞ্চনাটকের মতো। আমি মঞ্চে কাজ করেছি, তাই এখনো মনে হয়—কেন স্ক্রিপ্ট দেয় না? আমি দেখব, সেটা আমার গ্রিপে থাকবে। কিন্তু এগুলো তো এখন চলে গেছে। তাই এসবের সঙ্গে নিজেকে খুব মানিয়ে নিতে পারি না আর।
আপনার জীবনী যেটা ইন্টারনেটে পড়লাম তাতে দেখা যাচ্ছে আপনি আমাদের ফখরুজ্জামান ভাই—ফখরুজ্জামান চৌধুরী—তাঁর সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন ১৯৬৩ সালে।
দিলারা জামান: পালিয়ে ঠিক না আসলে। উনি তো তখন বাংলা একাডেমির রিসার্চ ফেলো ছিলেন। আর আমাদের পরিবারে আমিই প্রথম (নারী) ম্যাট্রিক পাস করি। আব্বা–আম্মা সব সময় চাইতেন যে আমি আরও পড়াশোনা চালিয়ে যাই…
আমার আম্মার তো মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেছে, অত ভালো জামাই পেয়েছে। উনি বলেন যে আমি পুকুরে সাঁতার কাটছিলাম। অমনি ধরে নিয়ে এসে আমাকে বসিয়ে দিল বিয়ের পিঁড়িতে...
আপনার মায়ের কথা হচ্ছে।
দিলারা জামান: হ্যাঁ। উনি যেহেতু নাবালিকা ছিলেন সেহেতু তাঁর চাচা বোধ হয় ওই ...কবুলটা বলেছেন। তার দুই বছর পরে তিনি যখন একটু সাবালিকা হলেন, তখন আব্বা তাঁর কর্মস্থল নিয়ে গেলেন। আব্বার সঙ্গে আম্মার প্রায় ১২-১৩ বছরের বয়সের ডিফারেন্স। আর আম্মার ক্লাস ফাইভে উঠেই বিয়ে হয়ে গেছে তো, তাই তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল যে তাঁর মেয়ে উচ্চশিক্ষিত হবে। তাঁর জীবনে যেসব স্বপ্ন ছিল সেগুলো পূরণ করা আরকি। সে জন্য সব সময় চাইতেন। আমার যত বিয়ের প্রস্তাব আসত, তিনি বলতেন—না, ও আগে এমএ পাস করবে, ইউনিভার্সিটিতে পড়বে, তারপর বিয়ে হবে। এর মধ্যে সব বিয়েটিয়ের (আলাপ) আসছে। তখন আমার পরিচয় হলো ফখরুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে। তখন আমাদের কিন্তু আমরা আমি একটু লেখালেখি করতাম। তো আমরা মাসে-দুই মাসে হয়তো একবার কারও বাসায় বা বাংলা একাডেমির ওই বটতলায়... মাটির মধ্যে বসে আমরা যার যার লেখা—কবিতা বা গল্প—পড়তাম। আর একজন তা সমালোচনা করত। একবার এভাবে আমি পড়ে ফিরে এলাম; আম্মা তখন অসুস্থ ছিলেন। তিনি (ফখরুজ্জামান চৌধুরী) আমার লেখা পড়ে সমালোচনা করলেন, বলতে চাইলেন লেখিকা লেখার প্রতি উদাসীন। পরের দিন আমি শুনে খুব রেগে গিয়েছিলাম—হ্যাঁ, একটি লেখা দিয়ে কি একজনকে বিচার করা যায়? আমি ভাবলাম, কে সেই লোক, দেখব আমি! আমি পরে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হলো।
কিন্তু আমার আব্বা–আম্মা... মাত্র ২৫০ টাকা স্কলারশিপ পায় এই ছেলে কী করে আমার মেয়েকে…তাঁরা রাজি ছিলেন না। পরে একবার আমার খুব ভালো একটা বিয়ের সম্বন্ধ এল। তখন আমি ওনাকে (ফখরুজ্জামান চৌধুরী) জানালাম। তখন তো আর ফোনও ছিল না। আমার ছোট ভাইকে দিয়ে চিঠি লিখে জানালাম। তোমার রাজকন্যা বন্দী, তুমি এসে উদ্ধার করো। পরে উনি বললেন, চলে আসো। পরে জিয়া হায়দারের বাসায়... আমি একদম একটি কাপড় পরে ঘর থেকে বের হয়ে ওপরে থেকে নিচে নেমে এলাম।
এটা ১৯৬৬ সালে?
দিলারা জামান: না, ’৬৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তখন ৪ ফাল্গুন বোধ হয় দিনটা ছিল। বাসায় কেউ বুঝতে পারেনি যে আমি চলে যাচ্ছি। জাস্ট আমি ওপর থেকে নিচে নামছি, তো ওইভাবেই চলে এলাম, আমার ছোট ভাই কামালকে নিয়ে। আর সেই আমাদের বিয়েতে মামা হলেন সরদার জয়েনউদ্দীন, বাংলা একাডেমিতে ছিলেন তখন। তিনি আমাদের বিয়েতে আমার মামা হয়েছিলেন। দুজন সাক্ষী লাগে তো। তারপরে জিয়া হায়দার একজন সাক্ষী হলো। পরে আমার আবার নিজের মামা বাংলা একাডেমিতে ছিলেন, লুৎফুল হায়দার চৌধুরী... আমার মায়ের কাজিন হয়। হয়তো উনি পরে শোনেন যে জয়েনউদ্দীন চাচা বলছেন, আজকে একটা বিখ্যাত বিয়ে হলো। দুজন বিখ্যাত লেখক–লেখিকা। তো মামা বলছেন, কাদের? বললেন যে, (তখন আমার নাম ছিল দিলারা আহমেদ) দিলারা আহমেদ আর ফখরুজ্জামান চৌধুরী, যে আমাদের এখানে রিসার্চ ফেলো। তাঁর চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। উনি অফিস শেষ করেই পাঁচটার সময় আমাদের বাসায় গিয়ে... ততক্ষণ আম্মা মনে করেছেন যে, আমি ইউনিভার্সিটিতে গেছি, ফিরে আসব বিকেলে। কিন্তু এর মধ্যে যে এই কাণ্ড হয়েছে, ওটা বুঝতে পারেননি। পরে (মামা) বলছেন যে, আমি মামা, আমি পারতাম না সাক্ষী হতে? কেন বাইরের লোক? পরে মেনে-টেনে নিয়েছেন আরকি সবকিছু। দেখেছে এত ভালো ছেলে, ব্যবহার...সবকিছু...বিদ্বান ছেলে, এই আরকি!
হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘এইসব দিনরাত্রি’–তে আপনি একজন রাগী মা হলেন। সেসব দিনের কথা মনে আছে? হুমায়ূন আহমেদের কথা মনে আছে?
দিলারা জামান: মনে আছে। হুমায়ুন ভাই যখন বলছেন যে এই কাজটা আনলাম...আমার তখন বয়স তো আরও কম।
হ্যাঁ, কম। অনেক কম।
দিলারা জামান: আমার ছেলে হলেন বুলবুল আহমেদ, তারপরে আসাদুজ্জামান নূর এরা। তখন আমি বলছিলাম, দর্শক আমাকে গ্রহণ করবে না! তখন বলা হলো, ‘আপনার অভিনয় দিয়েই হবে।’ পরে দেখলাম, সেই ধারাবাহিকটা খুবই জনপ্রিয় হলো। আরও অনেক পরে, যখন বুলবুল ভাই একটা নাটকে আমার স্বামী হলেন, আমি মজা করে বলতাম, ‘বুলবুল ভাই, তো আপনি আমার ছেলে হয়েছিলেন।’ আর (উনি) ফরসা মানুষ, লাল হয়ে যেতেন লজ্জায়। এইসব দিনরাত্রির একটা ঘটনা মনে আছে। আমি তখন স্কুলে পড়াই, শাহীন স্কুলে। আমি বারান্দা দিয়ে যাচ্ছি। একটা ছোট্ট মেয়ে আমাকে বলছে, ম্যাডাম, আপনি টুনিকে এত বকেন কেন, হ্যাঁ? আমার না এত খারাপ লেগেছে! আমি তার পরের দিন… আবার রিহার্সাল হতো তো তিন–চার দিন ধরে… রিহার্সালে এসেই প্রথমে আমি দেখি হুমায়ূন ভাই...। তিনি চুপচাপ বসে থাকতেন, কথা বলতেন না...আমি বললাম, হুমায়ূন ভাই, আপনি আমাকে এমন একটা চরিত্র দিয়েছেন যে আমার ছাত্রী এতটুকু বোঝে না, সে পর্যন্ত আমাকে একুইজ করে।
আর তখন সবচেয়ে ভালো লাগত...পরের দিন রাস্তায় বের হলে ওই নাটকের সংলাপ দোকানের লোক বলছে, রিকশার লোক বলছে...। তারপরে উনি (হুমায়ূন আহমেদ) চুপ করে থেকে বললেন, তাহলে আপনি যে সার্থক এটা বুঝতে পারছেন? খালি এই কথাটা বললেন। আমি তখন বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম, ক্যারেক্টারটা লোকে নিয়েছে ওইভাবে। তো সেই কথাগুলো মনে হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁর আরও অনেক কাজ করেছি। ‘অয়োময়’ করেছি, সেটাও আমার জীবনে একটা শ্রেষ্ঠ পাওয়া। কারণ এমন একটা চরিত্র; তার কোনো মুভমেন্ট নেই, বিছানার মধ্যে আছে, চোখে দেখতে পায় না, কিন্তু তার অনুভূতি খুবই প্রখর। কে যাচ্ছে, কে কী করছে, সে সব বুঝতে পারে। এবং সব জমিদারি শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমার ছেলের (জমিদার) সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। তিনি আবার সেগুলো রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, অয়োময়ের সেই ‘মির্জার মা’।
পরে যখন গ্রামে যেতাম কাজ করতে তখন মানুষ জিজ্ঞেস করত, ‘আপনি মির্জার মা না?’ এখনো সেই ‘মির্জার মা’ হয়ে আছি মানুষের মনে… ‘টুনির দাদি’, সেই টুনিও (লোপা) মারা গেছে। ওটাও আমার জন্য একটা অনেক বড় কষ্টের ব্যাপার ছিল, ওটা নেওয়া। অনেককেই হারিয়েছি।
টুনি মারা গেছে তো নাটকের ভেতরে।
দিলারা জামান: নাটকে মারা গেছে এবং পরবর্তী সময়েও।
লোপা মারা গেছে?
দিলারা জামান: লোপা মারা গেছে এবং তার মৃত্যুটা অস্বাভাবিক ছিল।
হুম.. দুঃখের বিষয়!
দিলারা জামান: আসলে খুবই কষ্ট লেগেছে, ও মারা গেছে। তারপরে ইয়ে মারা গেছে অসুস্থ হয়ে, ওই যে অপুর সঙ্গে যার বিয়ে হওয়ার কথা।
আমাদের খালেদ খান, যুবরাজ ভাই।
দিলারা জামান: হ্যাঁ, খালেদ খান, এরা। তো এই সব শিল্পীকে অসময়ে আমরা হারালাম।
হ্যাঁ, এই শিল্পীদের অনেকেই তো নেই। বুলবুল আহমেদ নেই, মেহফুজ ভাই নেই।
দিলারা জামান: আসলে খুব মনে হয় যে যাদের সঙ্গে... সহযাত্রী যারা ছিল, যোদ্ধা আমি বলি আরকি এদেরকে। কারণ আমাদের সময় কাজ করাটা খুবই কষ্টের ছিল। চারদিকে মানে বিশেষ করে আমার সময়ে যে একটা মুসলমান মেয়ে এভাবে নাটক করছে... নাটককে এখন যেমন এটাকে পেশা হিসেবে নিয়েছে বা এত সম্মানের, এত আনন্দের, এত গর্বের তখন এটা ছিল না। আমার মনে আছে, চিটাগংয়ে আমি যখন কাজ করতাম, তখন টেলিভিশন ছিল না। রেডিও নাটকও আমাকে ডাইরেক্ট করতে হতো। কাজ শেষ করে আসতে আসতে ১১টা বাজত, যখন রেডিওর গাড়িটা আমাকে নামিয়ে দিত। তো দেখতাম যে ওপর থেকে জানালাগুলো আস্তে খুলে যাচ্ছে, ভাবছে যে কোথা থেকে আসল এত রাত্রে, কী কাজ করে, এইগুলো যুদ্ধ করে করে তারপর...।
নাটক আপনাদের সময় একটা যুদ্ধই ছিল। সে জন্য বলছেন যে সহযোদ্ধা।
দিলারা জামান: মনে হয় যে পরিবারকেও বঞ্চিত করেছি। এত সিস্টেমেটিক ছিল না তো, কাজ শেষ করতে করতে রাত দুইটা–তিনটা–চারটা হয়ে গেছে, বাসায় ফিরেছি, আজান দিয়ে দিয়েছে। গোসল করে একটু শুয়েছি। তারপরে তিনি (দিলারা জামানের স্বামী) বলেছেন যে, স্কুলে যাবে না? সাতটা বেজে গেছে। উঠে আবার স্কুলে গেছি। শুটিংয়ে যাব আবার ওখান থেকে, কাপড়টাপড়গুলো সব গাড়ির পেছনে নিয়ে গেছি।
আমি প্রায়ই আমার সাক্ষাৎকারে বলি যে আমার বাচ্চাদের আমি অনেক বঞ্চিত করেছি। তখন তো মোবাইল ছিল না। যেখানে গেছি কাজ করতে, ওল্ড টাউনে গেছি, ফোন নেই। তারপরে হয়তো এত মানুষের ভিড় যে কাজ শুরু করতে পারিনি। এই রাতে ৯টা-১০টা বেজেছে, সব লোকজন চলে গেছে, তারপর হয়তো কাজ শুরু হয়েছে। আর যাদের বাসায় কাজ করতে গেছি...প্রথমে তো খুব উৎসাহ নিয়ে, আনন্দ নিয়ে ডাকে। হ্যাঁ, আমার বাসায় করেন। তারপরে মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে যায়। কারণ, তারা একঘরে কোণঠাসা হয়ে আছে আর বাড়িঘর আমরা দখল করে আছি।
কোনো বাড়িতে শুটিং হলে ওই বাড়ি মোটামুটি ঘূর্ণিঝড়ের মতো লন্ডভন্ড হয়ে যায়।
দিলারা জামান: হ্যাঁ, এত লোকের ব্যাপার। আর মানুষ তো সবাই বোঝে না। মনে করে, এই একটু সাজগোজ করে এমনি করেই একটা কথা বলে দিচ্ছে। কিন্তু সেই কথাটা বলতে গিয়েই কতবার চেষ্টা করতে হয়। তারপরে রেডিও–টেলিভিশনে নাটক করার সময় দুপুরে আনা খাওয়াটা রাতে ১০টার শুটিং পর্যন্ত পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে। সেই পচা খাওয়াটাই মুখে তুলতে হয়েছে। এ রকম অনেক কষ্টের অভিজ্ঞতা আছে।
আপনি তো হুমায়ূন আহমেদ স্যারের ‘আগুনের পরশমণি’ও করেছিলেন।
দিলারা জামান: ওটাই আমার প্রথম কাজ।
সিনেমা, চলচ্চিত্রে প্রথম?
দিলারা জামান: হ্যাঁ, চলচ্চিত্রে আমার প্রথম কাজ। তখন মনে হচ্ছিল—আমি পারব কি না! কারণ সিনেমার গল্পে তো ছিল ওল্ড টাউনে একজন মুক্তিযোদ্ধার মা। খুব অল্প সময়ের জন্যই আমার সেখানে যাওয়া। কিন্তু যেভাবে আমি কাজ করেছি… পরবর্তী সময়ে হুমায়ূন ভাই তাঁর বইতে লিখেছিলেন—‘দিলারা জামান হঠাৎ এক চৈত্রের দাবদাহের মধ্যে একপশলা বৃষ্টির মতো আসলেন এবং সবাইকে শীতল করে দিলেন।’ তাঁর সেই লেখাটা পড়ে আমার এত ভালো লেগেছিল! আর ওই চরিত্রটা সত্যিই এমন ছিল যে, অনেক দিন পর ছেলেকে একটুখানি দেখতে পাই। কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই হঠাৎ তাকে বলি—আর্মি আসছে, যেন সে পালিয়ে যায়। তারপর নূরকে পাইপ বেয়ে পেছন দিক দিয়ে নামতে হয়েছিল। সেটাও একটা বিরাট রিস্কি ব্যাপার। যদি সে পড়ে যেত, তাহলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। এ রকম একেকটা পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে, যুদ্ধের আবহের ভেতর দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছিলাম। আগুনের পরশমণি ছিল সেই প্রথম ছবি, আর তা প্রচুর দর্শকপ্রিয়তাও পেয়েছিল।
খুবই মর্মস্পর্শী ছবি। গল্পটাই তো খুব সুন্দর। উনি বানিয়েছিলেনও ভালো। আপনি শাহীন স্কুল থেকে ভিকারুননিসায় এলেন কবে?
দিলারা জামান: শাহীন স্কুল থেকে ছাড়তে চায়নি। কিন্তু সেখানেও…মানে সব জায়গা থেকেই…আমার শিক্ষকতা ছেড়ে আসার একমাত্র কারণ ছিল আমার অভিনয়। এটাকে কেউ ভালো চোখে দেখেনি। আমি হয়তো অসুস্থতার কারণে একদিন ছুটির দরখাস্ত করেছি। পরের দিন গেলে প্রশ্ন আসত—‘শুটিং করতে গিয়েছিলেন নাকি?’ কিন্তু আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি, এভাবে স্কুল কামাই করে বা কাজ ফেলে আমি কোনো দিন শুটিং করিনি। সব সময়ই বলতাম—শনিবার–রোববার ছুটি থাকে, ওই সময়েই আমি কাজ করব। ঠিক সেইভাবেই আমি অভিনয় চালিয়ে গিয়েছিলাম।
আমরা আপনাকে...যেমন আমি যখন টেলিভিশনে ‘আগুনের পরশমণি’ দেখছি বা ‘এইসব দিনরাত্রি’ দেখছি, তখন আপনাকে মা হিসেবেই দেখি। আপনি কি প্রধান চরিত্র, নায়িকার চরিত্র করেননি?
দিলারা জামান: করেছি কয়েকটা।
প্রথম দিকে করেছেন?
দিলারা জামান: তখন পাকিস্তান আমল বলা যায় আরকি। আর প্রথম আউটডোর...তখন তো স্টুডিও বেজ হতো, বাইরে কাজ হতো না। দু–একটা কাজ আমরা করেছি। সেই মিরপুরটা তখন ছিল আউটডোর করার মতো, গাছগাছালি বাগান।
তখন তো উঁচু-নিচু পাহাড়ের মতো ছিল।
দিলারা জামান: হুম, পাহাড় ছিল। বাড়িঘরও ছিল না যে আমরা টয়লেটে যাব বা কাপড় বদলাব। আমি আর ডলি… ডলি হয়তো কাপড় ধরে আছে বাসের পাশে, আর আমরা তাড়াহুড়ো করে কাপড় বদলে আবার শটে চলে যাচ্ছি। এভাবেই প্রথম আউটডোর কাজ করলাম টেলিভিশনের ‘পিনিশ’। একটা নাটক হয়েছিল, খান জয়নুলের। তখন বড় বড় বজরা নৌকাগুলো নষ্ট হয়ে গেলে সেগুলো হোটেল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। মানে, শ্রমজীবী মানুষেরা সেখানে খেত, আবার চলে যেত। নাটকের নাম ছিল ‘কুলসুমের হোটেল’। ওখানেই প্রথম নদী থেকে পানি তোলার দৃশ্য… সেটাই এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। সদরঘাটে কুলসুমের হোটেল নাটকটি করা—ওটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম আউটডোর শুটিং।
আপনার মনে আছে যে আপনি আমার লেখা এবং মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ৫১বর্তী নাটক করেছিলেন।
দিলারা জামান: ওই ধারাবাহিকটাকেই আমি বলব আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কাজ। আমি আপনার সামনে বলছি… অনেকে হয়তো ভেবে নেবে অন্য কিছু, কিন্তু আসলে তা নয়। এত ঘরোয়া পরিবেশ ছিল যে আমরা সকালে এসে ওখানে কাজ করছি। সবকিছুই ছিল একেবারে পরিবারের মতো।
একটা পরিবারের মতো ছিলেন সবাই!
দিলারা জামান: হ্যাঁ। পরিবারের মতোই। ওখানেই রান্না হতো। ও আমরা যে জায়গায় (কাজ) করতাম, সেখানে বাইরে থেকে খাওয়া আনা যেত না। ওইখানে সবকিছু করতে হতো। একদিন হলো কী, কাজের জন্য যে মহিলার রান্না করার কথা ছিল, সে আসেনি। এতজন মানুষ… আমি তখন বললাম, কোনো চিন্তা নেই। চাল–ডাল আর আলু নিয়ে আসো। আমরা সবাই মিলে ডাল–ভাত আর আলুভর্তা প্রস্তুত করে ফেললাম। প্রায় ২৫–৩০ জনের খাওয়া...। অবাক হয়ে দেখলাম—কারও কোনো বিকার নেই যে খাবারটা ভালো হয়েছে না মন্দ হয়েছে। এত ভালো লাগত।
শুটিং শেষ হতো আমি… আহারে মাসুদ আলী খান ভাই চলে গেছেন। অনেক অসুস্থ ছিলেন। আমরা গিয়েছিলাম তাঁকে দেখতে। তিনি বলছেন, আমি আর কাজ করতে পারি না। ওই কথাগুলো শুনে অনেক খারাপ লাগছিল…আমার তখন গাড়ি ছিল। আমি মাসুদ আলী ভাইকে তাঁর গ্রিন রোডের ওখানে নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলে আসতাম। সেসব দিনে মনে হতো, সবাই যেন আমাদের পরিবারের মতো। আমার কাপড়ও অন্য মেয়েগুলো পরত। আমি মজা করে বলতাম—‘আমি তো বুড়ির চরিত্র করছি, আমার এত কাপড় লাগবে না।’ ঠিক যেন একটা পরিবারের ছেলে-মেয়ে, বাবা-মা—যে সমস্যা, যে কথা, সবকিছুই ছিল একেবারে পারিবারিক। সত্যি বলতে, ওই রকম কাজ বোধ হয় আর কোনো দিন হবে না আমার।
ওই নাটকে মাহফুজ আহমেদ ছিলেন, শহীদুজ্জামান সেলিম ছিলেন, অপি করিম ছিলেন, মৌটুসী ছিলেন।
দিলারা জামান: খুবই সুন্দর—মানুষকে, দর্শককে জীবনের কাছে নিয়ে যাওয়া। তখনকার দিনে যা হতো, নাটক প্রচার হলে সবাই টেলিভিশনের সামনে এসে বসত। পরিবারের সবাই একসঙ্গে। এই পারিবারিক নাটকগুলো, জীবনের গল্পগুলো যেন আজ আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক। শত বছরের যে জীবনধারা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি—এসব আমরা হারাতে বসেছি।
এই পারিবারিক বন্ধনটাই আসলে আমাদের নাটকের বড় প্রভাব ফেলেছিল। এখনকার দিনে দেখি ছেলেমেয়েরা হঠাৎ এসে নিজের দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে দেয়। তখন তো এ রকম ছিল না। সবাই একসঙ্গে খাবার টেবিলে বসত। কারও কোনো সমস্যা, কোনো আনন্দ, দিনের কোনো মজার ঘটনা—সবকিছু ভাগাভাগি হতো। কারও কষ্ট হলে বা সমস্যা হলে তা বলা যেত, আর একসঙ্গে বসে সমাধান খোঁজা হতো।
এই জীবনগুলো আজ আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। আমরা খালি নিজের জন্য ভালোবাসা খুঁজি। একসঙ্গে বসে টেলিভিশন দেখা বা গল্প করার অভ্যাসটাও নেই। এখন সবাই ভাবে—আমার যখন সময় হবে তখন আমি একা বসে দেখে নেব। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের অনেক উপকার করেছে, কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে।
আপনার দুই মেয়ে...
দিলারা জামান: তানিরা। ডক্টর তানিরা। সে কানাডায় থাকে। টরন্টো ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। শি ইজ আ ডেন্টিস্ট। মনবসু স্কলার। আর ওর স্বামীও ওখানে ডেন্টিস্ট। আর আমার ছোট মেয়ে থাকে আমেরিকায়।
ওর নাম?
দিলারা জামান: ওর নাম জুবায়রা। আর ওর স্বামী ডেল কোম্পানির এরিয়া ম্যানেজার। তো ওরা বলল চলে আসো। বছরে, দুই-তিন বছর পরে যাবে দেশে, আবার ঘুরবে। তো আমি ভাবলাম যে, না, যাই। ঠিক আছে ওদেরকে এখন সময় দিই। ওরা একা একাই থাকে। চলে গেলাম। আমার সবকিছু দিয়েটিয়ে, আমার ৪০ বছরের সংসারের… আমি (বললাম যে,) সব নিয়ে যা তোরা। নাটকের সবাই এসে সব নিয়ে-টেয়ে গেল। তারপরে চলে গেলাম। কিন্তু গিয়ে আর মন ভালো লাগে না। অসম্ভব নিস্তব্ধতা চারদিকে। আমার ছোট মেয়ে যেখানে থাকে, লোক নাই। সকালে সব যাচ্ছে গাড়ি করে, আবার সন্ধ্যায় ফিরে আসছে। একটা লোক রাস্তায় নাই। আমি বলি, একটা কুত্তাও দেখি না রাস্তায়। আমার মেয়ে বলে, তুমি এদের দেশে থাকো, আর বলো কুত্তা। এই যে নিঃসঙ্গতা, নিস্তব্ধতা। ছয়টা চ্যানেল নিয়ে দিয়েছে। কত দেখব নাটক আর খবর?
তারপরে দেখলাম যে না, আমার মন হাঁপিয়ে উঠছে। নাটকগুলো... কিছু একটা তো আমি করতে পারতাম! এ রকম একটা হাহাকার।
পরে ওখানে গিয়েও তাঁর (দিলারা জামানের স্বামীর) শরীর খারাপ হয়। দুবার হাসপাতালে ওনাকে থাকতে হয়েছে। ওখানে আমার সব ফ্রি–ট্রি হয়ে গেছিল, ওষুধ-টষুধ, এগুলো তো বুড়োদের ফ্রি। তারপরে আর কিছুদিন থাকলে যে পেনশনটা পায় বুড়োরা সেটাও পেতাম। কিন্তু আবার দেশে চলে এসেছি। আবার নতুন করে একটা একটা করে সব সংসার সাজালাম।
২০১৪ সালে জুন মাসের ১৪ তারিখে জামান ভাই মারা গেলেন।
দিলারা জামান: হ্যাঁ।
সেটা কি ঢাকায়?
দিলারা জামান: ঢাকায়, এই বাসাতেই (উত্তরা)। উনি এখানে আসার পরে প্রায় ছয়বার তাকে আইসিইউতে নিতে হয়েছে। শ্বাসকষ্ট ছিল। অক্সিজেন পেত না, আর্টিফিশিয়াল অক্সিজেন দিয়ে… । বিদেশ যাওয়ার পরে ডাক্তার বললেন যে এটা তো অবাক কাণ্ড। সে তো অক্সিজেন পাচ্ছে না লাংসে। ৩৪% অক্সিজেন আছে, এটাও কমে যাবে। তখন তাকে আর্টিফিশিয়াল অক্সিজেন দিয়ে রাখতে হবে। তো ওখানে থেকে শুরু হলো। পরে ঢাকায় এসেও তাকে ওই অক্সিজেন দিয়ে রাখতে হতো। সারাক্ষণ অক্সিজেন যাচ্ছে। তার মধ্যে বলতেন যে, তুমি কাজ করো, কাজ করো। কারণ জানতেন যে কাজ ছাড়া আমার ভালো লাগবে না। তা আমি যেখানেই কাজ করতে যেতাম, বলতাম যে, দেখো, আমাকে সাতটা–আটটার মধ্যে ছেড়ে দিয়ো। কারণ, বাসায় যেতে হবে। এবং সেইভাবে আমি আসতাম। আমার মনে আছে, আসলে দরজাটা যখন খুলতাম, উনি এই ঘরে থাকতেন, মাথাটা উঠিয়ে এমনি করে দেখতেন যে আমি এসেছি কি না। ৫০ বছরের সেই জীবনসঙ্গী চলে গেলেন।
তো আমার কাছে যেটা মনে হয়, আপনার জীবন আমাদের সবারই জীবন এ রকম হয়ে গেল যে আমাদের বাচ্চারা বিদেশে থাকে।
দিলারা জামান: থাকে।
আমরা দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে টিকতে পারি না।
দিলারা জামান: টিকতে পারি না। আবার চলে আসি। তো এত দিন পর আপনি বলছিলেন যে বয়স তো কম হয় নাই। ৮৩। আমার মেয়েরা আসে এখন। আমি আর যেতে পারি না। কারণ এত লম্বা জার্নি, ৩০-৩৫ ঘণ্টা। ওরা প্রতিবছর একবার করে আসে। আমার সঙ্গে থেকে যায়।
উত্তরার এই বাসাতে আপনি একা থাকেন। মেয়েরা বিদেশে থাকে।
দিলারা জামান: আমার ছেলে আছে। ও বিদেশে যাওয়ার জন্য অস্থির। পরে আমি বলছি যে না তুমি যেতে পারবে না।
ও এখন হাওরে একটা নৌকো দিয়েছে, ওই যে হাউসবোট, ওইখানে সবাই গিয়ে থাকতে পারে, সুন্দর। আমার কাছে বেশ ভালোই লাগে।
ও, তাহলে তো ভালোই আছে।
দিলারা জামান: আছে। কিন্তু ও আবার চলে যায় চার–পাঁচ দিনের জন্য, ছয় দিনের জন্য, চলে যায় হাওরে, সিলেটে।
আপনার ছেলের নাম কী?
দিলারা জামান: আশিক আশফাক। এখন তো আসলে একা মুভ করতে পারি না। একটি ছেলে সব সময় সঙ্গে থাকে। এই পড়ে যায় হাত থেকে, দোকানে গেলে হয়তো টাকা না দিয়েই চলে আসি, আবার হয়তো ডেকে বলে, দাদি আপনার টাকা, টাকা। তো সেই জন্য ও থাকে আরকি। এখন একজনকে সব সময় সঙ্গে থাকতে হয়।
এই যুগে ৮৩ বছর কোনো বয়স না।
দিলারা জামান: না, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে। আমি বলি এখন টিকিট কাটা হয়ে গেছে। স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি ট্রেন আসার অপেক্ষায়। ট্রেন আসলে উঠে পড়ব সেই ট্রেনে, অনন্তকালের সেই যাত্রা।
অভিনয় করে আপনি পুরস্কার পেয়েছেন, জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। একুশে পদক পেয়েছেন। অনেক সংবর্ধনা পেয়েছেন, ভবিষ্যতে আরও পাবেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় পুরস্কার মানুষের ভালোবাসা, সেটা আপনি অনেক পান।
দিলারা জামান: সেটাই সবচেয়ে বড়। আমি বলি, এই মায়া, মানুষের ভালোবাসা—কথায় বোঝানো যায় না। কোথাও কাজ করতে গেলে হয়তো খেতে খেতে টমেটোর খেতের মধ্য দিয়ে যাওয়া। দেখি, একটা টমেটো লাল হয়ে আছে বা মরিচগুলো ধরে দেখলাম। কাজ শেষ করে ফিরে আসার পর দেখি—ওমা, কতগুলো টমেটো, কতগুলো মরিচ আমার জন্য নিয়ে এসেছে! এই যে মায়া, এই যে ভালোবাসা, এটা ছেড়ে আমি কোথায় পালাব বলেন? আমি এদের ছেড়ে বাঁচতে পারব না। আমার মেয়েরা অনেক সময় বলে, যখন আমি বলি যে নাটকের ছেলেমেয়েরা আমার ছেলেমেয়ে, তখন তারা একটু অভিমান করে বলে—‘আজ কিছু হলে আমরা দৌড়ে আসব।’ আমি বলি, না আসলে আমরা যে কাজ করি, আমরা একে অপরের জন্য পরিবারের মতো। অনেক গল্প আছে। কালকেই আমি একটা কাজে ছিলাম। একটি মেয়ে আমাকে বলছিল, বাসায় সে এই কথাগুলো কাউকে বলতে পারে না, তাই শুটিংয়ে আমাদের কাছে এসে বলে মনটা হালকা করে, বলে, সাজেশন চায়। এই যে বন্ধন, এই যে সম্পর্ক—বাইরের কেউ বুঝবে না। এটা আমাদের একটি আলাদা পরিবার, নাটকের সেই পরিবার।
আপনি ব্রিটিশ আমল দেখেছেন। যদিও খুব ছোট ছিলেন। পাকিস্তান আমলটা মোটামুটি ভালোই দেখেছেন।
দিলারা জামান: যুদ্ধ দেখেছি।
যুদ্ধ দেখেছেন।
দিলারা জামান: যুদ্ধের সময় আমরা গ্রামে পালিয়েছিলাম, ধানের গোলাঘরের পেছনে সারাক্ষণ লুকিয়ে থাকতাম—ময়মনসিংহে। সেখানেই ছিলাম। সারা দিন ওই বড় ধানের গোলার পেছনে লুকিয়ে থাকতাম। সন্ধ্যা হলে ঘরে আসতাম, দিনের বেলা কোথাও বের হওয়া সম্ভব হতো না। কেউ আমাকে একটু খাওয়া দিয়ে আসত। ভোর অন্ধকারে দুই মগ পানি মাথায় দিয়ে গোসল করে আবার সেই জায়গায় চলে আসতাম। বাইরে কেউ হঠাৎ বললে দেখবে যে...এখানে একটা মেয়ে এসেছে, যুবতী মেয়ে। এই দিনগুলোর মধ্যে আমরা যারা সরাসরি যুদ্ধে যাইনি, তারাও দেশে থেকে একেকজন যুদ্ধ করেছি—বাঁচার জন্য, জীবনের জন্য, যেন স্বাধীন একটা দেশ পাই। আজ আমরা সেই স্বাধীন দেশ পেয়েছি। এই স্বাধীনতার মূল্য নিজের দেশে থেকে বোঝা যায় না। যখন বাইরে যাই তখন দেখি যে আমি একটা দেশ, একটা পতাকা, এটা যে কত বড় একটা অহংকার এবং প্রাপ্তি—এটা আসলে বাইরে না গেলে বোঝা যায় না।
এখন বাংলাদেশের আশার দিক কী দেখেন?
দিলারা জামান: আমি কখনো নিরাশ ছিলাম না। সব সময় আমি আশার আলো দেখতে পাই। হয়তো সময়ে এ রকম একটা অবস্থায় এসেছে। এটা কেটে যাবে। আমাদের তরুণদের মধ্যে যে প্রতিভা, যে আশ্চর্য একটা ক্ষমতা, তারা আছে তারা সত্যকে বেছে নেবেই এবং সত্যের দিকে এগিয়ে যাবে। এবং আমরা এখন ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। একমাত্র আশা যে ওরা আমাদের জন্য সুন্দর দিন আনবে। আমরা আসলে... অত কিছু চাই না। সবাই যেন দুই বেলা খেতে পারে সুন্দরভাবে, ন্যায়বিচার পায়, তাদের জীবনের নিরাপত্তাটা থাকে...সবচেয়ে বড় যেটা আরকি। একটা চিন্তা নিয়ে, একটা ভয় নিয়ে আমি রাস্তায় বের হব, এটা তাহলে তো আমার সেই পরাধীন সময় যা ছিলাম, আগের যে সময়টা, সেই সময়গুলো আমাদের জীবনে তাহলে আসছে। ওটা চাই না। সুন্দর একটা দিনের আশা নিয়ে বেঁচে আছি, সেটা যেন দেখতে পাই। এবং আমি নিশ্চিত যে সেসব সুন্দর দিন আমাদের আসবে এবং আমি সেটা দেখেই মরতে চাই।
আনিসুল হক: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি খুব সুন্দর আশার কথা বললেন। সেসব সুন্দর দিন আসবেই। আমরা এতক্ষণ একুশে পদকপ্রাপ্ত, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত, আমাদের প্রিয় শিল্পী দিলারা জামানের কথা শুনছিলাম— জীবনের অভিজ্ঞতা শুনছিলাম। অভিজ্ঞতার আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ুক। আমরা এর থেকে শিক্ষা নেব, অনুপ্রেরণা নেব এবং শিল্পীর যে সাধনা, শিল্পের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা, এই শিক্ষাটা আমরা দিলারা জামানের জীবন থেকে নিশ্চয়ই লাভ করব এবং আমরা যে যে কাজটাই করি না কেন তার মতো করে একান্তভাবে করব। গভীর মনোযোগের সঙ্গে করব। সাধনার মতো করে করব। আপনারা সবাই ভালো থাকুন। আবারও দেখা হবে ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো অনুষ্ঠানে। আরেকজন জাতীয় ব্যক্তিত্ব বা আমাদের প্রিয় ব্যক্তিত্বকে সঙ্গে নিয়ে। আজ এ পর্যন্তই। ভালো থাকুন।