বিশেষ সাক্ষাৎকার: আসিফ নজরুল

সচেতনভাবে কোনো দলের পক্ষ নেওয়া হয় না

আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল এক বছরে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা, পক্ষপাতের অভিযোগ, বৈষম্য, আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। ১ আগস্ট সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রাজীব আহমেদ। সাক্ষাৎকারটির প্রথম কিস্তি গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত হয়। আজ পড়ুন সাক্ষাৎকারের শেষ কিস্তি।

প্রথম আলো:

সরকারের এক বছর পূর্তি হচ্ছে ৮ আগস্ট। এখন কি পারদর্শিতা মূল্যায়ন করে কোনো রদবদলের সম্ভাবনা আছে? আপনি হয়তো স্বীকার করবেন যে কোনো কোনো উপদেষ্টা ভালো করেছেন, কেউ কেউ সেটা পারেননি।

আসিফ নজরুল: আমাদের অনেক সমালোচনা হয়, যেটা খুব নির্দয়। তো আমি যখন ইনডিভিজুয়ালি (ব্যক্তি ধরে) দেখি, আমাদের অনেকেই খুব ভালো করছেন। আমাদের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ভাই, জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির ভাই, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ভাই ভালো করছেন। আমাদের ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন ভাই হজ ব্যবস্থাপনায় সেরা কাজ করেছেন। এ রকম আরও কারও কথা বলতে পারি। ব্যর্থতার কথা আমার বলা শোভনীয় নয়, এটা আপনাদের ব্যাপার।

স্যারের (অধ্যাপক ইউনূস) যে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ (শরীরী ভাষা) থাকে, তাঁর যে কার্যপদ্ধতি, এটার মধ্যে কিন্তু আমরা প্রত্যেকে জানি, কার কাজের ব্যাপারে স্যারের মূল্যায়ন কতটুকু আছে।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

একটা সম্পূরক প্রশ্ন করে নিই। বিগত সরকারের আমলে আমরা দেখতাম, যত সমালোচনাই হোক, শেখ হাসিনা কাউকে বদলাননি। কোনো সমালোচনাকে তিনি পাত্তা দেননি। এই সরকারের আমলেও কি সেটাই হবে?

আসিফ নজরুল: না, কিছু সমালোচনা তো খুবই নির্দয়। এ রকম সমালোচনার কারণে যদি কাউকে বাদ দিতে হয়, তাহলে তো সবার বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু হবে।

আমাদের কারও কারও ক্ষেত্রে হয়তো অদক্ষতা, অনভিজ্ঞতার অভিযোগ থাকতে পারে। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ শোনেন? একজন-দুজন সম্পর্কে হয়তো ক্যাম্পেইন (প্রচার) আছে, সেটা তো প্রমাণিত তথ্য নয়। আমরা অফিস করি না, এটা তো শোনেন না, স্বজনপ্রীতি করি, এটা শোনেন না।
প্রথম আলো:

যৌক্তিক সমালোচনা কি নেই?

আসিফ নজরুল: সে ক্ষেত্রে সামগ্রিক বিবেচনা করতে হয়। ধরেন, যৌক্তিক সমালোচনা মনে হচ্ছে, কিন্তু ইন্টেলিজেন্সের রিপোর্টের (গোয়েন্দা প্রতিবেদন) ভিত্তিতে বা অন্য কোনো তথ্যের ভিত্তিতে স্যার (অধ্যাপক ইউনূস) যদি কনভিন্স (সামগ্রিক বিষয় অনুধাবন করে সম্মত হওয়া) না হন, তাহলে তো ব্যবস্থা নেওয়াটা তাঁকে ডিসকারেজ (নিরুৎসাহিত) করবে। আমাদের কারও কারও ক্ষেত্রে হয়তো অদক্ষতা, অনভিজ্ঞতার অভিযোগ থাকতে পারে। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ শোনেন? একজন-দুজন সম্পর্কে হয়তো ক্যাম্পেইন (প্রচার) আছে, সেটা তো প্রমাণিত তথ্য নয়। আমরা অফিস করি না, এটা তো শোনেন না, স্বজনপ্রীতি করি, এটা শোনেন না।

সাক্ষাৎকারে সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন আসিফ নজরুল
ছবি: জাহিদুল করিম
প্রথম আলো:

আমরা তো শুনি, কেউ কেউ বেলা দুইটার পরে অফিসে যান। আমরা তো দু-একজনের কথাই বলব। কেউ তো বলছে না, পুরো উপদেষ্টা পরিষদ চলে যাক।

আসিফ নজরুল: আমি এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে অবগত নই।

প্রথম আলো:

উপদেষ্টা পরিষদে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে, আলোচনার ক্ষেত্রে বাইরের কেউ জেনে যাবে, এই ভয়ে থাকেন কি না।

আসিফ নজরুল: আমার মনে হয় না।

প্রথম আলো:

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নির্বাচনে বাধা আসার আশঙ্কা—এ দুই পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে জানতে চাই, আপনারা কি সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন তুলে আনতে পারবেন।

আসিফ নজরুল: অবশ্যই পারব।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল
ছবি: জাহিদুল করিম
প্রথম আলো:

কেউ কেউ বলছেন, সেনাবাহিনীর আরও সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব হবে না। সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব আছে বলে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে।

আসিফ নজরুল: মোটেও দূরত্ব নেই, এটা নিশ্চিত থাকেন। এগুলো সম্পূর্ণ বাইরের স্পেকুলেশন (অনুমান); বরং বাইরের শক্তিগুলো কেউ কেউ সেনাবাহিনীকে অন্যায়ভাবে কিছু ক্ষেত্রে দোষারোপ করার চেষ্টা করে। আমি গণ-অভ্যুত্থানের মাঠে থাকা একজন কর্মী হিসেবে বলি, সেনাবাহিনী সরকারের একটি বাহিনী হয়েও সামগ্রিকভাবে গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে যে ভূমিকা রেখেছে, সেটা সম্পর্কে সমাজের কিছু কিছু স্তরের শ্রদ্ধাবোধের অভাব আছে। ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্নভাবে সেনাবাহিনীর কেউ কেউ জঘন্য কাজে লিপ্ত হতে পারে, তবে সামগ্রিকভাবে তাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আমার কথা হলো, সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব নেই। তবে নির্বাচনের সময় আরও বেশি দায়িত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলে সেটা নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়।

প্রথম আলো:

নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রতি কি আপনাদের কোনো পক্ষপাত আছে? সরকারের দুজন উপদেষ্টা তাদের লোক বলে অনেকে বলে থাকেন।

আসিফ নজরুল: গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত মুহূর্তে তো অবশ্যই ছাত্রদের নেতৃত্ব ছিল, এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। যখন আমাদের সরকার গঠিত হয়, তখন তো আমি সমালোচনা শুনেছি যে এত কম ছাত্র উপদেষ্টা কেন। ছাত্র উপদেষ্টাদের বন্ধুরা যখন দল গঠন করলেন, তখন কিছু ক্ষেত্রে মনে হতে পারে, সরকার এনসিপিকে প্রিভিলেজ (বিশেষাধিকার) দিচ্ছে। আসলে প্রিভিলেজ দিচ্ছে না। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃস্থানীয় ভূমিকার কারণে এনসিপি খুব বেশি ‘ভালনারেবল’ (নাজুক)। সে জন্য গোপালগঞ্জ বা কোনো কোনো জায়গায় তাদের বাড়তি সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। বিএনপি বা জামায়াত অনেক পুরোনো দল, অনেক সুসংগঠিত। এনসিপি সেটা নয়। তাদের ওপর যদি কোথাও হামলা হয়, কোনো ঘটনা ঘটে, কেউ কি আমাদের ক্ষমা করতে পারবে?

আমি গণ-অভ্যুত্থানের মাঠে থাকা একজন কর্মী হিসেবে বলি, সেনাবাহিনী সরকারের একটি বাহিনী হয়েও সামগ্রিকভাবে গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে যে ভূমিকা রেখেছে, সেটা সম্পর্কে সমাজের কিছু কিছু স্তরের শ্রদ্ধাবোধের অভাব আছে। ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্নভাবে সেনাবাহিনীর কেউ কেউ জঘন্য কাজে লিপ্ত হতে পারে, তবে সামগ্রিকভাবে তাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আমার কথা হলো, সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব নেই।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল
ছবি: জাহিদুল করিম
প্রথম আলো:

এনসিপির নেতাদের কথায় কিন্তু মনে হয় না তাঁরা ‘ভালনারেবল’।

আসিফ নজরুল: আমার বিচারে একটা সদ্য ভূমিষ্ঠ দলের অনেক সমর্থক থাকতে পারে, কিন্তু তাদের তো বেশি কর্মী নেই, অভিজ্ঞতা নেই। আরেকটা কারণে তাদের সুরক্ষা দেওয়া দরকার; সেটা হলো, পতিত আওয়ামী লীগের প্রথম টার্গেট (নিশানা) হওয়ার কথা এনসিপির নেতারা।

প্রথম আলো:

বিএনপির সঙ্গে আপনাদের দূরত্ব আছে, সখ্য ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে—এ বক্তব্যের জবাবে কী বলবেন? বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি কথা বলেছেন। সেটি হলো, দক্ষিণপন্থীদের উত্থানে তিনি উদ্বিগ্ন।

আসিফ নজরুল: আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে ধর্মভিত্তিক দলগুলো প্রচণ্ড অন্যায়-অবিচারের শিকার হয়েছে।

প্রথম আলো:

অন্যায়-অবিচারের শিকার বিএনপিও হয়েছে।

আসিফ নজরুল: মধ্যপন্থী দলের মধ্যে বিএনপি, আর সংখ্যায় বেশি ধর্মভিত্তিক দল। তারা অসীম নির্যাতন, গ্রেপ্তার, গুমের শিকার হয়েছে এবং তারা এই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। তাদের সঙ্গে তো আমাদের বসতে হয়।

ছাত্র উপদেষ্টাদের বন্ধুরা যখন দল গঠন করলেন, তখন কিছু ক্ষেত্রে মনে হতে পারে, সরকার এনসিপিকে প্রিভিলেজ (বিশেষাধিকার) দিচ্ছে। আসলে প্রিভিলেজ দিচ্ছে না। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃস্থানীয় ভূমিকার কারণে এনসিপি খুব বেশি ‘ভালনারেবল’ (নাজুক)। সে জন্য গোপালগঞ্জ বা কোনো কোনো জায়গায় তাদের বাড়তি সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল
ফাইল ছবি
প্রথম আলো:

বৈঠক তো হবেই। বলছি, বিএনপির চেয়ে তাদের সঙ্গে সখ্য বেশি কি না।

আসিফ নজরুল: কেউ বলেন এনসিপির সঙ্গে আমাদের সখ্য, কেউ বলেন ধর্মীয় দলের সঙ্গে। লন্ডনে অধ্যাপক ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর কেউ কেউ বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে সরকারের সখ্য। কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সচেতনভাবে বা জ্ঞাতসারে কোনো দলের পক্ষ অবলম্বন করা হয় না।

প্রথম আলো:

কোনো কোনো সমাবেশে নাগরিক সমাজের কারও কারও ‘কল্লা ফেলে দেওয়ার’ হুমকি দেওয়া হলো। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। কেন?

আসিফ নজরুল: আমার মনে হয় যাদের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, সেই পুলিশ হয়তো ভাবছে, এটা জাস্ট ‘পলিটিক্যাল রেটরিক’ (রাজনৈতিক বক্তব্য)। ব্যবস্থা নেওয়া হলে উগ্রবাদকে উসকে দেওয়া হবে এবং ওনাদের নিরাপত্তার জন্য জিনিসটা ভালো হবে না। আমি তো হুমকির পরও কারও কর্মকাণ্ড কম দেখছি না। অনেক সময় রাষ্ট্র পরিচালনার সময় বিবেচনায় রাখতে হয়, ব্যবস্থা নিলে আরও উসকে দেওয়া হয় কি না।

প্রথম আলো:

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এখন নিষিদ্ধ। বিচার শেষ হওয়ার আগে তাদের কার্যক্রম চালাতে না দেওয়ার পক্ষে অনেক মানুষ রয়েছেন। কিন্তু কারও কারও প্রশ্ন, নির্বাহী আদেশে কার্যক্রম স্থগিত রেখে যদি আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়া হয়, সেই নির্বাচন নিয়ে বিদেশে প্রশ্ন উঠবে কি না?

আসিফ নজরুল: প্রশ্ন যারা তোলার, তারা তুলবে। কিন্তু দেখেন, আওয়ামী লীগের কারও মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই; বরং আওয়ামী লীগের নেত্রী ও অন্য নেতারা বলছেন, এই গণহত্যা নাকি আমরা করেছি এবং তাঁরা ফিরে এলে প্রতিশোধ নেবেন, আমাদের ফাঁসিতে ঝোলাবেন। এ ধরনের কথাবার্তা যে দল বলে এবং যে দল সুযোগ পেলেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে, তাদের রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা চালাতে দিলে আপনি দেশ চালাতে পারবেন? তাদের বিচার করতে পারবেন? অসম্ভব একটা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এবং মারামারি-খুনোখুনি করে বাংলাদেশকে বিপর্যস্ত করা হবে। বাংলাদেশে অন্যান্য যে অপশক্তি আছে, তাদের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ তৈরি করা হবে। এই আশঙ্কা সত্যি, যৌক্তিকভাবেই আমাদের মধ্যে আছে।

কেউ বলেন এনসিপির সঙ্গে আমাদের সখ্য, কেউ বলেন ধর্মীয় দলের সঙ্গে। লন্ডনে অধ্যাপক ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর কেউ কেউ বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে সরকারের সখ্য। কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সচেতনভাবে বা জ্ঞাতসারে কোনো দলের পক্ষ অবলম্বন করা হয় না।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল
ফাইল ছবি
প্রথম আলো:

কেউ কেউ বলছেন, নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ না করে জনগণকে প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ দেওয়াই কার্যকর পন্থা হবে।

আসিফ নজরুল: এটা ঠিক, জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়া আরও বেশি ইমপ্যাক্টফুল (কার্যকর)। কিন্তু আমাদের তো সত্যি সত্যি আশঙ্কা আছে যে আওয়ামী লীগ নির্বাচন তো দূরের কথা, রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয় থাকলে দেশে কোনো দিন নির্বাচন করা যাবে না, দেশ পরিচালনা করাই যাবে না। আমাদের ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট (গোয়েন্দা প্রতিবেদন) আছে যে সরকারের বিরুদ্ধে আনসারের বিক্ষোভসহ বিভিন্ন বিক্ষোভে আওয়ামী লীগের ইন্ধন ছিল। ক্রেডিবল এভিডেন্স (বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ) আছে সেখানে।

প্রথম আলো:

সরকার ভারতে আম পাঠাল। ভারত যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের পর চিকিৎসক পাঠাল। উপদেষ্টাদের মধ্যে ভারতবিরোধী বক্তব্য ইদানীং কম দেখছি। দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের কী অবস্থা?

আসিফ নজরুল: আমরা ভারতের শত্রু হতে চাই না, কিন্তু ভৃত্যও হতে চাই না। আমরা সমমর্যাদাভিত্তিক একটা সম্পর্ক চাই।

প্রথম আলো:

তিস্তা প্রকল্প চীনা ঋণে করার জন্য দেশটিকে চিঠি দিয়েছে সরকার। এটা কি উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হয়েছে?

আসিফ নজরুল: মাঝে মাঝে উপদেষ্টা পরিষদে, মাঝে মাঝে কিচেন কেবিনেটে (কয়েকজন উপদেষ্টা) আলোচনা হয়, মাঝে মাঝে স্যার ডেকে নিয়ে কথা বলেন। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কোনো উপদেষ্টা এককভাবে নেন না।

প্রথম আলো:

আপনি বা আপনার সরকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কি ফেসবুকার বা ইউটিউবারদের দ্বারা প্রভাবিত হন, চাপে থাকেন? আপনি নিজেই বলেছিলেন, তদবির না শুনলেই অপপ্রচার চালানো হয়।

আসিফ নজরুল: সোশ্যাল মিডিয়ার চাপ সারা পৃথিবীতেই কমবেশি আছে। এখন তো যা ইচ্ছা লিখে দেওয়া যায়। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের প্রয়োগ নেই, গ্রেপ্তারের ভয় নেই, হুমকির ভয় নেই। তবে আমি নিজে ফেসবুক-ইউটিউব দেখে সিদ্ধান্ত নিই না। হতে পারে দু-একজন ফেসবুকে কোনো একটা নির্দিষ্ট প্রচারণা দ্বারা পীড়িত হন। সেটা দ্বারা সিদ্ধান্ত নেওয়া বা সিদ্ধান্ত না নেওয়ার চেষ্টা করেন।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল
ফাইল ছবি
প্রথম আলো:

ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের মিশন খোলা হচ্ছে। কিন্তু আপনার মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে আট মাস ধরে কোনো চেয়ারম্যান নেই।

আসিফ নজরুল: আপনি একটা ভালো সমালোচনা করেছেন। এখনকার যে মানবাধিকার কমিশন, তা প্রায় নখদন্তহীন বলতে পারেন। আইনের মধ্যে অনেক সমস্যা রয়েছে। অন্য অনেক সংস্কারকাজ করতে গিয়ে মানবাধিকার কমিশনের সংস্কার করা যায়নি। এই কমিশনের আইনে ব্যাপক সংস্কার করা দরকার, তারপর নিয়োগ। খালি খালি কাউকে চাকরি দিয়ে তো লাভ নেই। তবে এটা আমরা খুব দ্রুত দেব।

সোশ্যাল মিডিয়ার চাপ সারা পৃথিবীতেই কমবেশি আছে। এখন তো যা ইচ্ছা লিখে দেওয়া যায়। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের প্রয়োগ নেই, গ্রেপ্তারের ভয় নেই, হুমকির ভয় নেই। তবে আমি নিজে ফেসবুক-ইউটিউব দেখে সিদ্ধান্ত নিই না।
প্রথম আলো:

কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশে আসলে রিকনসিলিয়েশন বা পুনর্মিলন দরকার। আপনি রিকনসিলিয়েশন কমিশনের কথা বলেছেন। প্রধান বিচারপতি ও আপনি দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে এসেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বিচার হয়েছে, পরস্পর পরস্পরের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। আমরা কি রিকনসিলিয়েশনে যাব, নাকি অনন্ত বিভাজন ও সংঘাতের মধ্যে থাকব?

আসিফ নজরুল: দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী সত্যি সত্যি অনুতপ্ত ছিল। অনুতপ্ত থেকে তারা রিকনসিলিয়েশন করতে চেয়েছিল। আমাদের যারা হত্যাকারী, তাদের মধ্যে আপনি কোনো অনুতাপ দেখেন? আপনি তাদের সঙ্গে কীভাবে রিকনসিলিয়েশন করবেন?

প্রথম আলো:

আপনি যাঁদের কথা বলছেন, তাঁরা তো বিচারের আওতায় চলে আসবেন। এর বাইরে আওয়ামী লীগের বিপুল নেতা-কর্মী রয়েছেন, সমর্থক রয়েছেন।

আসিফ নজরুল: সারা দেশের মানুষের বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। রিকনসিলিয়েশনের অনেকগুলো কনসেপ্ট আছে। একটা হচ্ছে ট্রুথ সিকিং (সত্য সন্ধান), সেটা আমরা করছি। দ্বিতীয়, মেমোরিয়ালাইজেশন (স্মরণ রাখার ব্যবস্থা)। সে জন্য জুলাই জাদুঘর করছি। তৃতীয়, ক্ষতিপূরণ। সেটা দেওয়া হচ্ছে। চতুর্থ, জাস্টিস (ন্যায়বিচার)। এই চারটা প্রক্রিয়ার পর রিকনসিলিয়েশন হয়। জাস্টিসের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটার পরে রিকনসিলিয়েশন করার পরিবেশ-পরিস্থিতি এলে আমাদের সরকার না হোক, পরবর্তী সরকার বিবেচনা করবে।

প্রথম আলো:

রিকনসিলিয়েশন ছাড়া কি আমরা বিভাজন ও প্রতিশোধের চক্রে পড়ে থাকব?

আসিফ নজরুল: যেকোনো ক্ষেত্রে খুব ভালো কনসেপ্ট রিকনসিলিয়েশন। মুক্তিযুদ্ধের পরেই রিকনসিলিয়েশন দরকার ছিল। নব্বইয়ের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পর রিকনসিলিয়েশন দরকার ছিল। কিন্তু রিকনসিলিয়েশন করার একটা পরিবেশ-পরিস্থিতি লাগে। আপনার যারা ক্ষতি করেছে, তাদের সঙ্গে আপনি সদ্ভাব কীভাবে রাখবেন, যদি তারা অনুতপ্ত না হয়।

প্রথম আলো:

আমাদের তো একজন নেলসন ম্যান্ডেলা দরকার। অধ্যাপক ইউনূস ছাড়া এই নেতা কে হবেন?

আসিফ নজরুল: নেলসন ম্যান্ডেলাদের অপর দিকে তো ডি ক্লার্কের মতো নেতাও ছিলেন। আপনি ডি ক্লার্কের (এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক শ্বেতাঙ্গদের নেতা ও দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট) ভূমিকা দেখেন, নেলসন ম্যান্ডেলা তো একা একা সেটা (বর্ণবাদ বিলোপ ও রিকনসিলিয়েশন) করতে পারেননি। আমরা দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশের উদ্যোগের কথা জানছি। পরে একটা উদ্যোগ সম্ভবত প্রধান বিচারপতির পক্ষ থেকে নেওয়া হবে। আলোচনাটা থাক সমাজে।

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ।

আসিফ নজরুল: আপনাকেও ধন্যবাদ।