বাজারে নিত্যপণ্যের সরকারি দর কেউ মানছে না

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ২৯টি পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে। অতীতেও মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কাজ হয়নি।

রাজধানীর শাহজাহানপুর বাজারে গতকাল শনিবার দুই কেজি আকারের একটি ব্রয়লার মুরগি কেনেন বেসরকারি চাকরিজীবী মিরাজুল ইসলাম। বেশ দর-কষাকষি করে তিনি মুরগির দাম কেজিতে ১০ টাকা কমাতে সমর্থ হয়েছেন। দর পড়েছে ২১০ টাকা।

মিরাজুল প্রথম আলোকে বলেন, পবিত্র রমজান মাস শুরুর আগে তিনি ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা কমে কিনেছিলেন। রোজা এলেই সব পণ্যের দাম বেড়ে যায়।

সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ব্রয়লার মুরগি কেজিতে উৎপাদন খরচ ১৪৬ টাকা। তারা উৎপাদনকারী, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে মুনাফা যোগ করে এক কেজি ব্রয়লার মুরগির দর নির্ধারণ করে দিয়েছে ১৭৫ টাকা। যদিও ঢাকার চারটি বাজার এবং বিভাগীয় শহরের বাজার ঘুরে গতকাল কোথাও নির্ধারিত দরে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হতে দেখা যায়নি।

আশা করছি, বাজার নিজে থেকেই সংশোধিত হবে। যদি না হয়, যেখানে যেখানে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বা হস্তক্ষেপ দরকার, ওই সব জায়গায় হস্তক্ষেপ করা হবে।
মো. মাসুদ করিম, মহাপরিচালক, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর

শুধু ব্রয়লার মুরগি নয়, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ২৯টি পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেই দামে বিক্রির জন্য উৎপাদনকারী, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতাদের অনুরোধ করেছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্ধারিত দর মানতে দেখা যায়নি।

নির্ধারিত দর না মানলে জরিমানাসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের। সংস্থাটির মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কৃষি বিপণন অধিদপ্তর যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই বিষয় আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। অভিযান চলছে। কিন্তু আমাদের কাছে সব প্রত্যাশা করলে তা করতে পারব না। আমাদের তো সীমাবদ্ধতা আছে।’

রোজায় এবার বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। আগে থেকেই অনেক পণ্যের দাম বেশি ছিল। ফলে মানুষের ব্যয় অনেকটাই বাড়তি। সরকারও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেওয়ার কথা বলছে। আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। এমন পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর গত শুক্রবার এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২৯টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই বিষয় আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। অভিযান চলছে। কিন্তু আমাদের কাছে সব প্রত্যাশা করলে তা করতে পারব না।
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, মহাপরিচালক, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, তারা কৃষি বিপণন আইন-২০১৮ এর ৪ (ঝ) ধারার ক্ষমতাবলে দাম নির্ধারণ করেছে। ওই ধারায় অধিদপ্তরটির কার্যাবলি তুলে ধরা হয়েছে। একটি কাজ হলো ‘কৃষিপণ্যের সর্বনিম্ন মূল্য ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন’। অবশ্য নির্ধারিত দাম কার্যকর না হলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের এখতিয়ার অধিদপ্তরের নেই। তারা অভিযোগ জানাতে পারে। বিচার করবেন ম্যাজিস্ট্রেটরা।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানিয়েছে, তারা উৎপাদন খরচ হিসাব করে তার ভিত্তিতে উৎপাদক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে পণ্যগুলোর দাম নির্ধারণ করেছে। প্রতিটি পর্যায়ে নির্ধারিত হারে মুনাফা ধরা হয়েছে। আইনটির বিধিমালায় কোন পণ্যে কোন পর্যায়ে কত মুনাফা করা যাবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে।

যেমন গরুর মাংসের উৎপাদন খরচ কেজিতে ৫৮৮ টাকা। এর সঙ্গে মুনাফা ও অন্যান্য ব্যয় যোগ করে উৎপাদক পর্যায়ে গরুর মাংসের কেজি ৬০৫ টাকা, পাইকারি পর্যায়ে ৬৩২ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ৬৬৪ টাকায় বিক্রির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যদিও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭৩০ থেকে ৭৮০ টাকা কেজি।

আরও পড়ুন

মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া পণ্যের মধ্যে আরও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ডাল, মাছ, মাংস, ডিম, পেঁয়াজসহ মসলা, সবজি, খেজুর, চিড়া ও সাগর কলা।

নির্ধারিত দরে বিক্রির অনুরোধ জানিয়ে শুক্রবার কৃষি বিপণন অধিদপ্তর একটি বিজ্ঞপ্তি তাদের ওয়েবসাইটে দেয়। বিজ্ঞপ্তির অনুলিপি দেওয়া হয় কৃষিসচিব, বাণিজ্যসচিব, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), প্রতিযোগিতা কমিশন, সব জেলা প্রশাসক ও সব জেলার পুলিশ সুপারকে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, কাঁঠালবাগান, মালিবাগ ও শাহজাহানপুর বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলা হলে তাঁরা দাবি করেছেন, নতুন নির্ধারিত দর সম্পর্কে তাঁরা জানেন না। তাঁদের কিছু বলা হয়নি। যদি বলা হতো, তবু তাঁদের পক্ষে বিক্রি করা সম্ভব হতো না। কারণ, তাঁরা বেশি দামে কিনেছেন।

রাজধানীর শাহজাহানপুর বাজারের ফেনী জেনারেল স্টোরের মালিক আজহার উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পাইকারি বাজার থেকে যে দামে পণ্য কিনি, তার থেকে কিছু টাকা লাভ রেখে বিক্রি করি। পাইকারি বাজারে পণ্যের দাম কমলে আমরাও কম দামে বিক্রি করতে পারব।’

আরও পড়ুন

নির্ধারিত দর ও বাজারদর

রাজধানীর কাঁঠালবাগান বাজারে গিয়ে গতকাল আলু বিক্রি করতে দেখা যায় ৪০ টাকা কেজি। আলু মোটামুটি একদরে বিক্রি করেন বিক্রেতারা। তাই দামাদামি করে লাভ হয় না। অথচ কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানিয়েছে, এক কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ১৪ টাকার কম। তিন পর্যায়ে মুনাফা যোগ করার পর প্রতি কেজির যৌক্তিক দাম হয় ২৯ টাকা। এই দরেই তা বিক্রির কথা।

সরকারি সংস্থা টিসিবির বাজারদরের তালিকা বিশ্লেষণ করে এবং চারটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, ২৯টির মধ্যে শুধু আমদানি করা আদা, অ্যাংকর ডালের বেসন ও নেপালি সাগর নামে পরিচিত কলা নির্ধারিত দরে বিক্রি হচ্ছে। অবশ্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই দামের সঙ্গে কৃষি বিপণনের দামের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা আগে থেকেই ছিল; বরং রোজার শুরুতে কলার দাম বেড়েছে।

দাম নির্ধারণের সঙ্গে সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নয়ন, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ, নির্ধারিত দর কার্যকর করতে পদক্ষেপ নেওয়া এবং মানুষের আয় বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।
গোলাম রহমান, সভাপতি, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন দাম সদ্য ঘোষণা হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন করতে সময় লাগবে। কত সময় লাগবে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘আশা করছি, বাজার নিজে থেকেই সংশোধিত হবে। যদি না হয়, যেখানে যেখানে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বা হস্তক্ষেপ দরকার, ওই সব জায়গায় হস্তক্ষেপ করা হবে।’

অবশ্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তর দর নির্ধারণ করেছে চতুর্থ রোজায়। এর আগেই বাজারে দাম বেড়ে গেছে। ছোলা, খেজুরসহ বিভিন্ন পণ্যের পাইকারি কেনাবেচা শুরু হয়েছে আরও অন্তত দুই সপ্তাহ আগে। ফলে দেরিতে মূল্য নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন এবং তা কার্যকর করার সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন

বাজারে কত সংস্থা

রমজান মাস আসার পর বাজারে অভিযানে নেমেছে জেলা প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আরও আছে প্রতিযোগিতা কমিশন, যারা বিভিন্ন সময় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এবার দাম নির্ধারণ করে দিয়ে বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় নেমেছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) পণ্যের উৎপাদন ও আমদানি ব্যয় বিশ্লেষণ করে দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে। এখন বাজারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারিত দামের তিনটি পণ্য রয়েছে—ভোজ্যতেল, চিনি ও সাধারণ মানের খেজুর। বাজারে শুধু সয়াবিন তেল নির্ধারিত দামে পাওয়া যায়। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ছয়টি পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছিল। তা কেউ মানেনি।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বিগত বছরগুলোতে কিছু কিছু পণ্যের দাম ঠিক করে দিয়েছিল। যেমন ২০২১ সালে ছোলা, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, চিনি ও খেজুরের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল সংস্থাটি। তখনো বাজারে তা কার্যকর হয়নি।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বাণিজ্যসচিব ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে দাম কত হবে, তা সরবরাহ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। সরবরাহ বাড়লে নির্ধারিত দরের চেয়ে কমেও বিক্রি হতে পারে। তিনি বলেন, দাম নির্ধারণের সঙ্গে সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নয়ন, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ, নির্ধারিত দর কার্যকর করতে পদক্ষেপ নেওয়া এবং মানুষের আয় বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।