রংপুরে বড় ব্যবধানে জয়ী জাপার প্রার্থী

রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হলেন জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান। ঘোষণার পর বিজয় চিহ্ন দেখাচ্ছেন। ছবিটি জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তন থেকে তোলা।
ছবি : মঈনুল ইসলাম

রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে পুননি৴র্বাচিত হয়েছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান। গতকাল রাত সোয়া ১২টার দিকে ২২৯টির কেন্দ্রের সব কটির ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। এতে দেখা যায়, বড় ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন তিনি। লাঙ্গল প্রতীকের এই প্রার্থী পেয়েছেন ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৮ ভোট। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী (হাতপাখা প্রতীক) আমিরুজ্জামান। তিনি পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৮৯২ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী (আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী) লতিফুর রহমান ৩৩ হাজার ৮৮৩ ভোট পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা (ডালিয়া) ২২ হাজার ৩০৬ ভোট পেয়ে চতুর্থ হয়েছেন।

বিজয়ী হওয়ার পর রাতে মোস্তাফিজার রহমান তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এই বিজয় কেবল তাঁর নয়, সব নগরবাসীর।

দিনভর ইভিএমে ভোগান্তি, ক্ষোভ

এই নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট দিতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে ভোটারদের। এর আগে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে ভোগান্তি হলেও গতকাল মঙ্গলবার রংপুরে তা সব ‘রেকর্ড’ ছাড়িয়ে যায়। ইভিএমে জটিলতার কারণে নির্ধারিত সময়ের সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে রাত আটটা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলে।

ভোটার উপস্থিতি বেশি হওয়ায় এবং অনেকের আঙুলের ছাপ না মেলায় ভোট গ্রহণে ধীরগতি হয়েছে বলে জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। গতকাল বিকেলে ভোট গ্রহণের নির্দিষ্ট সময় (বিকেল সাড়ে ৪টা) শেষে রাজধানীতে নির্বাচন ভবনে সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, রংপুর সিটি নির্বাচন অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ হয়েছে। ভোটার উপস্থিতি ব্যাপক ছিল।

সিইসি যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন রংপুরের অন্তত ৩০টি ভোটকেন্দ্রে ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন অনেক ভোটার।

ধীরগতির বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘ধীরগতির অভিযোগ অসত্য নয়। এখন যে অবস্থা দেখেছি অনেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। এটা শেষ করতে সাতটা–আটটা পর্যন্ত গড়িয়ে যেতে পারে।’

সিইসির কথাই সত্য হয়। রাতটা আটটায় ভোট গ্রহণ শেষ হয়।
রংপুর সিটি করপোরেশনের ২০১৭ সালের নির্বাচনে মাত্র একটি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট নেওয়া হয়েছিল। আর এবার ২২৯টি কেন্দ্রের ১ হাজার ৩৪৯টি বুথের সব কটিতেই ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হয়।

সকাল সাড়ে আটটায় ভোট গ্রহণ শুরুর পর থেকেই ইভিএমে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) যাচাইয়ে ভোটারের আঙুলের ছাপ মেলাতে হিমশিম খান দায়িত্বরত কর্মকর্তারা। ইভিএমে কীভাবে ভোট দিতে হয়, সে বিষয়ে অনেক ভোটারেরই পরিষ্কার ধারণা ছিল না। ফলে তাঁরা গোপন কক্ষে ঢুকে বুঝতে পারছিলেন না, কী করতে হবে।

নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা বলেন, ইভিএম নিয়ে প্রচার কম হয়েছে। এ কারণে ভোটাররা এর ব্যবহার বুঝতে পারছিলেন না। বড় পরিসরে এই যন্ত্র ব্যবহারের আগে আরও মূল্যায়ন দরকার বলে তাঁরা মনে করেন।

সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ ও রংপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ (আরসিসি কলেজ)—এই দুটি কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, অনেকেরই আঙুলের ছাপ মিলছে না। কর্মকর্তারা কাউকে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে আসতে বলছেন, কাউকে লেবু ঘষে আসার পরামর্শ দিচ্ছেন।

আরসিসি কলেজ পুরুষ কেন্দ্রের ২ নম্বর ভোটকক্ষে নুরুল ইসলাম নামের সত্তরোর্ধ্ব এক ব্যক্তির আঙুলের ছাপ মেলাতে পেট্রোলিয়াম জেলি ঘষেও কাজ হচ্ছিল না। অপেক্ষায় থাকা এক ভোটার তখন বলেন, ‘হাতখান ধুইয়া আইসো। এক ভোট দিতে দুই ঘণ্টা নাগলে আর ভোট দিবার নাগবে না।’

প্রতিটি ভোটকক্ষেই পেট্রোলিয়াম জেলির ছোট কৌটা রাখা ছিল। কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচন কমিশন (ইসি) অন্যান্য নির্বাচনী সরঞ্জামের সঙ্গে পেট্রোলিয়াম জেলি ও টিস্যুও দিয়েছে।

আরসিসি কলেজ পুরুষ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, ভোট গ্রহণের গতি কিছুটা কম। ইভিএমে আঙুলের ছাপ মেলাতে বেগ পেতে হচ্ছে। বয়স্ক ব্যক্তি, খেটে খাওয়া লোকজনের আঙুলের ছাপ মিলছে না।

ভোটাররা গোপন কক্ষে ভোট দিতেও সময় বেশি নেন। সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তারা বাইরে থেকে বলছিলেন, সাদা বাটনে চাপ দিয়ে সবুজটা চাপেন। মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের জন্য পরপর তিনবার সাদা বাটনের পর সবুজ বাটনে চাপ দিতে হয়।

আরও পড়ুন

১৮ নম্বর ওয়ার্ডের মরিয়মনেছা বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে মোস্তফা জামান (৬৪) নামের এক ভোটার ভোট দেওয়া শেষে প্রথম আলোকে বলেন, সাদা বাটনের পর সবুজ বাটনে চাপ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভুল হয়েছে তাঁর। বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন।

ইভিএমে ভোট গ্রহণে ধীরগতির বিষয়ে দুপুরে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মৌখিকভাবে অভিযোগ জানাতে যান জাপা প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান। তবে রিটার্নিং কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন না। মোস্তাফিজার উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, প্রতিটি কেন্দ্রে বয়স্ক নারী ও পুরুষ ভোটাররা সারিতে অপেক্ষা করতে করতে হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন। অনেক ভোটারের কাছে স্মার্ট কার্ড থাকার পরও তাঁরা ভোট দিতে পারেননি।

‘জাপা প্রার্থী সিনক্রিয়েট করেছেন’

ইভিএম ত্রুটির কারণে জাপার মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান নিজেও ভোট দিতে বিড়ম্বনায় পড়েন বলে দাবি করেন। তিনি সকাল ৯টার দিকে নগরের আলমনগর কলেজ রোড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে যান। ভোটকক্ষে প্রায় ১৫ মিনিট অবস্থান করেও ভোট দিতে না পেরে বাইরে চলে যান তিনি। সাংবাদিকদের সামনে ইভিএম নিয়ে হতাশা ও অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখি ইভিএম হ্যাং হয়েছে। আমি ১৫ মিনিটের মতো অপেক্ষা করেও ভোট দিতে পারিনি। এই যদি ইভিএমের অবস্থা হয়, তাহলে মানুষ ভোট দেবে কীভাবে?’ পরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তিনি ভোট দেন।

আরও পড়ুন

তবে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন বলেন, ‘ইভিএমকে বিতর্কিত করতে জাপা প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান ভোট দিতে না পারার “সিন ক্রিয়েট” করেছেন।’

২০১২ সালের ২৮ জুন রংপুর সিটি করপোরেশন গঠন করা হয়। এরপর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর। এতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ প্রথম মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর দ্বিতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মেয়র নির্বাচিত হন।

বিজিবির টহল গাড়িতে আগুন

ভোট গণনার সময় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ব্যবহৃত একটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা এক কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকেরা ওই গাড়িতে আগুন দিয়েছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। তবে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি। অগ্নিকাণ্ডের পর ওই কাউন্সিলর প্রার্থীকে আটক করেছে পুলিশ।

মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটার দিকে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের আমাশু কুকরুল এলাকায় গাড়িটিতে আগুন দেওয়া হয়। যাঁর সমর্থকেরা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাঁর নাম হারাধন রায়। তিনি রংপুরের পরশুরাম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি।

নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে বিজিবি মাইক্রোবাসটি ভাড়া নিয়েছিল। সেটির মালিক ওবায়দুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগুনে আমার গাড়িটি পুরোপুরি পুড়ে গেছে। গাড়িটি যাঁরা ভাড়া নিয়েছিলেন, তাঁদের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করব।’

ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে পরশুরাম থানার ওসি রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হারাধন রায়কে আটক করা হয়েছে। তিনি বর্তমানে পুলিশি হেফাজতে আছেন। ওই ওয়ার্ডের ফল ঘোষণা স্থগিত রাখা হয়েছে।