অন্তর্বর্তী সরকার গুমের ঘটনার বিচার করবে—এমন প্রত্যাশা ছিল বলে মন্তব্য করেছেন গুমের শিকার হওয়া ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) রাজনৈতিক সংগঠক মাইকেল চাকমা। তিনি বলেছেন, কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পেরোনোর পর এই বিচার আর হবে কি না, তা নিয়ে তাঁদের সংশয় আছে।
আজ শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় গুমের শিকার মাইকেল চাকমা এ কথা বলেন।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস-২০২৫ উপলক্ষে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)।
আলোচনা সভায় এইচআরএসএসের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে নিখোঁজ ব্যক্তিদের তথ্য ও ভুক্তভোগী পরিবারের নিরাপত্তা এবং আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক আইন বাস্তবায়ন, গুমের ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত গুম কমিশনকে আরও শক্তিশালী ও স্থায়ী করা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জবাবদিহির আওতায় আনাসহ সাত দফা দাবি তুলে ধরা হয়।
আলোচনা সভায় ধারণাপত্র পাঠ করেন এইচআরএসএসের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম এবং সাত দফা দাবি উপস্থাপন করেন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান।
২০১৫ সালে গুমের শিকার হন মো. আল আমিন ও জেসমিন নাহার দম্পতি। তাঁরাও এই আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে তাঁদের ওপর হওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দেন।
তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় গোপনে চোখ খুলে গুমকারীদের পরিচয় র্যাব–১৩ বলে জানতে পেরেছিলেন জেসমিন নাহার। তিনি বলেন, র্যাব সদস্যরা বিষয়টি দেখে ফেলে। এ কারণে শাস্তি হিসেবে তাঁকে প্রতিদিন দুই বেলা মারধর করা হতো। শরীরে ব্লেড দিয়ে কেটে লবণ লাগানো হতো, ঊরুতে এখনো সেই দাগ আছে।
কোনো নারী দেখতে চাইলে তিনি সেই দাগ দেখিয়ে প্রমাণ দিতে পারবেন জানিয়ে বলেন, ‘এখনো কোনো বিচার পাইনি। উল্টো আগের স্বৈরাচারদের কাছ থেকে হুমকি পাচ্ছি।’
এইচআরএসএসের উপদেষ্টা মো. নূর খান বলেন, গুম কমিশন কিছু কাজ করছে, যা শিগগির প্রতিফলিত হবে। তবে মনস্তাত্ত্বিক যে ফ্যাসিজম আছে, সেটাও বিলুপ্ত করতে হবে।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের এখনো জবাব দেওয়ার মতো কিছু করা যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর এস এম মঈনুল করিম। তিনি বলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, যাতে এই সংস্কৃতি আর কখনো ফিরে না আসে।
আলোচনা সভায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জোবায়ের বলেন, গুমের প্রকৃত চিত্র খুব অল্পই জনসমক্ষে এসেছে। কোনো সভ্য দেশ ও মানুষ এই ঘটনাপ্রবাহ মেনে নিতে পারে না।
জামায়াতে ইসলামী গুমের শিকার ভুক্তভোগী ও পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উল্লেখ করে এহসানুল মাহবুব বলেন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের আইনি, আর্থিক ও সামাজিক সহায়তার পাশাপাশি এই সংস্কৃতি যেন আর ফিরে না আসে, তা নিশ্চিতে কাজ করবেন তাঁরা।
সরকার পরিবর্তনের এক বছর পরেও গুমের শিকার ব্যক্তিরা বঞ্চনার শৃঙ্খল থেকে বের হতে পারেননি বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের আবাসিক অফিসের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান।
সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে হুমা খান বলেন, গুমের শিকার ভুক্তভোগী ও পরিবারকে যেন সার্বিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা হয়। পাশাপাশি গুম সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি রোধে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সব পদক্ষেপ নিতে হবে।
আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, দুই বছর আগে যখন গুম নিয়ে কথা বলা হতো, তখন ভয় কাজ করত। বিচারের কোনো আশা ছিল না। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। তবে ভুক্তভোগীরা যাঁদের কাছে বিচার চাইবেন, সেই প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো পরিবর্তন হয়নি। কাজেই একই পরিস্থিতি আবার আসবে কি না, তা নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে। আর বিচার চাইতে গিয়ে যাতে নতুন কোনো অবিচার না হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
আগামী নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, তা নিয়ে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে নানা তৎপরতা দেখা যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম।
আরিফুল ইসলাম বলেন, তাঁরা ডিজিএফআই ও এনএসআই সংস্কার করার কথা বলেছিলেন। যেসব সদস্য গত ১৫ বছরে খুন-গুমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাঁদের তালিকা করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। কারণ, পুরোনো সেই কাঠামো ঠিক রেখে নির্বাচনে যাওয়া মানে নির্বাচনকে তাঁরা নিজেদের মতো প্রভাবিত করবে।
বিএনপির ‘কুসুম কুসুম বক্তব্য’ এনসিপি সন্দেহের চোখে দেখে উল্লেখ করে এনসিপির এই নেতা বলেন, বিএনপির জোরালো কোনো বক্তব্য দেখা যায় না। তারা যেভাবে নির্বাচন করতে সরকারকে বাধ্য করে, তেমনি এই বিচারকে বাধ্য করার জন্য যতটুকু প্রতিবাদ করা উচিত, মিছিল করা উচিত, বক্তব্য দেওয়া উচিত, তা দেখা যায় না।
আগামী দিনে ক্ষমতার পালাবদল থেকে রাজনীতির প্রতিটি বিষয় রাজনীতিবিদেরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে উল্লেখ করে আরিফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি কোনো এস্টাবলিশমেন্টের নাক গলানোর চেষ্টা আর বরদাশত করা হবে না।
বিএনপি নেতা-কর্মীরা বিগত সময়ে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে উল্লেখ করে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন বলেন, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে যদি বিএনপি সরকার গঠন করে, তাহলে মানবাধিকার, আইনের শাসন ও বাক্স্বাধীনতা নিশ্চিত করেই দেশ পরিচালনা করবে।
বিএনপি শহীদ ও গুম হওয়া পরিবারকে আর্থিক ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেবে। পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের নামে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করবে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিষদ সদস্য মাবরুক মোহাম্মদ, নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, গুমবিষয়ক তদন্ত কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিস, ২০১৭ সালে ধানমন্ডি থেকে নিখোঁজ হওয়া ইশরাক আহমেদের বাবা জামালউদ্দীন আহম্মেদ, ২০১৩ সালে মোহাম্মদপুর থেকে গুমের শিকার হাফেজ জাকিরের ভাই জিয়াউর রহমান, রাজশাহী থেকে গুমের শিকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মহিদুলের ভাই শহীদুল ইসলাম, রাজশাহী থেকে গুম হওয়া গোলাম মর্তুজা, ২০২৩ সালে ধামরাই থেকে গুম হওয়া রহমত উল্লাহ, ২০১৪ সালে রংপুর থেকে গুম হওয়া আবদুল বাসেত, ২০১৪ সালে নীলফামারী থেকে গুমের শিকার আতিকুর রহমানের ভাই আশিকুর রহমান প্রমুখ।