ঘুমানোর সময় আতঙ্কিত হই, পরদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব তো

আফরিন আক্তারছবি: আফরিন আক্তারের কাছ থেকে সংগৃহীত

‘আমি সাহায্য ছাড়া দু–তিন মিনিটের বেশি হাঁটতে পারি না। মাংসপেশিতে ব্যথা, শরীর দুর্বল। শরীর সব সময় কাঁপতে থাকে। দিন যাচ্ছে, আর আমি প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ছি। রাতে ঘুমানোর সময় আতঙ্কিত হই এই ভেবে যে পরের দিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব তো!

জীবন এত কঠিন ছিল না। ছোটবেলায় প্রচুর খেলাধুলা করতাম, ঘুরতে পছন্দ করতাম। ঘুণাক্ষরেও কোনো দিন ভাবিনি আমি এত বড় রোগ বহন করে চলেছি।

ডাক্তার দেখানো শুরু করলাম। কখনো ব্যথার ডাক্তার, কখনো হাড়ের, কখনো হৃৎপিণ্ডের বা স্নায়ুর। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। আমি পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না। এমনও হয়েছে যে এক বছরেও আমি সূর্যের আলো দেখিনি।

২০১৪ সালে আমি নবম শ্রেণিতে উঠি। শরীরে কিছু পরিবর্তন অনুভব করা শুরু করলাম। একটার পর একটা সমস্যা সামনে আসতে থাকল। ডাক্তার দেখানো শুরু করলাম। কখনো ব্যথার ডাক্তার, কখনো হাড়ের, কখনো হৃৎপিণ্ডের বা স্নায়ুর। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। আমি পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না। এমনও হয়েছে যে এক বছরেও আমি সূর্যের আলো দেখিনি।

অনেক ডাক্তার দেখানোর পর ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে আমার মায়োপ্যাথি নামের একটি রোগ ধরা পড়ে। এ রোগ শরীর খুব দ্রুত খারাপ করে ফেলে, আক্রান্ত ব্যক্তি বয়স ২০ বছর হওয়ার আগেই মারা যায়।

আমি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। ঠিক করলাম, আর পড়াশোনা করব না। নবম শ্রেণির পুরো এক বছর স্কুলে যাইনি। বার্ষিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলাম। শ্রেণিশিক্ষিকা দয়া করে আমাকে দশম শ্রেণিতে উঠিয়ে দেন। তখন ভাবলাম ঘরে আবদ্ধ থেকে মরার চেয়ে পড়াশোনা করা ভালো।

আরও পড়ুন

অনেক ডাক্তার দেখানোর পর ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে আমার মায়োপ্যাথি নামের একটি রোগ ধরা পড়ে। এ রোগ শরীর খুব দ্রুত খারাপ করে ফেলে, আক্রান্ত ব্যক্তি বয়স ২০ বছর হওয়ার আগেই মারা যায়। আমি দ্বিতীয় ধাক্কা খেলাম।

২০১৯ সাল পর্যন্ত আমাকে ওই রোগেরই চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। শরীরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের মতো থেরাপি দেওয়া হয়েছে। শরীরে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। ছোট্ট বয়সে আমি বয়স্ক মানুষের মতো হয়ে গেছি। জীবনের অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে আমাকে। আমি চেয়েছিলাম মরে গেলেও আমি উচ্চশিক্ষিত হয়েই মরব। পড়াশোনা বন্ধ করিনি।এসএসসিতে আমি গোল্ডেন এ+ পাই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এখানে ভর্তির পর প্রথম আলোর সাংবাদিক শাকিলা হক আপুর সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁর ভাই চিকিৎসক। তাঁর সহযোগিতায় পিজি হাসপাতালে (বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) মেডিকেল বোর্ড বসানো হয়।

ঢাকা বোর্ড থেকে সরকারি মেধা বৃত্তি পাই। এইচএসসিতে এ+ পাই। ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় প্রথম স্থান দখল করি। জীবনে যতটুকু সাফল্য পেয়েছি, তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আমার বোন আর মায়ের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এখানে ভর্তির পর প্রথম আলোর সাংবাদিক শাকিলা হক আপুর সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁর ভাই চিকিৎসক। তাঁর সহযোগিতায় পিজি হাসপাতালে (বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) মেডিকেল বোর্ড বসানো হয়। প্রথম জানতে পারলাম, আমি স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রোফি (এসএমএ) নামের বিরল রোগে আক্রান্ত। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো জেনেটিক টেস্ট ছিল না, তাই টাইপ কত, এটা জানতে পারিনি। পরে সেটা জানতে পারি। এর আগে দু–তিন বছর আমার ভুল চিকিৎসা হয়েছিল।

এসএমএ রোগ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। কারণ ডাক্তার বলেছে, এ রোগের চিকিৎসা নেই। তাই আমি নিজেকেই সহায়তা করার জন্য নেমে পড়লাম। ওষুধ নেই কিন্তু থেরাপি আমাকে ভালো রাখতে পারবে। এমন চিন্তা থেকে নিজেকে প্রস্তুত করেছি, এগিয়ে নিয়েছি। এর মধ্যে আমি প্রথম শ্রেণিতে এলএলবি পাস করি।

প্রথম জানতে পারলাম, আমি স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রোফি (এসএমএ) নামের বিরল রোগে আক্রান্ত। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো জেনেটিক টেস্ট ছিল না, তাই টাইপ কত, এটা জানতে পারিনি। পরে সেটা জানতে পারি। এর আগে দু–তিন বছর আমার ভুল চিকিৎসা হয়েছিল।

একপর্যায়ে রিজডিপলাম নামের ওষুধের সন্ধান পাই। কিন্তু এমন এক দামি ওষুধ, যা এই জীবনে কিনে খাওয়ার ভাগ্য হবে কি না, আল্লাহ ভালো জানেন। কিউর এসএমএ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের খোঁজ পেলাম, ২০২৪ সালে। পরিচিত হওয়ার পর দেখলাম আমার মতো অনেক রোগী এখানে আছে। আমার চেয়ে তাদের অবস্থা আরও খারাপ।

আমি ইতিমধ্যে এলএলএম পাস করেছি। বার কাউন্সিল পরীক্ষায় লিখিত পরীক্ষা দিয়েছি। কিউর এসএমএ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের একজন নির্বাহী সদস্য হিসেবে আছি। এসএমএ রোগীদের প্রতিনিধিত্ব করছি বিভিন্ন জায়গায়, কেননা জীবিত রোগীদের মধ্যে আমিই একমাত্র যে পড়াশোনা শেষ করেছি। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার নতুন একটি পরিচয় হয়েছে, আমি একটি চাকরি পেয়েছি। ভাবি আমার এই শরীর বাধা হয়ে দাঁড়াবে না তো?

[প্রথম আলো রোগী ও রোগীর অভিভাবকদের অনুমতি নিয়ে নাম এই প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে।]