পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফরে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ অগ্রাধিকার ও মিয়ানমার পরিস্থিতি গুরুত্ব পেয়েছে

নয়াদিল্লিতে গত ৭ অক্টোবর বৈঠক করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করফাইল ছবি

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর এক মাসের মাথায় হাছান মাহমুদ ৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে ভারতে যান। সফরের প্রথম দিন সন্ধ্যায় তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। তাঁরা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের বর্তমান ধারা অব্যাহত রেখে ভবিষ্যৎ ক্ষেত্রে বা অগ্রাধিকারের বিষয়ে কথা বলেছেন।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো গত শনিবার এই প্রতিবেদককে আভাস দিয়েছে, আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের চলমান ঘটনাপ্রবাহ দুই দেশে কীভাবে, কতটা প্রভাব ফেলছে, সেটিও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশাপাশি দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁদের আলোচনার অন্যতম ইস্যু মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতি ছিল বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।

কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সফরটির বিশেষ রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সমালোচনার মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচন আয়োজনে ভারতের জোরালো সমর্থন ছিল। ভারতকে এ নিয়ে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি দেশটির নির্বাচনের পর ভবিষ্যতে সহযোগিতার কোথায় কোথায় গুরুত্ব দেওয়া হবে, সেটিও এ সফরের বিভিন্ন আলোচনায় উঠে এসেছে।

কূটনীতিক সূত্রে জানা গেছে, দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা হয়েছিল এক ঘণ্টার বেশি। এর মধ্যে তাঁরা মিনিট বিশেক কথা বলেন একান্তে। এক দেশে নির্বাচন শেষ এবং অন্য দেশে কয়েক মাসের মধ্যে নির্বাচন, এমন এক পরিস্থিতিতে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে নানা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও সিদ্ধান্তের সুযোগ কম। সে ক্ষেত্রে ভারতে নির্বাচন শেষে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ পথনকশা কিংবা অগ্রাধিকার কোথায় কোথায় হতে পারে, তা নিয়ে দুই মন্ত্রী রাজনৈতিক সম্পর্কের নিরিখে আলোচনা করেছেন।

আরও পড়ুন

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বৈঠকের পর দুই দেশ আলাদাভাবে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ব্যবসা ও বাণিজ্য, সংযুক্তি, বিদ্যুৎ, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং পানিসম্পদ বণ্টনে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গভীর ও উচ্চ মানের সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছেন। হাছান মাহমুদ বাংলাদেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম, বিশেষ করে রোজার মাসে স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে এস জয়শঙ্করকে অনুরোধ করেছেন।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আন্তসীমান্ত সংযোগ; অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন অংশীদারত্ব; প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা; বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পানিসম্পদ; জনগণের মধ্যে মেলবন্ধনসহ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিস্তৃত ক্ষেত্রের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। তাঁরা দুজন ‘বিকশিত ভারত ২০৪৭’ ও ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’–এর রূপকল্পসহ দুই দেশের জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সহযোগিতার ভবিষ্যৎ ক্ষেত্রগুলো নিয়েও আলোচনা করেছেন।

প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীর সংঘাত চরম আকার ধারণ করায় তা ভারতকে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এ জন্য মিয়ানমারে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে পাশে নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছে ভারত। এ বিষয়ে আলোচনার জন্য ৩ ফেব্রুয়ারি নীরবে ঢাকা সফর করেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। ওই দিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। অজিত দোভালের সংক্ষিপ্ত বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশের সম্পর্কের নানা বিষয়ের পাশাপাশি মিয়ানমার পরিস্থিতি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে বলে জানা গেছে।

অবশ্য ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল গত বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানাতে অজিত দোভাল ঢাকা সফর করেন।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতের ভৌগোলিক অবস্থানটা এমন যে পুবের দেশটির সাম্প্রতিক অস্থিরতা দুই দেশের জন্যই দুশ্চিন্তার কারণ। বিশেষ করে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো যেভাবে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্ত আছে, তাতে করে সেখানকার গৃহযুদ্ধের ধাক্কা দুই দেশে ছায়া ফেলতে পারে। এ জন্য ভারত সমন্বিতভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশকে জোরালোভাবে পাশে চায়। তা ছাড়া মিয়ানমারের সাম্প্রতিক অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে চীনের ভূমিকাও অজানা নয়। সব মিলিয়ে মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে গত এক সপ্তাহে ঢাকা ও দিল্লিতে নানা পর্যায়ের আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গে হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন থেকে শুরু করে বিস্তারিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। মিয়ানমারের বিরাজমান পরিস্থিতিতে এ অঞ্চলের শান্তি নিশ্চিত করতে তারা কীভাবে একসঙ্গে কাজ করবে, সে বিষয়েও দুই পক্ষ আলোচনা করেছে।’

দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলোচনায় তিস্তার প্রসঙ্গ এসেছে। বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের বিজ্ঞপ্তিতে। এ নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সাবেক এক কূটনীতিক মন্তব্য করেছেন, নিজেদের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া শেষ করার আগে ভারত তিস্তা চুক্তি করার সুযোগ পাবে না। তবে আলোচনায় বাংলাদেশ এটি তুললে ভারতের পক্ষ থেকে চীনের তিস্তা প্রকল্প নিয়ে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন অমূলক নয়। বিশেষ করে তিস্তার মতো অভিন্ন নদীতে চীন কোনো বৃহদায়তন প্রকল্প করলে তা ভারতের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পর্বে চীন তিস্তা নিয়ে প্রস্তাব দেওয়ার পর থেকে ভারতের সরকারি ও বেসরকারি দুই মহলেই প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও দিল্লি ইউনিভার্সিটির বঙ্গবন্ধু চেয়ার মো. শহীদুল হক শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সদ্য সমাপ্ত সফরটির রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর তাঁর প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরের মধ্য দিয়ে সম্পর্কের ভবিষ্যতের বিষয়ে ভারতের কাছে বিশেষ বার্তা দেওয়া হলো। এ ধরনের সফরে সম্পর্কের সব বিষয়ের খুঁটিনাটি আলোচনার সুযোগ নেই। তবে সামনের দিনের অগ্রাধিকারের ইঙ্গিত থাকে। আর মিয়ানমারের পরিস্থিতির বিবেচনায় নিলে নিরাপত্তার দিক থেকে এই সফরের আলাদা তাৎপর্য আছে।