নিশাত মজুমদার
ছবি: সাজিদ হোসেন

প্রথম আলো: ২০২০ সাল বাদে ২০০৬ সাল থেকে প্রতিবছর পর্বতারোহণ করছেন। এভারেস্ট জয়ের পর ৮ হাজার মিটারের বেশি উচ্চতার শিশাপাংমা পর্বতের ক্যাম্প-১ পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন ২০১৩ সালে। একটা লম্বা সময় পর আবার ৮ হাজার মিটারের বেশি উচ্চতার পর্বতারোহণে যাচ্ছেন। কেমন লাগছে?

নিশাত মজুমদার: পাহাড়ে যাওয়ার অনুভূতি আমার কাছে বাড়ি যাওয়ার মতো বিষয়। পাহাড় আমাকে সব সময় ডাকে। আসলে প্রকৃতি সবাইকেই ডাকে। সেই ডাক কেউ শুনতে পায়, কেউ পায় না। করোনাকাল ছাড়া প্রতিবছর কোনো না কোনো পাহাড়ে গেছি। সেগুলো সেভাবে মানুষের সামনে আসেনি। পাহাড়ে যাওয়ার জন্য স্পনসর নিলে প্রচারের প্রয়োজনে মানুষের সামনে আসতে হয়। এভারেস্ট শৃঙ্গ স্পর্শের আগে প্রস্তুতি হিসেবে ২০১১ সালে মানাসলু আরোহণের চেষ্টা করেছিলাম। সেবার ৭ হাজার ২০০ মিটার পর্যন্ত পৌঁছেছিলাম। তখন থেকেই মানাসলু পর্বতশৃঙ্গ স্পর্শের স্বপ্ন।

পর্বত আরোহণের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন?

নিশাত মজুমদার: ২০০৩ সালে বিশ্বজুড়ে এভারেস্টজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিভিন্ন দেশ নানা উদ্যোগ নিচ্ছিল। এর অংশ হিসেবে কেওক্রাডং আরোহণের উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে সে খবর জানতে পারি। অভিযাত্রী দলের সঙ্গে যোগ দিই। সেটাই ছিল প্রথম পাহাড়ে চড়ার অভিজ্ঞতা। ইনাম আল হক (অ্যান্টার্কটিকাফেরত অভিযাত্রী ও প্রকৃতিবিশেষজ্ঞ) পাহাড় আরোহণের স্বপ্নটা আরও বিস্তৃত করতে অনুপ্রেরণা দেন।

এভারেস্টজয়ের প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছিলেন?

নিশাত মজুমদার: বড় পাহাড়গুলো আরোহণ একদিনে হয় না। এর আগে বহু বছর ছোট ছোট পাহাড়ে ওঠার অভিজ্ঞতাকে মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়। ছোট পাহাড়ে যাওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে হয়। দেশে মাটির পাহাড়। তাই পাথুরে পাহাড়ে আরোহণের প্রশিক্ষণের জন্য দেশের বাইরে যেতে হয়েছে। এসব প্রশিক্ষণ বড় পাহাড় জয়ে শারীরিক-মানসিক সক্ষমতা অর্জনের যোগ্যতা বাড়িয়ে তুলেছে। এভারেস্ট শৃঙ্গ স্পর্শের আগে ২০০৬ সালে পাঁচ বাংলাদেশি নারীর সঙ্গে এভারেস্টের বেসক্যাম্প (৫,৩৫০ মিটার) পর্যন্ত পৌঁছেছিলাম। তারও আগে দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ পাহাড় বান্দরবানের কেওক্রাডং আরোহণ করি।

এভারেস্ট আরোহণ করতে গিয়ে অনেকে মারা গেছেন। আপনার কি কখনো মৃত্যুভয় কাজ করেছে?

নিশাত মজুমদার: মৃত্যু ভয় থাকে। তারপরও পাহাড়ের কী যে এক আকর্ষণ! এটা অন্য রকম এক হাতছানি। এ হাতছানি উপেক্ষা করা কঠিন। যতবার পাহাড়ে যাই, মনে মনে শেষ বিদায় নিয়ে যাই। এভারেস্টে মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখেছি। একদিন ক্যাম্প–১ ও ২-এর মাঝামাঝি থাকার সময় তুষার ঝড় আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আমি বরফে হারিয়ে যাই। প্রথমে সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকি। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বুঝতে পারি আশপাশে কেউ নেই। হাত দিয়ে বরফ খুঁড়ে, সারা শরীরের শক্তি দিয়ে বরফ সরিয়ে উঠে আসি। অনেকবারই এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি।

গত শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে মানাসলু শৃঙ্গ অভিযানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে যাওয়া নিশাত মজুমদারের হাতে জাতীয় পতাকা দেওয়া হয়
ছবি: সাজিদ হোসেন

ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে আপনিসহ চার এভারেস্টজয়ীর নাম উল্লেখ আছে। কেমন অনুভূতি হয়?

নিশাত মজুমদার: এটা অবশ্যই খুব সম্মানের। তবে আমার মনে হয়, এখনো ততখানি যোগ্যতা অর্জন করা হয়নি।

আরও পড়ুন

এবার মানাসলু অভিযানে যাচ্ছেন নিশাত মজুমদার

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনাকে কম দেখা যায় কেন?

নিশাত মজুমদার: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত কিছু দিই না। আর আমার মনে হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটু কম থাকাই ভালো। নিয়ন্ত্রিত পদচারণ থাকা ভালো। মানুষের জীবনে স্থিরতার প্রয়োজন আছে। এই মাধ্যমে বেশি অবস্থান করলে তা মানুষের মনকে বিক্ষিপ্ত করতে পারে। এ কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভালো দিকটা গ্রহণ করতে হবে, আর খারাপ দিকটা সম্পর্কে বুঝতে হবে।

আপনার বিষয়ে একটি কথা প্রচলিত। আপনাকে একদম সাধারণ বাঙালি নারী মনে হয়। অথচ আপনি পাহাড় আরোহণের দুঃসাহসী কাজ করেন।

নিশাত মজুমদার: এ মন্তব্য অনেক শুনতে হয়। এ নিয়ে আমার মিশ্র অনুভূতি কাজ করে। কথায় বলে, ‘প্রথমে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারি’। আমার ক্ষেত্রে ‘আগে দর্শনধারী’ বললে আমাকে বোঝা যাবে না। গ্রামের মেয়েরাও সাধারণ। কিন্তু তাঁদের মনের ভেতরও অনেক ক্ষমতা লুকিয়ে আছে। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর আমার মায়ের বিয়ে হয়ে যায়। আমার মায়ের মধ্যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার অদম্য আকাঙ্ক্ষা দেখেছি। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, কোনো একটা কিছু আমি পারব না বললেই মা বলতেন, ‘অবশ্যই পারবে। অন্যদের কি দুটো মাথা? অন্যরা পারলে তুমিও পারবে।’ মা আমার জন্য বড় অনুপ্রেরণা।

মানাসলু অভিযানে আপনার সঙ্গী হচ্ছেন প্রজ্ঞা পারমিতা রায় নামে নবীন এক পর্বতারোহী। মেয়েদের মধ্যে পর্বতারোহণে কেমন আগ্রহ দেখেন?

নিশাত মজুমদার: একা পর্বত আরোহণ করে আসার কোনো মানে থাকে না, যদি অন্য কাউকে যুক্ত না করি। তাই নবীন পর্বতারোহীদের সুযোগ দিতে ‘অভিযাত্রী’ (নিশাত মজুমদার এই সংগঠনের সহপ্রতিষ্ঠাতা) নতুনদের আবেদন করার আহ্বান জানিয়েছিল। আবেদনপত্রগুলো যাচাই-বাছাই শেষে ২৪ জন মেয়ের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। তাঁদের মধ্য থেকে নয়জনকে সিলেটের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় কালাপাহাড় আরোহণে নিয়ে যাওয়া হয়। চূড়ান্তভাবে একজনকে নির্বাচিত করা হয়েছে। আমি বলব, সব মেয়ের মধ্যে সম্ভাবনা দেখেছি। যেহেতু হিমালয়ে যাওয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল, তাই একজনকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হয়েছে। পর্বতারোহী তৈরিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে গ্রাম থেকে সাধারণ মেয়েদের তুলে আনতে হবে, যেভাবে ফুটবল, ক্রিকেটের জন্য প্রান্তিক মেয়েদের নিয়ে আসা হয়। আর নারী পর্বতারোহীদের জন্য পরিবারের সহায়তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

নিশাত মজুমদার এখন মেয়েদের জন্য এক অনুপ্রেরণার নাম। বিষয়টি কীভাবে দেখেন?

নিশাত মজুমদার: দেশের পর্বতারোহী তাজিয়া সুলতানা শম্পার ছবি দেখে আমি পাহাড় আরোহণে উৎসাহিত হয়েছিলাম। ইচ্ছা হয়েছিল, একদিন যদি এভাবে আমার ছবি ছাপা হতো! আমাকে দেখে যদি কোনো মেয়ে উৎসাহিত হয়, সেটা হবে আমার জন্য বড় অর্জন। মহেশখালীর একটি ছোট্ট মেয়ের কথা প্রায়ই মনে পড়ে, যে খামের ওপর শুধু ‘নিশাত মজুমদার, ঢাকা সিটি করপোরেশন’ ঠিকানা লিখে চিঠি পাঠিয়েছিল। আশ্চর্যজনকভাবে ডাকপিয়ন শুধু নাম দেখেই আমাকে চিঠি দিয়ে গিয়েছিলেন। ছোট্ট মেয়েটি চিঠিতে আমাকে নিয়ে তার ভালো লাগার কথা জানিয়েছিল। এই সাক্ষাৎকার দেখে যদি একটি মেয়েও পর্বতারোহী হতে আগ্রহী হন, তাহলে সেটা আমার জন্য এক বড় প্রাপ্তি হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

নিশাত মজুমদার: আপনাকেও ধন্যবাদ।