সভাপতি পদে বিএনপির মাহবুব উদ্দিন ও সম্পাদক পদে আ.লীগের শাহ মঞ্জুরুল জয়ী

এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ও শাহ মঞ্জুরুল হক
ছবি: সংগৃহীত

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেলের (নীল প্যানেল) প্রার্থী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের (সাদা প্যানেল) প্রার্থী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক।

গণনা শেষে সমিতির মিলনায়তনে শনিবার রাত সোয়া একটার দিকে নির্বাচন পরিচালনা–সংক্রান্ত উপকমিটির আহ্বায়ক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবুল খায়ের এই ফলাফল ঘোষণা করেন।

ভোট গণনা কখন হবে তা নিয়ে বাদানুবাদ, হট্টগোল ও মারধরের ঘটনায় শুক্রবার সকালে থমকে যায় গণনা, এরপর মামলা ও মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেওয়া—এমন সব ঘটনার মধ্যে ভোট গ্রহণ শেষের প্রায় ৪৬ ঘণ্টা পর শনিবার বিকেলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ভোট গণনা শুরু হয়।

সভাপতি, সহসভাপতি (দুটি), সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, সহসম্পাদক (দুটি), সদস্যের সাতটি পদসহ মোট ১৪টি পদে এক বছর মেয়াদের জন্য এই নির্বাচন হয়ে থাকে। ১৪ পদের মধ্যে সভাপতি ও সদস্যের তিনটি পদসহ চারটি পদে নীল প্যানেলের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। অন্যদিকে সহসভাপতির দুটি পদ, সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ ও সহসম্পাদকের দুটি পদসহ সদস্যের চারটিসহ দশটি পদে জয় পেয়েছেন সাদা প্যানেলের প্রার্থীরা।

ঘোষিত ফলাফল অনুসারে সভাপতি পদে নীল প্যানেলের এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ২ হাজার ৬২২ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাদা প্যানেলের আবু সাঈদ সাগর ২ হাজার ৫৩৯ ভোট পেয়েছেন।

ঘোষিত ফলাফল অনুসারে, সম্পাদক পদে সাদা প্যানেলের শাহ মঞ্জুরুল হক ৩ হাজার ৩১৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। এই পদে নীল প্যানেলের মো. রুহুল কুদ্দুস (কাজল) ১ হাজার ৭০২ ভোট পেয়েছেন। দুই প্যানেলের বাইরে সম্পাদক পদপ্রার্থী নাহিদ সুলতানা (যুথী) পেয়েছেন ২৬৯ ভোট।

সাদা প্যানেল থেকে সহসভাপতি পদে রমজান আলী শিকদার ও দেওয়ান মো. আবু ওবাঈদ হোসেন, কোষাধ্যক্ষ পদে মোহাম্মদ নুরুল হুদা আনসারী, সহসম্পাদকের দুটি পদে মো. হুমায়ুন কবির ও মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির জয়ী হয়েছেন।

সদস্য সাতটি পদের মধ্যে চারটি পেয়েছে সাদা প্যানেলের প্রার্থীরা। তারা হলেন মো. বেলাল হোসেন, খালেদ মোশাররফ, মো. রায়হান রনি ও রাশেদুল হক খোকন। সদস্যের অপর তিনটি পদ পেয়েছে নীল প্যানেলের প্রার্থীরা। তারা হলেন ফাতিমা আক্তার, মো. শফিকুল ইসলাম শফিক ও সৈয়দ ফজলে এলাহী।

৪৬ ঘণ্টা পর ভোট গণনা শুরু

শুক্রবার ভোরের ঘটনায় আটকে যাওয়া ভোট গণনা শনিবার দুপুর থেকে শুরু হবে বলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন পরিচালনা–সংক্রান্ত উপকমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়। তবে ভোট গ্রহণ শেষের প্রায় ৪৬ ঘণ্টা পরে বেলা তিনটার দিকে সমিতি ভবনের মিলনায়তন ও তিনটি হলরুমে একযোগে ভোট গণনা শুরু হয়।

বেলা তিনটার দিকে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের প্রবেশপথে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্যের উপস্থিতি দেখা যায়। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর আগত ব্যক্তিদের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিতে দেখা যায়। সমিতি ভবনে প্রবেশেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। সমিতি ভবনের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি দেখা যায়।

ঘটনার সূত্রপাত যা নিয়ে

সমিতির নির্বাচনে গত বুধবার (৬ মার্চ) ও বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) ভোট গ্রহণ হয়। দুই দিন সকাল ১০টা থেকে মাঝে দুপুরে এক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে বিকেল ৫টা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ১৪টি পদের বিপরীতে সমিতির এবারের নির্বাচনের (২০২৪-২৫) ৩৩ জন প্রার্থী হন। ৭ হাজার ৮৮৩ ভোটারের মধ্যে দুই দিনের নির্বাচনে ৫ হাজার ৩১৯ জন ভোট দেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, বৃহস্পতিবার ভোট গ্রহণ শেষে সমিতির মিলনায়তনে ভোট বাছাই প্রক্রিয়া শেষ হয় সেদিন দিবাগত রাত দুইটার পর। এর আগে কোনো কোনো প্রার্থী ব্যালটের সঙ্গে মুড়ির মিল না থাকার কথা উল্লেখ করে আপত্তি তোলেন। এ নিয়ে বাদানুবাদ ও হট্টগোল হয়। পরে ভোট গণনা শুরু করা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। সন্ধ্যার পরপরই সমিতি ভবনের বিভিন্ন স্থানে বহিরাগতদের অবস্থান করতে দেখা যায়। সম্পাদক পদে নাহিদ সুলতানা ও বিএনপি–সমর্থিত নীল প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী রুহুল কুদ্দুসসহ কয়েকজন রাতেই ভোট গণনার পক্ষে মত দেন। তবে এত রাতে প্রার্থীদের এজেন্ট না থাকার কথা উল্লেখ করে সাদা প্যানেলের সম্পাদক পদপ্রার্থী শাহ মঞ্জুরুল হকসহ কয়েকজন প্রার্থী শুক্রবার দিনের বেলায় ভোট গণনার পক্ষে মত দেন। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বাদানুবাদ ও হট্টগোল হয়।

সেখানে উপস্থিত একাধিক আইনজীবী জানান, একপর্যায়ে কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয় যে ব্যালটগুলো সিলগালা করে রাখা হবে। শুক্রবার দুপুরের পর ভোট গণনা হবে। তবে শুক্রবার ভোট গণনা নিয়ে আপত্তি জানান একাধিক প্রার্থী। শুক্রবার ভোরের দিকে উপস্থিত একজন আইনজীবী মিলনায়তন থেকে বের হওয়ার ফটক খুলে দিতে গেলে তাতে আপত্তি জানান উপকমিটির একজন সদস্য। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে বাদানুবাদ ও হট্টগোল হয়। একপর্যায়ে বেশ কয়েকজন বহিরাগত ব্যক্তি সমিতি মিলনায়তনে ঢুকে পড়েন। মারধরের শিকার হন নির্বাচন পরিচালনা–সংক্রান্ত উপকমিটির সদস্য ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এস আর সিদ্দিকী সাইফসহ আরও কয়েকজন আইনজীবী।

মারধরের ঘটনায় মামলা, গ্রেপ্তার ও রিমান্ড

ভোট গণনা কেন্দ্র করে হট্টগোল, হাতাহাতি ও মারাপিটের ঘটনায় সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এস আর সিদ্দিকী সাইফ তাঁকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে শুক্রবার বিকেলে শাহবাগ থানায় মামলা করেন। এই মামলায় আইনজীবী নাহিদ সুলতানা (যুথী) ও বিএনপি-সমর্থিত প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী মো. রুহুল কুদ্দুসসহ (কাজল) ২০ জনকে আসামি করা হয়। নাহিদ সুলতানা যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামসের (পরশ) স্ত্রী।

এই মামলায় নাহিদ সুলতানার বাসায় পুলিশ একাধিকবার অভিযান চালালেও তাঁকে পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা। অন্যদিকে শুক্রবার রাতে রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে আইনজীবীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে শনিবার আদালতে পাঠানো হয়। শুনানি শেষে আদালত তাঁদের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। সন্ধ্যায় আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুসকে গ্রেপ্তার করা হয়, তিনি বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যও।

‘চাপ সৃষ্টি করে লিখিত দিতে বাধ্য করা হয়’

নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়ক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবুল খায়ের শনিবার লিখিত এক বক্তব্যে বলেছেন, ‘একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ভোট গণনার আগেই দুঃখজনকভাবে বহিরাগত মাস্তান শ্রেণি কর্তৃক আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করে লিখিত দিতে বাধ্য করা হয়। যদিও তা অর্থহীন ঘোষণা, তবু কূটতর্ক নিরসনের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সবাইকে তা “ইগনোর” করার জন্য অনুরোধ করা হলো। ভোট গণনা করেই ফলাফল ঘোষণা করা হবে।’

এর আগে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে হট্টগোল ও শুক্রবার ভোরে মারধরের ঘটনার পর আবুল খায়েরের বক্তব্যের একটি ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায়, সমিতির মিলনায়তনে তিনি বলেছেন, ‘শুধুমাত্র নাহিদ সুলতানা (যুথী) সম্পাদক প্রার্থী উপস্থিত ছিলেন। তাই তাঁকে সম্পাদক পদে নির্বাচিত ঘোষণা করা হলো।’

আরও পড়ুন