আয় কমেছে ৩৭% মানুষের, ব্যয় বেড়েছে বেশির ভাগের

সবচেয়ে বড় আঘাত খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি। মানুষের সহায়তা দরকার, তবে তা পান প্রতি ১০ জনের ১ জন।

বেশির ভাগ মানুষের সংসার চালানোর ব্যয় বেড়েছে
প্রথম আলো ফাইল ছবি

দেশের বেশির ভাগ মানুষের সংসার চালানোর ব্যয় বেড়ে গেছে। বিপরীতে একটি বড় অংশের মানুষের আয় কমেছে। কিছু মানুষ আছেন যাঁদের আয় কমে যাওয়ায় তাঁরা পারিবারিক সম্পদ বিক্রি করে খাদ্য কিনছেন। আবার কেউ কেউ ভিক্ষাবৃত্তি অথবা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক মাসিক প্রতিবেদনে মানুষের আয় কমা, ব্যয় বৃদ্ধি ও খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও বিপন্নতা পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন ২২ নভেম্বর প্রকাশ করা হয়।

প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে, সেপ্টেম্বর মাসে ৩৭ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। আয় কমার কারণ কেউ চাকরি হারিয়েছেন, কেউ প্রতিদিন কাজ পাচ্ছেন না, আবার কারও আয় কমেছে পণে৵র মূল্যবৃদ্ধি ও আগের চেয়ে কম সহায়তা পাওয়ার কারণেও। ব্যয় বেড়েছে ৮৮ শতাংশ মানুষের।

মাসের পর মাস খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকলে এবং মানুষের আয় না বাড়লে, তা সামগ্রিকভাবে দেশে সামাজিক সমস্যা বাড়াবে।
নাজনীন আহমেদ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) কান্ট্রি ইকোনমিস্ট

ডব্লিউএফপি গত জুলাই থেকে এই প্রতিবেদন প্রতি মাসে প্রকাশ করে আসছে। টেলিফোন সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে ১ হাজার ২০০ মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনে কয়েকটি ইতিবাচক দিক রয়েছে। সেগুলো হলো মাঝারি ও মারাত্মক খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় থাকা মানুষের হার কমেছে। জুলাইয়ে যে হার ২৯ শতাংশ ছিল, তা কমে সেপ্টেম্বরে হয়েছে ১৭ শতাংশ। খাবার কিনতে ধার করা, চিকিৎসকের কাছে না যাওয়ার মতো খাপ খাওয়ানোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হওয়া মানুষের হারও কিছুটা কমেছে। সেপ্টেম্বরে চাপে বা সংকটে পড়ে ওই ধরনের কৌশল নিতে বাধ্য হওয়া মানুষের হার দাঁড়িয়েছে ৩৪ শতাংশ। জুলাইয়ে তা ছিল ৪৮ শতাংশ।

আরও পড়ুন

এমন দু–একটি ইতিবাচক দিকের পরও দেখা যাচ্ছে, মানুষের একটি বড় অংশ এখনো চাপে অথবা সংকটে রয়েছে। জরিপে উঠে আসে, ৮০ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তাঁদের জন্য এই সময়ে বড় আঘাত খাদ্যের চড়া দাম। জ্বালানি তেলের মূল্য ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, অসুস্থতা ও চিকিৎসার ব্যয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ রয়েছে এর পরে।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) কান্ট্রি ইকোনমিস্ট নাজনীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মাসের পর মাস খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকলে এবং মানুষের আয় না বাড়লে, তা সামগ্রিকভাবে দেশে সামাজিক সমস্যা বাড়াবে।

এ ধরনের আর্থিকসংকটে মানুষ পুষ্টিকর খাবার কেনা কমিয়ে দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম দামি খাবার কেনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। এসব খাবারে সাধারণত পুষ্টিকর উপাদান কম থাকে এবং শর্করা বেশি থাকে, যা একজন মানুষের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার পথে বাধা তৈরি করে।
নাজমা শাহীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক

ডব্লিউএফপির জরিপে উঠে আসা জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই তিন মাসে সবচেয়ে বেশি মানুষের আয় কমেছিল আগস্টে, ৪৩ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে (৩৭ শতাংশ), তবে জুলাইয়ের পর্যায়ে ওঠেনি। জুলাইয়ে আয় কমার হার ছিল ৩৩ শতাংশ। এই তিন মাসে ৫১ থেকে ৬৩ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তাঁদের আয় অপরিবর্তিত রয়েছে। আয় বেড়েছে খুব সামান্য সংখ্যক মানুষের। সেপ্টেম্বরে ৯ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তাঁদের আয় বেড়েছে।

আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ৮৮ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তাঁদের ব্যয় বেড়েছে। কিছু মানুষের ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন নেই। সামান্য কিছু মানুষের ব্যয় কমেছে বলে জানিয়েছেন।

জরিপে বিভাগওয়ারি খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। দেখা যায়, সিলেট বিভাগের শতভাগ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার (আংশিক, মাঝারি ও মারাত্মক) মধ্যে রয়েছেন। মাঝারি ও মারাত্মক খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় থাকা মানুষের হার বরিশাল বিভাগে ২৬, খুলনায় ২২, চট্টগ্রামে ১৮, রংপুরে ১৭, ঢাকায় ১৩, রাজশাহীতে ১২ ও ময়মনসিংহে ৯ শতাংশ। মাঝারি ও মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা থাকা মানুষের জাতীয় গড় হার ১৭ শতাংশ।

এখন মানুষের চার ধরনের সহায়তা দরকার বলে ডব্লিউএফপি চিহ্নিত করেছে। খাদ্যসহায়তা দরকার ৪২ শতাংশ মানুষের। জীবিকার উপায় ৪৬, স্বাস্থ্যসহায়তা ২৬, শিক্ষা ১৭ ও বাসস্থানের সহায়তা দরকার ৯ শতাংশ মানুষের।

জরিপে আর্থিক ও খাদ্যসংকটে থাকা মানুষের কত অংশ সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পাচ্ছেন, তার হিসাব তুলে ধরা হয়। দেখা যায়, সংকটে থাকা প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন এ ধরনের সহায়তা পাচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের আর্থিকসংকটে মানুষ পুষ্টিকর খাবার কেনা কমিয়ে দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম দামি খাবার কেনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। এসব খাবারে সাধারণত পুষ্টিকর উপাদান কম থাকে এবং শর্করা বেশি থাকে, যা একজন মানুষের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার পথে বাধা তৈরি করে।