আলী আজম, বিলকিস বানু ও জাফর পানাহিদের সংগ্রাম যে বার্তা দিচ্ছে

ইরানে নারীদের গণ–অভ্যুত্থানকে ‘গণমৃত্যুদণ্ডের’ পাল্টা আঘাতে বিধ্বস্ত করার চেষ্টা চলছে এ মুহূর্তে। এই গণ–অভ্যুত্থান কীভাবে শুরু হয়েছিল, সেটা ইতিমধ্যে সবার জানা। কিন্তু এই আন্দোলন গণমৃত্যুদণ্ডের ভয়াবহতায় শেষ হয়ে যাবে কি না, সেটা বলা মুশকিল। এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে দেশটির বহু শিল্পী, সাহিত্যিকও কারাগারে এখন। সর্বশেষ আটক হলেন তারকা অভিনেত্রী তারানেহ আলিদুস্তি। তারও আগে থেকে বন্দী অনেকে। তাঁদেরই একজন জাফর পানাহি। সিনেমা পরিচালক হিসেবে তিনি বিশ্বখ্যাত।

তারানেহ আলিদুস্তি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

পানাহি তাঁর সব কাজকে ‘একধরনের প্রতিরোধ’ বলতেন। ফলে এটা বিস্ময়কর নয়, তিনি যখন কারাগারে, তখন ভেনিসে প্রদর্শিত হচ্ছিল তাঁর নো বিয়ার্স। এ বছর পুরোপুরি কারারুদ্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত জাফর পানাহিকে ২০ বছর একধরনের গৃহবন্দিত্বে থাকতে হয়। ভ্রমণ এবং সিনেমা তৈরি—দুটোই তাঁর জন্য নিষেধ ছিল। এর মাঝেই গোপনে বানিয়েছিলেন নো বিয়ার্স। প্রায় বন্দিত্বের মধ্যে দর্শনার্থী সহযোগীর মাধ্যমে তিনি ওই সিনেমার নির্দেশনা দেন। কাজে লাগান ‘জুম’কে। যা ছিল এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড। ‘ভালুকের’ মিথ্যা ভয় দেখিয়ে মানুষের ওপর ‘শিয়ালেরা’ কীভাবে শাসন করে যায়, নো বিয়ার্স সেই কাহিনি বলে। একই সঙ্গে গৃহবন্দিত্বের মধ্যেও এ সিনেমা বানিয়ে পানাহি দেখান, কিছু কিছু মানুষ অদম্য প্রাণ। তাঁদের মগজে কারফিউ জারি প্রকৃতই দুঃসাধ্য। তাঁরা শাসকদের নানান নিষেধাজ্ঞা অতিক্রম করে কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম। কিন্তু কত দিনে লড়ে যেতে পারবেন পানাহি কিংবা তাঁর মতো অন্যান্য দেশের অদম্যরা?

আরও পড়ুন
১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত নরওয়েভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘ইরান হিউম্যান রাইটসের’ হিসাবে চলতি প্রতিবাদ আন্দোলনে মৃতের সংখ্যা ছিল ৪৬৯, যাঁদের মধ্যে ৬৩ জন শিশু এবং ৩২ জন নারী। এর মধ্যে ৩০ সেপ্টেম্বর সিস্তান-বেলুচিস্তানের রাজধানী সুন্নি-মুসলমান অধ্যুষিত জাহেদানে এক বিক্ষোভেই ৬৬ জনের প্রাণ গেছে।
কারাবন্দী ইরানের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জাফর পানাহি
এএফপি ফাইল ছবি

ভবিষ্যতের লড়াই

১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত নরওয়েভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘ইরান হিউম্যান রাইটসের’ হিসাবে চলতি প্রতিবাদ আন্দোলনে মৃতের সংখ্যা ছিল ৪৬৯, যাঁদের মধ্যে ৬৩ জন শিশু এবং ৩২ জন নারী। এর মধ্যে ৩০ সেপ্টেম্বর সিস্তান-বেলুচিস্তানের রাজধানী সুন্নি-মুসলমান অধ্যুষিত জাহেদানে এক বিক্ষোভেই ৬৬ জনের প্রাণ গেছে। তবে চলতি আন্দোলন মোটেই শিয়া বনাম সুন্নি বিবাদ নয়। এটা হলো নির্মম বর্তমানের সঙ্গে আশাবাদী ভবিষ্যতের লড়াই। গুলিবর্ষণে ও পিটিয়ে মারার পর মধ্য নভেম্বর থেকে ইরানে শঙ্কা চলছে ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক মৃত্যুদণ্ডের। এ শঙ্কা তৈরি হয় দেশটির ২২৭ জন সংসদ সদস্যের বিবৃতি থেকে, যাঁরা প্রতিবাদকারীদের বলছেন ‘মোহারবেহ’ বা ‘খোদার দুশমন’। বিচার বিভাগকে সেভাবেই শাস্তি দিতে বলছেন তাঁরা আটক বিক্ষোভকারীদের। অথচ এ বিক্ষোভ মোটেই সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে হচ্ছে না। কিন্তু ‘বিপ্লবের’ অভিভাবকেরা নির্মমতাকে ন্যায্যতা দিতে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে তৎপর। দমনমূলক রাজনীতির এ রকম কৌশল নতুন নয়।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১৩ ডিসেম্বর জানিয়েছে, গত তিন মাসে ১৮ হাজার বিক্ষোভকারী আটক হয়েছে ইরানে। এ সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। এর মধ্যে ১১ জন বিক্ষোভকারীর বিরুদ্ধে অতি সংক্ষিপ্ত বিচার শেষে ইতিমধ্যে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন ‘বিপ্লবী আদালত’। ৪৩ বছর পর দেশটিতে ‘বিপ্লবের’ অর্থ এভাবে আমূল বদলে গেল।

নীতি পুলিশের হেফাজতে মাসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইরানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে
ছবি: এএফপি

বার্তাটি স্পষ্ট

ইরানে গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া সহিংসতার নবতরঙ্গ বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে খুব বেশি বেমানান নয়। বিশ্বজুড়েই গণতন্ত্র সংকুচিত হচ্ছে এবং ঝুঁকিতে পড়েছে। ইউরোপের নির্বাচনগুলোতে ক্রমাগত দক্ষিণপন্থীরা ভালো করছে। এশিয়ায়ও স্বস্তিতে থাকার উপায় নেই।

ভারতের গুজরাটে সংখ্যালঘু নিপীড়নের অতীত কুখ্যাত নজিরের পরও শাসক দল তুমুল গরিষ্ঠতায় জিতল আবার। ২৭ বছর ধরে তারা সেখানে ক্ষমতায়। এবার বিরোধী দল প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সেখানে। ১২ ডিসেম্বর নতুন সরকার শপথের পরপরই দেশটির সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিলেন, গুজরাটে দাঙ্গার সময় দলবদ্ধ ধর্ষণের বিলকিস বানুর মামলায় যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া ১১ জনকে সাজাভোগের আগেই কারামুক্তি দিতে বাধা নেই। এই ১১ জনের ১০ জন এমনকি মুক্তির জন্য আবেদনও করেনি। তারপরও তারা মুক্ত। আর এ রকম ‘মুক্তি’র জন্য বেছে নেওয়া হয় ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসকে।

আরও পড়ুন
বিলকিস বানু
এএফপি ফাইল ছবি

বিলকিস বানুর মামলাটি ভারতজুড়ে দুই দশক ধরে অনেক আলোচিত। সেখানকার শিক্ষিত সমাজ প্রায় সবাই জানে এ নির্মমতার কথা। ২০০২ সালে ২১ বছরের এই তরুণীকে কেবল ধর্ষণ করা হয়নি, ওই একই পরিবারের ১৪ জনকে মারাও হয় ‘দাঙ্গা’র সময়।

কিন্তু দোষী প্রমাণিত হয়েও ওই ধর্ষণকারীরা কেন মুক্ত থাকবে, এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মানুষ গুজরাট তথা পুরো ভারতেই কমছে। যার বড় প্রমাণ মিলল গুজরাট নির্বাচনে আরেকবার। ২০০২ সালে ‘দাঙ্গা’র বছর আরএসএস পরিবার ১৮২ আসনের স্থানীয় বিধানসভায় জিতেছিল ১২৭ আসনে। এবার জিতল ১৫৬ আসনে। পুরো বিধানসভার ৮৬ শতাংশই তাদের এখন। ১৮২ আসনের কোনোটিতে বিজেপি কোনো মুসলমানকে প্রার্থী করেনি। রাজ্যের যে ১৯টি এলাকায় মুসলমানরা বড় অঙ্কে আছে, সেখানেও ১৭ আসনে বিজেপিই জিতেছে। বার্তাটি স্পষ্ট, ধর্ষকামিতা রুখতে সক্ষম নয় ভোটব্যবস্থা। বরং ভোটকে ব্যবহার করে সেটা নতুন উচ্চতায় যেতে পারে। যাচ্ছেও।

তবে ভারতবাসী এখনো গেরুয়া ‘বিপ্লব’ থামাতে ভোটের হাতিয়ার ব্যবহার করে লড়ছে। এশিয়ায় অন্যত্র নির্বাচন না দিয়েই ক্ষমতায় থাকার প্রবণতা বাড়ছে। মিয়ানমারে ভোটে জিতে আসা প্রতিনিধিদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অন্যদের পালাতে হয়েছে। শ্রীলঙ্কা শাসন করছেন এমন এক ব্যক্তি, যাঁর দলের দ্বিতীয় কোনো সদস্য নেই পার্লামেন্টে। এভাবে ‘বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর অর্ধেকেই গণতন্ত্র দুর্বল হচ্ছে।’ গণতন্ত্রপন্থীদের জন্য ২০২৩ সালে লড়াই ছাড়া আর কিছু অপেক্ষায় নেই।

আরও পড়ুন
গাজীপুরের আলী আজমও এ রকম এক বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীই ছিলেন। ২০ ডিসেম্বর মায়ের জানাজা পড়তে ‘প্যারোল’ পেয়েছিলেন। হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরেই জানাজায় আল্লাহর কাছে মাকে পেশ করতে হয়েছে।
হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি নিয়েই মায়ের জানাজা পড়ান বিএনপি নেতা আলী আজম। গত ২০ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় গাজীপুরের কালিয়াকৈরের পাবরিয়াচালা এলাকায়
ছবি: সংগৃহীত

বুদ্ধিজীবীদের মৌনতা

সুইডেনের ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্সের ২১ নভেম্বরের এ রকম সতর্কবার্তা বাংলাভাষীরাও দেখেছেন, কীভাবে কর্তৃত্ববাদের ঢেউ চীন, মিয়ানমার হয়ে আরও উত্তরমুখী হচ্ছে। সেই সংবাদের কিছুদিন আগে দেখা গেল সাদাত হাসান মান্টোর কবিতা আওড়িয়ে শ্রীমঙ্গলের এক ফেসবুক ব্যবহারকারীর কারারুদ্ধ হওয়ার ঘটনা। আর পরে দেখা গেল মোবাইল ফোন ঘেঁটে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী শনাক্তের প্রচেষ্টা। গাজীপুরের আলী আজমও এ রকম এক বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীই ছিলেন। ২০ ডিসেম্বর মায়ের জানাজা পড়তে ‘প্যারোল’ পেয়েছিলেন। হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরেই জানাজায় আল্লাহর কাছে মাকে পেশ করতে হয়েছে। সে ছবি দেশের লাখ লাখ মানুষও দেখেছে। এসব নজিরের প্রতীকী বার্তা নিয়ে স্থানীয় ‘বুদ্ধিজীবী’দের বড় অংশ মোটেই দুর্ভাবনায় নেই বলেও সাক্ষ্য মিলছে।

জ্ঞানীদের এ রকম মৌনতা সমাজকে কী রকম সমস্যায় ফেলে, তার বিস্তর নজির আছে ইতিহাসে। জার্মান বুদ্ধিজীবী দল একসময় ‘ব্যাজ’ পরিয়ে ইহুদি শনাক্তকরণ ব্যবস্থা দেখেছে। বিশ্বকে তার জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। একালে ভারতীয় বিদ্বৎসমাজ দেখেছেন তাঁদের অসতর্কতার সিঁড়ি বেয়ে গেরুয়া রং কীভাবে সহিংসতার সতর্কবার্তা হয়ে গেল। সেখানে খ্রিষ্টান সমাজকর্মী স্ট্যান স্বামিকে মাওবাদী আখ্যা দিয়ে ফাঁসাতে কীভাবে তাঁর কম্পিউটারে নানান বেআইনি ডকুমেন্ট ঢোকানো হয়েছিল, সেটা বেচারা মারা যাওয়ার প্রায় দেড় বছর পর আন্তর্জাতিক ডিজিটাল ফরেনসিকের মাধ্যমে এই ডিসেম্বরেই কেবল উন্মোচিত হলো।

ফরেনসিক সংস্থা আর্সেনাল কনসাল্টিংয়ের অনুসন্ধান বলছে, ই–মেইলের মাধ্যমে প্রয়াত ফাদারের ল্যাপটপে ২০১৪ থেকে তিন বছর ধরে ম্যালাওয়্যার ব্যবহার করে নানান রকম নথি ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। ২০২০–এ তাঁকে আটকের পর সেই ল্যাপটপ দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা হয় তিনি ঝাড়খণ্ডের ‘মাওবাদী’দের সঙ্গে মিলে সরকার উৎখাতের জন্য আদিবাসীদের সংঘবদ্ধ করছিলেন। মামলা চলাকালে কারাগারেই ৮৩ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ সমাজকর্মী মারা যান।

আরও পড়ুন
ফাদার স্ট্যান স্বামির মৃত্যুর ঘটনায় ন্যায়বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ। ২০২১ সালের ১৫ জুলাই ভারতের ঝাড়খন্ডে
ছবি: এএনআই

পানাহি কিংবা স্ট্যান স্বামিরা কী করতে পারেন

কারাগারে স্ট্যান স্বামির মৃত্যু বৈশ্বিক কর্তৃত্ববাদের অতি নির্মম এক নজির। তিনি মারা গেলেও ‘এলগার পরিষদ কেস’ নামে পরিচিত এই মোকদ্দমায় একই ধরনের অভিযোগে ভারতের ১৩ জন খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী এখনো কারাগারে। মহারাষ্ট্র থেকে শুরু হওয়া এই মোকদ্দমা দেখভাল করছে দেশটির ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেট এজেন্সি। ভারতের সুপরিচিত মিডিয়া ‘দ্য ওয়্যার’ বিশ্বের আরও ১৬টি সংস্থার সঙ্গে মিলে এক অনুসন্ধান শেষে দাবি করেছে, এলগার পরিষদ মোকদ্দমায় অভিযুক্তদের অন্তত ৮ জনের মোবাইল ফোনে ‘পেগাসাস’ গোয়েন্দা সফটওয়্যার ঢুকিয়ে নজরদারি করা হতো। গত বছর জুলাইয়ে এ রকম খবরও দেখা গেছে ইসরায়েলি প্যাগাসাস স্পাইওয়্যারের ক্রেতা দক্ষিণ এশিয়ায় অন্তত তিনটি বড় দেশ।

জাফর পানাহি থেকে স্ট্যান স্বামির অভিজ্ঞতা আপাতত এ রকম সতর্কসংকেতই দিচ্ছে, মানবাধিকারকর্মী কিংবা ভিন্নমতাবলম্বী বুদ্ধিজীবীদের জন্য সামনের দিনগুলো কী রকম হয়রানিধর্মী হতে পারে। একদিকে ম্যালওয়্যার এবং অন্যদিকে ম্যালওয়্যার ছড়ানো মানুষকে মোকাবিলা করে বেঁচে থাকতে হবে তাঁদের। ফলে নীরবতাই যেন নিয়তি হয়ে উঠেছে। কিন্তু নীরবতার মধ্যে রয়েছে সর্বস্ব হারানোর বীজ।

তারানেহ আলিদুস্তি ঠিক ওই সতর্কবার্তাই জানাচ্ছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ঠিকানায়। তিনি লিখেছিলেন, যেসব সংস্থা জনগণের রক্তপাত দেখছে কিন্তু এখনো কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না—তারা কিন্তু মানবতার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করছে। অর্থাৎ তাঁর ভাষায় জুলুমের কালে নীরবতা মানবতার কলঙ্কের মতোই।

কিন্তু নীরবতার ‘নির্দেশ’ আমলে না নিয়ে কীভাবে পারা যাবে? একালে ভিন্নমত বা ‘অপর’দের নীরব করার একটা কায়দা ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া। বিশ্বের প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ এখন ইন্টারনেটের আওতায়। এটাই হয়ে উঠছে তথ্য পাওয়া ও সামাজিক যোগাযোগের নিত্যদিনের মাধ্যম। কিন্তু ২০২১-এর চেয়ে ২০২২-এ অন্তত

২৭টি দেশে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে (কম্পারিটেক, ১২ অক্টোবর)। এ রকম দুটি দেশ এ অঞ্চলেরই মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কা। আফগানিস্তানে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে নানান ধরনের প্রায় ২৩০টি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেছে। ২৮ এপ্রিল ভারতে ভিপিএন ব্যবহারকারীদের তথ্য দিতে বলা হয়েছে কোম্পানিটিকে। ফ্রিডম হাউসের ২০২২ সালের ইন্টারনেট ফ্রিডম সূচকে বাংলাদেশ ১০০ নম্বরের মধ্যে ৪৩ পেয়েছে। রিপোর্টার উইদাউট বর্ডারসের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল গত বছর ১৬২। আগের বছরের চেয়ে এটা ১০ ধাপ কম। মিয়ানমার থেকে এটা এখন মাত্র ১৮ ধাপ দূরে আছে।

তারপরও জাফর পানাহিরা থামতে নারাজ, কারাগারে ঢোকানোর আগে বছরের পর বছর ছবি তৈরির নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই তিনি নিজের আইফোন দিয়ে বানিয়েছিলেন দিস ইজ নট এ ফিল্ম, যা জন্মদিনের কেকের ভেতর ফ্লাশ ড্রাইভে ঢুকিয়ে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে পৌঁছায়।

এ সিনেমা জানাচ্ছিল একজন বন্দী ভিন্নমতাবলম্বীর জীবন কী আদল নেয় বা নিচ্ছে বা নিতে পারে। পরের বছর ২০১৩ সালে তিনি যৌথভাবে বানান ক্লোজ কার্টিন। এও পানাহির বাড়িতে পর্দার আড়ালে চিত্রায়িত। এসবের ভেতর দিয়ে পানাহি গণতন্ত্রের বৈশ্বিক দুঃসময়ে বুদ্ধিজীবিতার নতুন একটা মডেল হাজির করেন, যেখানে সেন্সরশিপকে শিল্পে পরিণত করা হয়। কিন্তু এখন পানাহি আর কী করতে পারবেন—যখন তিনি পুরোপুরি কারাগারে? স্ট্যান স্বামিরা কীভাবে দলিত ও আদিবাসীদের পাশে দাঁড়াবেন, যখন ই–মেইলে মিশিয়ে দেওয়া হবে ‘বিষ’? বিলকিস বানু কীভাবে বাকি জীবন পার করবেন সেই পরিবেশে, যেখানে চারপাশে দেখবেন তাঁর ধর্ষণকারীরা মুক্ত? আলী আজম কী করবেন, যখন নিয়মিত আদালতে দণ্ডিত না হয়েও হাতকড়া এবং পায়ে বেড়ি থাকছে প্রার্থনাকালেও।

মানুষ কি এসব বাস্তবতা অতিক্রম করে যেতে সক্ষম? ২০২৩ সাল হয়তো এ প্রশ্ন নিয়েই সামনে হাজির হচ্ছে। এ রকম চ্যালেঞ্জ আর অনিশ্চয়তায় গান্ধীর সেই বিখ্যাত কথা স্মরণযোগ্য, ‘শক্তি-সামর্থ্য কেবল বিজয়ের মধ্য দিয়ে আসে না, যখন কেউ সিদ্ধান্ত নেয় সে আত্মসমর্পণ করবে না, বরংলক্ষ্য অর্জনে কষ্ট করতে রাজি, সেটাই তার আসল শক্তির জায়গা।’