হাসপাতালে মাতৃমৃত্যু: ত্রুটিযুক্ত ওষুধের দিকে নজর

প্রতীকী ছবি

পরপর কয়েকটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্মদানের পর মাতৃমৃত্যুর ঘটনার তদন্তপ্রক্রিয়া শুরু করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্ত্রীরোগ ও মাতৃস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের সংগঠনও পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে। প্রাথমিকভাবে অধিকাংশের ধারণা, অস্ত্রোপচারের আগে ব্যবহৃত ত্রুটিযুক্ত ওষুধ মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা সম্পর্কে আমি জানি। তদন্তপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’

ফেব্রুয়ারি-মার্চে চট্টগ্রাম, সিলেট ও কুমিল্লার কয়েকটি হাসপাতালে মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। প্রথম আলো ১৬ জন প্রসূতির মৃত্যুর খবর পেয়েছে। এসব মৃত্যু হয়েছে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের পর।

আরও পড়ুন

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২৮ মার্চ শুধু চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোর মাতৃমৃত্যুর ঘটনা তদন্তে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। কমিটির প্রধান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে ‘মৃত্যু পর্যালোচনা’ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম ছাড়াও অন্যান্য জেলার মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত কমিটি খুব শিগগির গঠন করা হবে।

আরও পড়ুন

স্ত্রীরোগ ও মাতৃস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) পক্ষ থেকেও ঘটনা পর্যালোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ওজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশা করছি আগামীকাল রোববারের মধ্যে আমরা বিভিন্ন জেলার প্রতিবেদনগুলো পেয়ে যাব। সেগুলো পর্যালোচনা করে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে একটা ধারণা হয়তো পাওয়া যাবে।’

ওজিএসবি, অবেদনবিদ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ মৃত্যুর ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের কয়েক ঘণ্টা পর প্রসূতিদের প্রস্রাব কমে যেতে থাকে, একপর্যায়ে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায়, রক্তচাপ কমতে থাকে, কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে, শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, হার্ট ফেল করে। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে মোটামুটি এসব লক্ষণ ধরা পড়েছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও মাতৃস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলেন, জটিলতার ঝুঁকি থাকে এমন সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয়। সন্তান জন্মদানে অস্ত্রোপচার একটি জীবনদায়ী ব্যবস্থা। অস্ত্রোপচারের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। তবে অস্ত্রোপচারের পর মাতৃমৃত্যুর ঘটনা অস্বাভাবিক।

আরও পড়ুন

কোথায় নজর দিতে হবে

সাধারণত সন্তান জন্মে অস্ত্রোপচারে তিন ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়: চেতনানাশক, ব্যথানাশক এবং শিরায় দেওয়া স্যালাইন। কিছু ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হতে পারে। এ ছাড়া কিছু সাধারণ ওষুধও ব্যবহার করা হয়। ওষুধবিশেষজ্ঞ, ওজিএসবির জ্যেষ্ঠ একাধিক সদস্য, অবেদনবিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা ধারণা করছেন চেতনানাশক, ব্যথানাশক বা শিরায় দেওয়া স্যালাইন—এই তিনটির কোনো একটিতে ত্রুটির কারণে সাম্প্রতিক মাতৃমৃত্যু হতে পারে।

ওষুধবিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চেতনানাশক, ব্যথানাশক, শিরায় দেওয়া স্যালাইনসহ ব্যবহার করা হয়েছে এমন সব ওষুধের নমুনা বাজার থেকে সংগ্রহ করে কমপক্ষে তিনটি পৃথক ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা দরকার। কোনো একটি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে গ্রহণযোগ্য ফলাফল পাওয়া যাবে না।’

আরও পড়ুন

দেশে অবেদনবিদের সংকট আছে। সব হাসপাতাল ও ক্লিনিকে দক্ষ অবেদনবিদ নেই। কোনো ক্ষেত্রে অবেদনবিদের ত্রুটি হয়েছে কি না—সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন কেউ কেউ। কারণ, গত দুই মাসে অবেদনবিদের ভুলের কারণে একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ আছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অস্ত্রোপচারে সংশ্লিষ্ট কার কী ভূমিকা ছিল এবং কে কতটুকু তা পালন করেছেন, তা খতিয়ে দেখা তদন্তের অংশ হতে হবে।

আরও পড়ুন

প্রকৃত ঘটনা জানতে প্রতিটি মৃত্যুর ক্ষেত্রে রোগীর পুরো ইতিহাস জেনে নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্রোপচারের পর ‘পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে’ সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেখানে চিকিৎসক থাকেন না। একজন বা দুজন নার্সের অধীনে অনেক রোগী থাকে। অস্ত্রোপচারের পর সেখানে প্রসূতিরা কী সেবা পেয়েছেন, তা অনুসন্ধান করা দরকার। তিনি বলেন, সরকার যদি প্রকৃত কারণ জানতে চায়, তা হলে মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করা উচিত।

আরও পড়ুন

চট্টগ্রাম, সিলেট ও কুমিল্লার হাসপাতালগুলোতে কোন ধরনের কোন মানের চেতনানাশক, বেদনানাশক বা শিরায় দেওয়া স্যালাইন ব্যবহার করা হয়েছে, তা এখনো অজানা। ইতিমধ্যে একাধিক হাসপাতাল থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে বলে গতকাল প্রথম আলোকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক মঈনুল আহসান।

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘সন্তান জন্ম দিতে এসে হাসপাতালে মায়ের মৃত্যু কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে দ্রুত সমস্যা চিহ্নিত না করতে পারলে আরও মাতৃমৃত্যু ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।’