সুপারিশ–সিদ্ধান্ত হয়, বাস্তবায়িত হয় না

কমিটি হয়, নানা সুপারিশ ও সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কিছুই বাস্তবায়িত হয় না। সড়ক–মহাসড়কের অবস্থাও দিন দিন খারাপ হচ্ছে

  • মহাসড়কে নছিমন, করিমন, ভটভটি তুলে দেওয়ার আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়নি।

  • জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের ৬২ শতাংশে যথাযথ সাইন-সংকেত নেই।

  • দেশের মোট যানবাহনের প্রায় ১০ শতাংশ ফিটনেস ছাড়াই চলছে।

মহাসড়কে বেপরোয়া গতিতে চলছে বাস-ট্রাক। কে কাকে পেছনে ফেলবে, যেন তারই প্রতিযোগিতা চলছে। গতকাল বগুড়ার ফটকি সেতু এলাকা
ছবি: প্রথম আলো

নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর নেতৃত্বে আছে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল। সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদ নামে আরেকটি শীর্ষ ফোরামের নেতৃত্বেও তিনি। দুটি শীর্ষ কমিটিতে প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের সচিব-কর্মকর্তা ছাড়াও বিশেষজ্ঞরা আছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের আছে নিরাপদ সড়কসংক্রান্ত আলাদা সেল। এসব ফোরামে বৈঠক হয়, সিদ্ধান্ত হয়, কমিটি হয়—তবে সিদ্ধান্ত বা সুপারিশ বাস্তবায়িত হয় কমই। ফলে সড়কে প্রাণহানি বাড়ছে প্রতিবছরই।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবমতে, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ২১ হাজার ৬৬২ জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। এর মধ্যে ২০১৬ সালে সড়কে ২ হাজার ২২২ এবং সর্বশেষ গত বছর ৩ হাজার ৭৭৬ জনের প্রাণ গেছে।

এআরআই বলছে, গত বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রথম সাত মাসে দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৩২৫ জন মারা যায়। এবার প্রথম সাত মাসে মারা গেছে ২ হাজার ৭৩৯ জন। অর্থাৎ একই সময়ে এ বছর প্রাণহানি বেড়েছে ৪১৪। গত সাত মাসে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ৪৫১টি। এর অর্ধেকের বেশি ১ হাজার ৩৫১টি দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাস, ট্রাক ও মোটরসাইকেল।

বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের হিসাবে, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে ৭ থেকে ৯ হাজার প্রাণহানি হয়। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মারা যায়।

২০১৮ সালের জুলাইয়ে নিরাপদ সড়কের দাবিতে সারা দেশে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামলে সরকার নানা প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়নি। গত বছর ও চলতি বছর আরও দুবার শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামে।

আদেশ-নির্দেশ-সিদ্ধান্ত আছে, বাস্তবায়ন নেই

২০১৫ সালে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের এক বৈঠকে দুর্ঘটনা কমাতে মহাসড়কে সর্বোচ্চ গতি ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণের কথা জানান মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ২০১৬ সালে দেশের ২২টি মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। গত বছর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সড়ক থেকে নছিমন, করিমন, ভটভটি তুলে দেওয়ার নির্দেশনা দেন। এর আগে ২০০৯ সালে প্রতিটি যানবাহনে নির্দিষ্ট গতিসীমা মেনে চলার যন্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। এসব সিদ্ধান্ত বা আদেশ বাস্তবায়ন হয়নি।

গত এক দশকে সড়ক-মহাসড়ক থেকে ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত, ঘোষণা দেওয়া হয় অন্তত পাঁচবার। কিন্তু সড়কে এসব যানবাহন চলছে।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে মন্ত্রণালয় ১৯৯৭ সাল থেকে তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা করছে। সর্বশেষ পরিকল্পনায় ২০২৪ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দুর্ঘটনার সংখ্যা ও প্রাণহানির সরকারি তথ্য ধরলেও তাতে কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না।

সড়কের দুরবস্থা

হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট মডেল (এইচডিএম-৪) সফটওয়্যার ব্যবহার করে সড়কের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। সওজের অধীনে দেশের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক। সারা দেশে এই সংস্থার সড়ক আছে সাড়ে ২২ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে ১১০টি জাতীয় মহাসড়ক প্রায় চার হাজার কিলোমিটার।

এইচডিএম সার্কেল গত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে গাড়ি দিয়ে ঘুরে ঘুরে যন্ত্রের সাহায্যে সড়কের অবস্থা নিয়ে সমীক্ষা করে। এপ্রিলে প্রকাশিত সমীক্ষায় বলা হয়, সওজের অধীনে থাকা কাঁচা সড়ক, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া এবং সম্প্রসারণ বা সংস্কারের কাজ চলা সড়ক এই সমীক্ষায় আসেনি।

সওজের সড়কগুলোকে তারা পাঁচ শ্রেণিতে ভাগ করেছে। এর মধ্যে ভালো ও চলনসই হচ্ছে আদর্শ। আর জীর্ণশীর্ণ, খারাপ ও খুবই খারাপ—এই তিন ধরনের সড়ক মেরামত প্রয়োজন। সমীক্ষা অনুসারে, সারা দেশে জীর্ণশীর্ণ, খারাপ ও খুবই খারাপ সড়কের পরিমাণ ২ হাজার ৭৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে খুবই খারাপ সড়কের পরিমাণ ৪৫৭ কিলোমিটার, যা মোট সড়কের ২ দশমিক ২৮ শতাংশ। অথচ ২০১২-১৩ অর্থবছরে খুব খারাপ সড়কের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক দশকে খুব খারাপ সড়কের পরিমাণ বেড়েছে।

২০১৯ সালে সওজের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের ৬২ শতাংশে যথাযথ সাইন-সংকেত নেই। এই ব্যবস্থার পরিবর্তনে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে ত্রুটিযুক্ত সড়ক প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে।

ফিটনেসের বালাই নেই

ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলতে দেওয়া হবে না—সরকারের পক্ষ থেকে এ কথা বহুবার বলা হয়েছে। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ৫ লাখ ৩৩ হাজার। অর্থাৎ দেশের প্রায় ১০ শতাংশ যানবাহন ফিটনেস ছাড়াই চলছে।

বিআরটিএ সূত্র জানায়, ফিটনেস সনদ, লাইসেন্স দেওয়াসহ প্রায় সব কাজই মোটরযান পরিদর্শকেরা করেন। লোকবল–সংকটের সুযোগে এসব পরিদর্শক বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যেনতেনভাবে দালালের মাধ্যমে লাইসেন্স ও ফিটনেস সনদ দিয়ে থাকেন।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী প্রথম আলোকে বলেন, সড়কে অনেক দিনের জঞ্জাল আছে। আস্তে আস্তে পরিষ্কার করতে হবে। তাঁরা চালক, যানবাহন ও পথচারীদের আইন মেনে চলার কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। ভবিষ্যতে ফল দেখা যাবে।