জোবায়ের প্রাণ দিলেন, এবার কি রক্ষা পাবে ফসলি জমি
মাত্র ২৩ বছরের তরুণ আহমেদ জোবায়ের। ১৭ ডিসেম্বর নির্মমভাবে খুন হন তাঁর প্রাণপ্রিয় ধানের মাঠের মধ্যে; যা পরিণত হয় এক শোকের পাহাড়ে। খবরটি রাজশাহীর মোহনপুরের। উপজেলার ধুরইল ইউনিয়নের বড় পালশায় তাঁকে হত্যা করা হয়। আল্লাহ ছাড়া এখন কে আর তাঁর ফরিয়াদ শুনবে? সেই সিরীয় শরণার্থী শিশুর মতো মৃত্যুর আগে জোবায়েরও কি বলেছিলেন, ‘আমি সব কথা আল্লাহকে বলে দিব!!’?
জোবায়ের একেবারেই মাঠের কৃষক। নিজের জীবন দিলেন সেই কৃষকের জন্যই। লক্ষ্য ছিল আবাদি কৃষিজমি রক্ষা করা।
কৃষিজমির শহুরে মালিকেরা এখন ইচ্ছেমতো জমিকে খাটান। ফসলের ভাগ নেন না, নেন আগাম নগদ টাকা। তেভাগা এখন জাদুঘরে। নতুন নীলকর হয়েছেন দূরে থাকা জমির মালিকেরা। আগাম টাকার কোনো ‘মাপ পরিমাণ’ নেই। মন যা চায়, তা–ই দাবি করে বসেন। আবার দৈব–দুর্বিপাকে ফসল মার গেলে সরকারি প্রণোদনাও ‘মালিকেরাই’ হাত পেতে নিয়ে যান।
এসব অনিয়ম অন্যায় আর বেইনসাফির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন জোবায়ের। সোচ্চার ছিলেন কৃষিজমিতে অপরিকল্পিত পুকুর খননের বিরুদ্ধে। এমন পুকুর খনন ঠেকাতে গিয়ে খননযন্ত্রের চাপায় নিহত হন জোবায়ের।
অনুপস্থিত জমির মালিকদের এখন এক নতুন শখ হয়েছে মাছ চাষের। মাছ চাষ দেখাতে পারলে নাকি আয়কর ছাড় পাওয়া যায়। গ্রামে মৌজ–মাস্তির জন্য একটা খামারবাড়ি এখন বড়লোকি দেখানোর নতুন উপচার। সেই উপচারের বাড়তি অনুষঙ্গ হচ্ছে মাছের ‘পুকুর’। কারণ যা–ই হোক, ধানিজমিতে শখের পুকুর কৃষকের পিঠে নতুন চাবুকের বাড়ি হয়ে উঠেছে।
ধানের জমিতে পুকুর কাটলে কৃষির কী সমস্যা
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে নাটোরের বড়াইগ্রাম গিয়ে চোখ কপালে উঠেছিল। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, উপজেলার অধিকাংশ জমি তিন ফসলের। কিন্তু অপরিকল্পিত পুকুর খননের ফলে এখন অনেক জমিতে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে একটার বেশি ফসল করা যাচ্ছে না। বিলের অন্তত ৩০০ বিঘা জমি জলাবদ্ধ। পানি না নামলে সেখানে নতুন ফসল আবাদ করা যাবে না।
কৃষকেরা জানান, আগে বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পরপরই (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) তাঁরা বিলে শর্ষে, গম, বিনা চাষের রসুনসহ নানা ধরনের শীতকালীন ফসল আবাদ করতেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বিলের মধ্যে অপরিকল্পিতভাবে শত শত পুকুর কাটা হয়েছে। এ ছাড়া বিলের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী ভরাট হওয়ায় পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারণে বিলের পানি নামতে না পেরে বিলে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
বাজিতপুর এলাকার সোবাহান চাচা বলেছিলেন, ‘আমার ২০ বিঘা বোরো ধানের জমি আছে। জলাবদ্ধতার কারণে এখনো জমি পানির নিচে। এবার (২০২৫ জানুয়ারি) জমিতে বোরো ধান, শর্ষে, গম ও রসুন কিছুই আবাদ করতে পারিনি। অথচ ওই জমির ফসলেই আমার সংসার চলে। কিছু লোভী লোকজন বিলে পুকুর কাটায় জমির পানি নামছে না। তাঁদের বিরুদ্ধে কে ব্যবস্থা নেবে? আর আমাকেই-বা কে ক্ষতিপূরণ দেবে?’
একই এলাকার এক কলেজশিক্ষক ইসলাম ভাই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষপাতী। তিনি বিলের জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করেছেন, চিঠি-দরখাস্ত পাঠিয়েছেন। তাঁর শিকায়েত, ‘কেউই বিষয়টি আমলে নেননি, প্রতিকারের পদক্ষেপ দূরের কথা।’
সেবার ভুক্তভোগী চাষি, স্থানীয় কর্মকর্তা, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি কৃষিবিদ, মৃত্তিকাবিজ্ঞানী এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকর্মীদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ হয়েছিল। তাঁদের কেউই কৃষিজমির মাঝে ইচ্ছেমতো পুকুর কাটার পক্ষে কথা বলেননি। তাঁদের মতামতের সারসংক্ষেপ অনেকটা এ রকম: পুকুর কাটলে—
১. কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষতি হয়।
• চাষযোগ্য জমি স্থায়ীভাবে কমে যায়, ফলে ধান, সবজি ও অন্যান্য খাদ্যশস্য উৎপাদন হ্রাস পায়।
• দেশে আবাদি জমি ইতিমধ্যে কমছে; পুকুর খনন এই সংকট আরও বাড়ায়।
• স্থানীয় খাদ্যনিরাপত্তা ও কৃষিজীবীদের জীবিকা ঝুঁকিতে পড়ে।
২. পানি ও মাটির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
• পুকুরের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নেমে যেতে পারে।
• আশপাশের জমিতে জলাবদ্ধতা বা অতিরিক্ত আর্দ্রতা সৃষ্টি হয়ে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
• মাটির প্রাকৃতিক গঠন নষ্ট হয়ে চাষের যোগ্যতা হারায়।
৩. পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়।
• এক ফসলি পুকুরে রূপান্তরের ফলে স্থানীয় জীববৈচিত্র্য হ্রাস পায়।
• অতিরিক্ত মাছ চাষে ব্যবহৃত রাসায়নিক খাদ্য ও ওষুধ পানি ও মাটি দূষিত করতে পারে।
• আশপাশের গাছপালা ও উপকারী পোকামাকড়ের আবাস নষ্ট হয়।
৪. সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা।
• পুকুর কাটার সুফল সাধারণত জমির মালিক পেলেও ক্ষতিগ্রস্ত হন আশপাশের কৃষক।
• জমি নিয়ে বিরোধ, সামাজিক দ্বন্দ্ব ও আইনি জটিলতা তৈরি হতে পারে।
• প্রান্তিক ও বর্গাচাষিরা জমি হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়তে পারেন।
৫. আইন ও নীতিগত সমস্যা হয়।
• বাংলাদেশে উর্বর কৃষিজমিতে অনুমতি ছাড়া পুকুর খনন আইনগতভাবে সীমিত বা নিষিদ্ধ। ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন না করে পুকুর খনন করলে জরিমানা বা আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে।
এসবই জোবায়েরের জানা ছিল। ঘটনার দিন রাজশাহীর মোহনপুরে রাতের আঁধারে আবাদি জমিতে পুকুর কাটার জন্য নামানো হয় খননযন্ত্র। গ্রামের এই আবাদি মাঠে এর আগে কেউ কোনো পুকুর কাটার পাঁয়তারা করেননি। সেই রাতে হঠাৎ তাঁরা জানতে পারেন, সেখানে পুকুর খনন করার জন্য গোপনে খননযন্ত্র নামানো হয়েছে। এই খবর মসজিদের মাইক থেকে মুয়াজ্জিন আবদুল মান্নান ঘোষণা করেন। তখন গ্রামের লোকজন মাঠের দিকে ছুটে যান।
প্রথম দিকে জোবায়েরসহ সাত থেকে আটজন পুকুর খননের প্রতিবাদ জানান। সামনে ছিলেন জোবায়ের। তখন চালক দ্রুত এক্সকাভেটরের বাকেট (মাথা) চারপাশে ঘোরাতে থাকেন। এতে ধাক্কা লেগে জোবায়ের মাটিতে পড়ে যান। চালক এক্সকাভেটর নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে জোবায়েরের গায়ের ওপর দিয়ে এক্সকাভেটর চালিয়ে দেন তিনি। ঘটনাস্থলেই জোবায়ের নিহত হন।
ঘটনার পর গ্রামের শতাধিক মানুষ মাঠে নেমে যান। তাঁরা চালককে আটক করেন এবং এক্সকাভেটরে আগুন ধরিয়ে দেন। ঘটনাস্থলে মোটরসাইকেল নিয়ে গিয়েছিলেন পুকুর খননের উদ্যোক্তা স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা। এলাকাবাসীর তোপের মুখে তিনি মোটরসাইকেল ফেলে পালিয়ে যান। স্থানীয় লোকজন তাঁর মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন।
গ্রামবাসীর এখন একটাই দাবি, ফসলি জমিতে পুকুর খননে বাধা দেওয়ায় জোবায়েরকে পরিকল্পিতভাবে ‘ভেকুর’ চাকার নিচে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। বিচার হোক। পুকুর কাটা বন্ধ হোক।
একে গরিবের সন্তান, তার ওপর ক্ষমতাকাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার হিম্মত দেখানো এ দেশে অপরাধের শামিল। তাই তাঁর হত্যার বিচার পাওয়া কি খুব সহজ হবে? তবে প্রশাসন ইচ্ছা করলেই যেখানে–সেখানে বিশেষ করে ধান আবাদের জমিতে পুকুর কাটা বন্ধ করতে পারে।
আইন (ভূমি ব্যবস্থাপনা নীতি ও বালু ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০) বলছে, জেলা প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া শ্রেণিভুক্ত কৃষিজমিতে পুকুর খননের মাধ্যমে ভূমির প্রকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না। জেলা প্রশাসন অতীতে এ রকম অনেক ক্ষেত্রে আবাদি জমি রক্ষা করেছে। নিচে এ রকম কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো। এসব ঘটনার খবর বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
১. মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে কৃষিজমি থেকে মাটি কেটে পুকুর ও জলাশয় তৈরির কারণে উপজেলা প্রশাসন জরিমানা করে এবং খনন বন্ধ করে দেয়।
২. চুয়াডাঙ্গা সদরে অবৈধভাবে কৃষিজমির মাটি খনন ও পুকুর খননের নামে মাটি কাটার অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত দুই স্থানীয় ব্যক্তিকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করেন এবং আইনগত ব্যবস্থা নেন।
৩. রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার সাড়ে আট বিঘা ফসলি জমিতে পুকুর খনন ও মাটি বিক্রির অভিযোগে পুলিশ মামলা করে।
৪. রাজশাহীর বাগমারায় অবৈধ পুকুর খননের কাজে নিয়োজিত ভেকুচালকদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এক মাসের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
৫. নাটোরের সিংড়া উপজেলায় অবৈধ কৃষিজমিতে পুকুর খননের জন্য এক ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
জোবায়ের চেয়েছিলেন ‘জোর যার মুল্লুক তার’ কালচারের বিপক্ষে এক বৈষম্যহীন ইনসাফের চর্চা বিকশিত হোক। রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আমলারাও এ কাজে অবদান রাখতে পারেন। দিনের শেষে আল্লাহর বিচার তো থাকছেই।
# লেখক গবেষক [email protected]