‘প্রয়োজন’ নেই, তবু নতুন তথ্যভান্ডার করতে চাপ

  • মানুষের ১৬ ধরনের তথ্য নিয়ে তথ্যভান্ডার করতে হবে।

  • অপারেটরদের কাছে গ্রাহকপ্রতি ১০ টাকা চায় সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান।

মোবাইল অপারেটররা আগ্রহী নয়। প্রয়োজন নেই বলে মনে করে সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারও (এনটিএমসি)। তারপরও গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে তথ্যভান্ডার তৈরি করতে মোবাইল অপারেটরদের চাপ দিচ্ছে বিটিআরসি। গত বুধবার এ বিষয়ে নতুন করে অপারেটরদের চিঠি দেওয়া হয়।

তথ্যভান্ডার করা নিয়ে মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চিঠি চালাচালি চলছিল ২০২১ সালের নভেম্বর থেকেই। গত ২৫ জানুয়ারি দেওয়া একটি চিঠিতে তথ্যভান্ডার করার প্রস্তুতি নিয়ে গত ১৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছিল বিটিআরসি। তবে অপারেটররা তথ্যভান্ডার করেনি।

বিটিআরসির নির্দেশনা মানা হলে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ‘অটোফিলের’ মাধ্যমে দেশি-বিদেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে চলে যাবে। এটা নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার ঝুঁকি তৈরি করবে।
মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, মহাপরিচালক, এনটিএমসি

বিটিআরসি গত বুধবারের চিঠিতে উল্লেখ করেছে, অপারেটররা বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিল। সেটা কমিশনের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। নতুন চিঠিতে অপারেটরদের ২ এপ্রিলের মধ্যে এ–সংক্রান্ত কাজ শেষ করে প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়।

বাংলাদেশে এখন চারটি মোবাইল অপারেটর রয়েছে গ্রামীণফোন, রবি আজিয়াটা, বাংলালিংক ও টেলিটক। সর্বশেষ গত জানুয়ারি মাসের হিসাবে মুঠোফোন গ্রাহকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ কোটিতে (একজনের একাধিক সিম থাকতে পারে)।

তথ্যভান্ডার করার বিষয়টি নিয়ে গত শুক্রবার জানতে চাওয়া হয়েছিল ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলকের কাছে। তিনি এটি আদালতের বিবেচনায় আছে, উল্লেখ করে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা জানান।

উল্লেখ্য, বিটিআরসির নির্দেশনাটি নিয়ে চলতি মাসের শুরুতে হাইকোর্টে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে একটি রিট করা হয়। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিটিআরসির নির্দেশনা কেন বাতিল ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে গত বুধবার রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট।

ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে তথ্যভান্ডার করতে মোবাইল অপারেটররা আগ্রহী নয়। তবু আবার বিটিআরসির চিঠি।

বিটিআরসির সচিব মো. নূরুল হাফিজ গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি (তথ্যভান্ডার করা) নিয়ে আমাদের দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। এ বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত আসতে পারে।’ কী সিদ্ধান্ত হতে পারে, তা তিনি জানাতে চাননি।

বিটিআরসি মোবাইল অপারেটরদের যে তথ্যভান্ডার বা ডেটাবেজ তৈরি করতে বলছে, সেটিতে গ্রাহকের নাম, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, মা-বাবার নাম, জন্মতারিখ, ঠিকানা, লিঙ্গপরিচয়, পেশা, ছবিসহ মোট ১৬ ধরনের তথ্য থাকবে। এই তথ্যগুলো নিতে হবে নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তথ্যভান্ডার থেকে।

বিটিআরসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মোবাইল অপারেটরগুলো বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডিজিটাল আর্কিটেকচার (বিএনডিএ) ব্যবস্থার মাধ্যমে তথ্যগুলো নেবে। প্রক্রিয়াটিকে বলা হচ্ছে ‘ইলেকট্রনিক টেলিযোগাযোগ গ্রাহক নিবন্ধন ফরম অটোফিলকরণ’।

আরও পড়ুন

বিএনডিএর একটি সেবা হলো পরিচয়, যা ২০১৯ সালের জুলাই মাসে চালু হয়। এই সেবার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের এনআইডি তথ্যভান্ডার থেকে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই সুবিধা দেওয়া হয়। পরিচয় সেবাটি পরিচালনা করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডিজিকন টেকনোলজিস। নির্বাচন কমিশনের তথ্যভান্ডার থেকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় সেবা দিয়ে পরিচয় যে রাজস্ব আয় করে, তার বড় অংশই (৮০ থেকে ৯০ শতাংশ) পায় ডিজিকন।

ডিজিকন টেকনোলজিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াহেদ শরীফ গত ১৮ জানুয়ারি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তাঁরা শুধু কারিগরি সেবা দিয়ে থাকেন। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডারে প্রবেশের সুযোগ নেই। তিনি জানান, পরিচয় কাজটি পেয়েছে সরাসরি ক্রয়প্রক্রিয়া বা ডিপিএম পদ্ধতিতে।

অপারেটররা বলছে, তারা এখন গ্রাহকের তথ্য যাচাই করে সরাসরি নির্বাচন কমিশনের তথ্যভান্ডার থেকে। এ জন্য গ্রাহকপ্রতি ৫ টাকা কমিশনকে দেয় তারা। অন্যদিকে ছবি যাচাইয়ের সুবিধা যোগ করে একই কাজে পরিচয় চাইছে গ্রাহকপ্রতি ১০ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডিজিকনকে ব্যবসা পাইয়ে দিতেই তথ্যভান্ডার তৈরির এই চাপ।

বিটিআরসি মোবাইল অপারেটরদের যে তথ্যভান্ডার বা ডেটাবেজ তৈরি করতে বলছে, সেটিতে গ্রাহকের নাম, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, মা-বাবার নাম, জন্মতারিখ, ঠিকানা, লিঙ্গপরিচয়, পেশা, ছবিসহ মোট ১৬ ধরনের তথ্য থাকবে। এই তথ্যগুলো নিতে হবে নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তথ্যভান্ডার থেকে।

বিটিআরসি তথ্যভান্ডারটি তৈরি করতে বলছে অপরাধ দমনের কথা বলে। তাদের যুক্তি হলো, এক ব্যক্তি বিভিন্ন নামে একাধিক সিম ব্যবহার করে নানা অপরাধ করেন। তথ্যভান্ডার তৈরি হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে ব্যক্তিকে শনাক্ত করা সহজ হবে। অন্যদিকে মোবাইল অপারেটরগুলো তথ্য নিতে বাড়তি ব্যয়, তথ্যভান্ডার তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয়ের কথা বলে এ ক্ষেত্রে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে।

সরকারি সংস্থা এনটিএমসি আগেই বলেছে, গ্রাহকের তথ্য তাদের কাছে আছে। নতুন করে তথ্যভান্ডার তৈরির প্রয়োজন নেই। এনটিএমসির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান সংবেদনশীল এসব উপাত্তের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, বিটিআরসির নির্দেশনা মানা হলে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ‘অটোফিলের’ মাধ্যমে দেশি–বিদেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে চলে যাবে। এটা নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার ঝুঁকি তৈরি করবে। পর্যাপ্ত সুরক্ষা ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য একত্রীকরণ হলে উপাত্ত লঙ্ঘন (বেহাত হওয়া) ও অপব্যবহারের আশঙ্কা থাকে। তিনি আরও বলেন, মোবাইল অপারেটরদের যদি তথ্যভান্ডার করতে হয়, তাহলে ১৯ কোটি ব্যবহারকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র তথ্যভান্ডারের হুবহু রেপ্লিকা (অনুলিপি) তৈরি হতে পারে।

অ্যামটব গত ১৪ ফেব্রুয়ারি দেওয়া এক চিঠিতে বিটিআরসিকে বলেছে, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যভান্ডার তৈরির জন্য কোনো আইনে অপারেটরদের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি তথ্যভান্ডার তৈরি করা হলে তা তথ্য বেহাতের ঝুঁকি তৈরি করে।

যেভাবে সিম বিক্রি

বিটিআরসি গত ৬ ফেব্রুয়ারি অপারেটরদের দেওয়া একটি চিঠিতে কীভাবে নতুন ব্যবস্থায় সিম বিক্রি করা যাবে, তা উল্লেখ করেছে। এতে বলা হয়েছে, গ্রাহক নতুন সিম কেনার সময় তাঁর জাতীয় পরিচিতি নম্বর দেবেন। ওই নম্বরের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট অপারেটরের আর কোনো সিম আছে কি না, সে–সংক্রান্ত একটি বার্তা অপারেটরকে খুচরা বিক্রেতার (রিটেইলার) কাছে পাঠাতে হবে।

যদি গ্রাহকের সংশ্লিষ্ট অপারেটরের কোনো সিম না থাকে, তাহলে তাঁকে নতুন সিম দেওয়া যাবে। যদি আরও সিম থাকে তাহলে তা খুচরা বিক্রেতা যাচাই করবেন এবং সিম নম্বরটি জানতে চাইবেন। গ্রাহক নম্বর বলতে পারলে সেটা যাচাই করতে হবে এবং নম্বরটি তথ্যভান্ডারে যুক্ত করে গ্রাহককে আরেকটি সিম দেওয়া যাবে।

বিটিআরসি বলেছে, গ্রাহকের বলা নম্বরটি যদি তাঁর এনআইডির বিপরীতে না থাকে, তাহলে নতুন সিম দেওয়া যাবে না। তাঁকে সংশ্লিষ্ট অপারেটরের গ্রাহক সেবাকেন্দ্র বা কাস্টমার কেয়ার সেন্টার থেকে নম্বর জেনে আসতে বলতে হবে। যদি অপর সিমের নম্বর গ্রাহক বলতে না পারেন, তাহলেও তাঁকে সিম দেওয়া যাবে না। তখন তাঁকে সেবাকেন্দ্রে গিয়ে নম্বর জেনে আসতে বলতে হবে।

দেশে একজন গ্রাহক নিজের জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে ১৫টি সিম কিনতে পারেন। মোবাইল অপারেটরগুলো সিম বিক্রির সময় জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নেয়, পাশাপাশি আঙুলের ছাপ মিলিয়ে দেখে। নতুন করে বিটিআরসি ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে তথ্যভান্ডার তৈরির কথা বলছে।

বিকল্প প্রস্তাব নাকচ

বিটিআরসি সূত্র জানায়, তথ্যভান্ডার তৈরির জন্য চিঠি পাওয়ার পর অপারেটররা তাদের সমিতির (অ্যামটব) মাধ্যমে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, পরিচয়ের মাধ্যমে যে তথ্য নিতে হবে, তার প্রায় সবই নির্বাচন কমিশন থেকে নেওয়া সম্ভব। তারা নির্বাচন কমিশন থেকে তথ্য নিয়ে তথ্যভান্ডারটি তৈরি করতে চায়।

অপারেটরদের প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছিল, প্রয়োজনে তারা ফেস রিকগনিশন (মানুষের চেহারা শনাক্তকরণ) সেবাও দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের তথ্যভান্ডার থেকে যাচাই সুবিধা নেওয়ার সুযোগ থাকতে হবে।

অ্যামটব গত ১৪ ফেব্রুয়ারি দেওয়া এক চিঠিতে বিটিআরসিকে বলেছে, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যভান্ডার তৈরির জন্য কোনো আইনে অপারেটরদের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি তথ্যভান্ডার তৈরি করা হলে তা তথ্য বেহাতের ঝুঁকি তৈরি করে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে একটি মোবাইল অপারেটরের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, পরিচয় বেশি টাকায় যেসব তথ্য নির্বাচন কমিশনের তথ্যভান্ডার থেকে নিয়ে দেবে, তা অপারেটররা সরাসরি কমিশন থেকেই নেওয়ার কথা বলেছে। তারপরও কেন প্রস্তাব নাকচ হলো, সেটা বোধগম্য নয়।

আদালতে রিট

বিষয়টি নিয়ে ‘বিটিআরসির চিঠি: বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসা পাইয়ে দিতে “সরকারি চাপ”’ শিরোনামে প্রথম আলোয় গত ৬ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে হাইকোর্টে রিট করা হয়। গত বুধবার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিষয়টি নিয়ে রুল দেন।

আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। পরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিটিআরসির ওই নির্দেশনা যদি মুঠোফোন কোম্পানিগুলো বাস্তবায়ন করে, তাহলে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে চলে যাবে। এতে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে।