গরমে এবার ঠোঁট ফাটা কমবে, ঘাম ঝরবে বেশি

ঘাটে অপেক্ষায় থাকা এক তরুণ রোদ সহ্য করতে না পেরে গামছা মুড়িয়ে বসে আছেন। জয়দেব এলাকা, গঙ্গাচড়া, রংপুর, ১৬ এপ্রিল।
ছবি: মঈনুল ইসলাম

দুই সপ্তাহ ধরে দেশের বেশির ভাগ এলাকাজুড়ে যে দাবদাহ চলছে, তার প্রধান কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। যেমন বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় শীতকালের মতো ঠোঁট ফেটে যাচ্ছিল। সেই সঙ্গে শরীর জ্বালাপোড়া করা এবং চামড়ায় ফোসকা পড়ার মতো সমস্যা বাড়ছিল। তবে আগামী কয়েক দিনে এটার কিছুটা পরিবর্তন দেখা যাবে।

আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, গতকাল শনিবার থেকে দেশের উত্তরাঞ্চল দিয়ে কিছুটা জলীয়বাষ্পসহ বাতাস আসতে শুরু করেছে। আজ রোববার তা বেশ বেড়েছে। এতে প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে ঠোট ফাঁটা ও শরীর জ্বালাপোড়া করার সমস্যা কাটতে যাচ্ছে।

তবে বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে গ্রীষ্মকালীন গরমের যে স্বাভাবিক চিত্র, তা ফিরে আসতে শুরু করেছে। তা হচ্ছে রোদে পোড়ার সঙ্গে ঘামেও ভিজতে হবে। বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় শুষ্কতা কমে গিয়ে ঘাম ঝরা বেড়ে যায়। সাধারণত এপ্রিলে বাংলাদেশের বাতাসে আর্দ্রতা ৭২ থেকে ৮২ শতাংশ থাকে। ফলে এই সময়ে মানুষ গরমের মধ্যে গেলেই ঘেমে যায়।

দুই সপ্তাহ ধরে চলা দাবদাহের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল, দেশের বড় অংশের আবহাওয়া অনেকটা মরুভূমির আবহাওয়ার মতো ছিল। মরুভূমির আবহাওয়ায় সাধারণত দিনের তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। আর রাতে তা ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। ২ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া দাবদাহে দেশের আবহাওয়াও এ রকম ছিল। ওই সময় উত্তরাঞ্চল দিয়ে অস্বাভাবিকভাবে দেশে শুষ্ক বাতাস প্রবেশ করে। কিছুটা শীতল ওই বাতাস দিনের রোদ কেটে গেলে প্রকৃতিতে জায়গা করে নিত। ফলে রাতের তাপমাত্রা কমে আসত।

গত শনিবার থেকে আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় দিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাতের তাপমাত্রাও বাড়তে শুরু করেছে। এক সপ্তাহ ধরে রাজধানীসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকাজুড়ে রাতের তাপমাত্রা ২০ থেকে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ছিল। কিন্তু আজ রোববার সন্ধ্যার পরে দেশের বেশির ভাগ এলাকায় তাপমাত্রা ২২ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছে। যেমন আজ ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হয়েছে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

এ ব্যাপারে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত দুই সপ্তাহ ধরে আমরা শুষ্ক বাতাসের কারণে ঠোট ফাঁটা ও শরীর জ্বালাপোড়া করার সমস্যায় ভুগেছি। এখন আর্দ্রতা বেড়ে গরমের কষ্টের সঙ্গে মানুষের বেশি করে ঘাম তৈরি হবে। রাতের তাপমাত্রা বেড়ে দিনের মতো রাতেও গরমের কষ্ট বাড়বে। এই পরিস্থিতি ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত চলতে পারে।’

গরমে প্রশান্তির জন্য পুকুরের জলে নেমে শরীর ডুবিয়ে স্থির হয়ে আছে এক কিশোর। জেলা পাড়া, গোপালপুর, পাবনা, ১৬ এপ্রিল।
ছবি: হাসান মাহমুদ

তবে রাতের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে দেশের উপকূলীয় জেলাগুলো। যেমন বরিশাল বিভাগের সব কটি জেলার রাতের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে দাঁড়িয়েছে। খুলনায় তা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছে। ফলে উষ্ণ দিনের মতো রাতের বেলাও মানুষকে গরমের কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে।

সাধারণত কোনো এলাকার তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে এবং ওই তাপমাত্রায় কেউ ১০ থেকে ১৫ মিনিট অবস্থান করলে ঘামতে শুরু করে। আর ওই আবহাওয়ায় শারীরিক পরিশ্রম বেশি হলে ঘামের পরিমাণ বেশি হয়। বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকলে সাধারণত এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।

দাবদাহের প্রচণ্ড গরমে মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। কোনো কোনো পরিবারে শিশুরা ঠান্ডা ও সর্দি জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রবীণেরা গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সচ্ছলদের কেনা শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) বাইরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাড়তি বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে গিয়ে সরকারের জ্বালানি ব্যয়ও বাড়ছে। ১৩ এপ্রিল রেকর্ড ১৫ হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়।

গড় তাপমাত্রা কতটা বেশি

দেশে সাধারণত মার্চ মাসে গরম শুরু হয়। আর বছরের সবচেয়ে উষ্ণ মাস এপ্রিল। এ বছর মার্চে স্বাভাবিকের চেয়ে ৭৮ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। গরম ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এপ্রিলের দ্বিতীয় দিনে যশোর-চুয়াডাঙ্গা দিয়ে একটি দাবদাহ শুরু হয়। সেটি এখন দেশের দুই–তৃতীয়াংশ এলাকায় বিস্তৃত।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে থাকা গত ৬০ বছরের তাপমাত্রার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এপ্রিলে সারা দেশের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ৩৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদপ্তরের একজন আবহাওয়াবিদ প্রথম আলোকে জানান, এ বছর এপ্রিলের প্রথম ১৬ দিনে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল।

এবারের এপ্রিলের দাবদাহের আরেকটি দিক হলো এর বিস্তৃতি বেশি। সাধারণত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও রাজশাহী বিভাগের কয়েকটি জেলায় এপ্রিল মাসে দুই থেকে তিনটি দাবদাহ বয়ে যায়। সেটাও তিন থেকে পাঁচ দিনের বেশি স্থায়ী হয় না। এবার এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে রংপুর বিভাগ ছাড়া সারা দেশেই মৃদু থেকে প্রচণ্ড দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে।

এপ্রিল মাসে সাধারণত দুই থেকে পাঁচটি কালবৈশাখী আঘাত হানে। সেই সঙ্গে বজ্রপাতসহ বৃষ্টি হয়। মাসের শুরুতে আবহাওয়া অধিদপ্তর যে পূর্বাভাস দিয়েছিল, তাতে তিন থেকে পাঁচ দিন হালকা বা মাঝারি এবং এক থেকে দুই দিন তীব্র কালবৈশাখীর আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এবার এখন পর্যন্ত কালবৈশাখীর দেখা নেই।

বৈশাখের খরতাপে অতিষ্ঠ জনজীবন। এমন দিনে কোলের শিশুসন্তানকে নিয়ে বাইরে বের হয়েছেন এক অভিভাবক। রোদ থেকে রক্ষায় শিশুর মাথায় দিয়েছেন রুমাল। শহীদ খোকন পার্কসংলগ্ন ফুল মার্কেট, বগুড়া শহর, ১৬ এপ্রিল
ছবি: সোয়েল রানা
আরও পড়ুন

ঢাকায় গরম আরও বেড়েছে

রাজধানীর তাপমাত্রা আজ রোববার ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছে, যা ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ১৯৬৫ সালে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল। আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থা আক্কু ওয়েদারের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ঢাকায় আজ গরম অনুভূত হয়েছে ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলাভূমি ও বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা বেশি থাকলে সেখানে দাবদাহ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। কারণ, দাবদাহে জলাভূমির পানি জলীয় বাষ্পে পরিণত হয়। তা মেঘ তৈরি করে, বৃষ্টি নামায়। ফলে তাপমাত্রা কমে আসে। ঢাকার চারপাশের নদী, জলাভূমি, খাল ও সবুজ এলাকা কমছে। বিরূপ পরিস্থিতির এটাও কারণ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আখতার মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বহুতল ভবন, কংক্রিটের রাস্তা ও এসি ঢাকাকে একটি তপ্ত ভূখণ্ডে পরিণত করেছে। শহরের জলাভূমি রক্ষা এবং গাছপালা বাড়ানোতে গুরুত্ব না দিলে সামনে এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের আরও পড়তে হবে।’