করোনাকালীন পড়াশোনার ঘাটতি পূরণে ব্যবস্থা নেই

করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে টানা প্রায় ১৮ মাস সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরাসরি পাঠদান বন্ধ ছিল
ফাইল ছবি

করোনা মহামারিকালে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় অষ্টম শ্রেণির অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীর বাংলা, ইংরেজি, গণিত বিষয়ে মধ্যম ও উচ্চমাত্রায় শিখনঘাটতি তৈরি হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের (বেডু) গবেষণাতেই এমন তথ্য উঠে এসেছিল।

এই ঘাটতি পূরণে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়াসহ বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে গত জুলাই মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। কিন্তু সেই কর্মপরিকল্পনা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।

এনসিটিবির কর্মপরিকল্পনা-সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো নির্দেশনা এখনো বিদ্যালয় পর্যন্ত যায়নি। শিক্ষাবিদেরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ ধরনের শিখনঘাটতি থেকে গেলে তা ভবিষ্যতে জাতির জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

আরও পড়ুন

শিক্ষার্থীদেরই ঘাটতি

করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে টানা প্রায় ১৮ মাস সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরাসরি পাঠদান বন্ধ ছিল। তবে বন্ধের ওই সময়ে টেলিভিশন, রেডিও ও অনলাইনে ক্লাস নেওয়াসহ নানাভাবে শিক্ষার্থীদের শেখানোর কার্যক্রম অব্যাহত রাখার চেষ্টা ছিল।

অবশ্য এসব কার্যক্রমে সব এলাকার সব শিক্ষার্থী সমানভাবে অংশ নিতে পারেনি। বিভিন্ন গবেষণাতেই বেরিয়ে আসে, ‘মন্দের ভালো’ এসব কার্যক্রমের সুফল বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পায়নি।

এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের কতটুকু শিখনঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা নিরূপণে গবেষণা চালায় বেডু। ২০২১ শিক্ষাবর্ষে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত (বর্তমানে নবম শ্রেণিতে পড়ে) শিক্ষার্থীরা যেহেতু পুরো পাঠ্যসূচিতে ২০২৪ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেবে, সে জন্য তাদের বাংলা, ইংরেজি, গণিতে কী মাত্রায় শিখনঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা দেখা হয় বেডুর গবেষণায়।

গবেষণায় উঠে আসে, মহামারিকালে অষ্টম শ্রেণির অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীর এই তিন বিষয়ে মধ্যম ও উচ্চমাত্রায় শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যা পূরণ করতে হবে। তবে জেলা বিবেচনায় পার্বত্য অঞ্চলের তিন জেলার পরিস্থিতি আরও খারাপ।

আরও পড়ুন

গবেষণাটি অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে করায় তাতে শুধু এই শ্রেণির ঘাটতির চিত্র উঠে এসেছে। তবে অন্য শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরও ঘাটতি হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকেরা। কারণ, মহামারিকালে সব শ্রেণির পাঠদানেরই একই অবস্থা ছিল।

শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ঘাটতি পূরণ নিয়ে আলোচনা, কথাবার্তাই বেশি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে শিক্ষার্থীদের ঘাটতি পূরণের আসল কাজে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। বরং করোনাকালে চালু হওয়া যে অ্যাসাইনমেন্ট (নির্ধারিত কাজ) কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের নিজে নিজে শেখার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিল, তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বলতে গেলে এখন সেই আগের মতোই গতানুগতিক ধারায় চলছে শিক্ষা কার্যক্রম।

এর মধ্যে আবার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই দিনের এই সাপ্তাহিক ছুটি এখন থেকেই স্থায়ী হচ্ছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকেরা জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন

শিক্ষাবিদেরা বলছেন, প্রতিবছর এমনিতেই অসংখ্য শিক্ষার্থী শিখনঘাটতি নিয়ে ওপরের শ্রেণিতে ওঠে। এর মধ্যে করোনাকালে প্রায় দুই বছর সশরীরে ক্লাস না হওয়ায় এই শিখনঘাটতির পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়েছে। এ অবস্থায় ঘাটতি পূরণ না করে ওপরের শ্রেণিতে উঠলেও তার নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে যাবে।

দেশের মাধ্যমিক স্তরে মোট শিক্ষার্থী এক কোটির কিছু বেশি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম দেখভাল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। শিক্ষার্থীদের ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা মাউশির মাধ্যমেই বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। কিন্তু এমন কোনো নির্দেশনা তারা এখন পর্যন্ত পায়নি।

জানতে চাইলে মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কোনো সিদ্ধান্ত তাঁদের কাছে আসেনি।’

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

ঘাটতি পূরণে ব্যবস্থা নেই

বেডুর গবেষণার সুপারিশের আলোকে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ঘাটতি (শিখনঘাটতি) পূরণে সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার একটি করে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ার কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে এনসিটিবি। এতে ওই তিন বিষয়ে মোট ৪৭টি অতিরিক্ত ক্লাস করতে বলা হয়। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলায় ১৫টি, ইংরেজিতে ১৭টি ও গণিতে ১৫টি অতিরিক্ত ক্লাস নেবে বলে বলা হয়।

রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে যেহেতু ঘাটতি থাকা শিক্ষার্থীর হার অনেক বেশি, তাই এই সব এলাকার জন্য আরও বেশিসংখ্যক অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে বলে উল্লেখ করে এনসিটিবি।

গত বছর অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা এখন নবম শ্রেণিতে পড়ে। তাদের অষ্টম শ্রেণিতে ঘাটতি হওয়া ক্লাসগুলো এ বছর নবম শ্রেণিতে ও আগামী বছর দশম শ্রেণিতে করাতে বলেছিল এনসিটিবি।

আগামী মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে। অর্থাৎ নবম শ্রেণি শেষ হয়ে ওই সব শিক্ষার্থীরা আগামী জানুয়ারি মাসে দশম শ্রেণিতে উঠবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের ঘাটতি পূরণের কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। অথচ গত জুলাই মাসে এনসিটিবি এ-সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিল।

রাজধানীর একটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, শিখনঘাটতি পূরণে অতিরিক্ত ক্লাস করানোর বিষয়ে তাঁরা নতুন কোনো নির্দেশনা পাননি। তবে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন হওয়ায় ক্লাস সমন্বয় করা হয়েছে।

ভবিষ্যতে বড় ক্ষতির আশঙ্কা

এনসিটিবির কর্মপরিকল্পনায় অষ্টম শ্রেণির পড়াশোনার ঘাটতি পূরণের কথা বলা হয়েছে। তবে করোনাকালে অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরও শিখনঘাটতি হয়েছে। কিন্তু কোনো শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরই ঘাটতি পূরণে কোনো ব্যবস্থা দৃশ্যমান নয়।

জানতে চাইলে মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এসএম হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর জানা মতে প্রাথমিকের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যাতে ঘাটতি শনাক্তের পাশাপাশি তা নিরাময় করা যায়। কিন্তু মাধ্যমিকে এ রকম কোনো উদ্যোগের কথা তাঁর জানা নেই।

আরও পড়ুন

হাফিজুর রহমান বলেন, যদি মনে করা হয়, শিক্ষার্থীরা এভাবেই পার পেয়ে চলে যাক, তাহলে সেটি ভবিষ্যতে জাতির জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হবে। আসলে যখন যা করার দরকার ছিল, তা করা হয়নি। তবে এখনো অন্তত শিক্ষার্থীদের পথ দেখানোর সময় আছে, যাতে তারা পরবর্তী শ্রেণিতে গিয়েও সমস্যার সমাধান করতে পারে। এ জন্য শিক্ষকদেরও দক্ষ করে তুলতে হবে।