ক্যাসিনো-কাণ্ডের মামলাগুলোর কী হাল

ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও কাজী আনিসুর রহমানফাইল ছবি

অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পর ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের তৎকালীন সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট। পরে তাঁর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, মানি লন্ডারিং, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও অস্ত্র আইনে চারটি মামলা হয়।

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও অস্ত্র আইনের তিন মামলায় সম্রাটের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য তারিখ পড়ছে। আর মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত এখনো চলছে।

সম্রাট ছাড়াও ক্যাসিনো-কাণ্ডে জড়িত অভিযোগে পাঁচ বছর আগে যুবলীগের তৎকালীন নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, কাজী আনিসুর রহমান, এ কে এম মমিনুল হকসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে ৫৫টি মামলা হয়। এর মধ্যে বিচারিক আদালতে মাত্র পাঁচটি মামলার রায় হয়েছে। এতে সাজা হয়েছে প্রভাবশালী ঠিকাদার জি কে শামীম, সেলিম প্রধান, গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহসভাপতি এনামুল হক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুপন ভূঁইয়াসহ ২০ জনের।

সম্রাটের বিচার শুরু হয়নি

ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট
ফাইল ছবি

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধে জড়িত অভিযোগে ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর সম্রাটের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে ২ কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়।

মামলাটি তদন্ত করে ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর সম্রাটের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অভিযোগপত্র গ্রহণ বিষয়ে শুনানির প্রথম তারিখ ধার্য করা হয়েছিল ২০২১ সালের ১০ জানুয়ারি।

২০২২ সালের ২২ মার্চ অভিযোগপত্র আমলে নেন ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত। মামলাটি বিচারের জন্য ২০২২ সালের ২৭ মার্চ ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬-এ পাঠানো হয়। এ মামলায় গত ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত কেবল অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানির জন্যই তারিখ ধার্য হয় ১৬ বার। প্রতিটি তারিখে সম্রাটের আইনজীবী অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানির জন্য সময় চেয়েছেন।

দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধের অভিযোগে সম্রাটের বিরুদ্ধে করা মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানি চলমান রয়েছে।

এ ছাড়া অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় সম্রাটের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানির জন্য সময় চেয়ে আদালতে একাধিকবার আবেদন করা হয়েছে বলে আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে।

অপর মামলাটি সম্পর্কে সম্রাটের আইনজীবী আফরোজা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, মানি লন্ডারিং আইনে তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) করা মামলাটির তদন্ত চলমান।

চারটি মামলার ক্ষেত্রেই সম্রাটের আইনজীবী আদালতে দাবি করেছেন, এগুলো হয়রানিমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

২০২২ সালের ২৭ আগস্ট সম্রাট জামিনে কারামুক্ত হন।

খালেদের ব্যাংক হিসাব অবমুক্ত

খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া
ফাইল ছবি

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে গুলশান থেকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। পরে তাঁর বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা হয়। পাঁচটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্য গ্রহণ চলমান রয়েছে।

খালেদের বিরুদ্ধে করা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলাটি ঢাকার বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে বিচারাধীন। আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এই মামলায় ১৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে।

আদালত সূত্রে জানা যায়, মানি লন্ডারিং মামলায় গত বছরের ২০ মার্চ খালেদের ব্যাংক হিসাব অবমুক্ত করার আদেশ হয়। আদেশে আদালত বলেন, খালেদের অসুস্থতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাঁর সুচিকিৎসার জন্য ব্যাংক হিসাব অবমুক্ত করার আদেশ দেওয়া হলো। একই সঙ্গে তাঁর ফ্ল্যাটের জব্দ করা কাগজপত্র অবমুক্ত করা হলো।
২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর জামিনে কারামুক্ত হন খালেদ।

আনিসুরের ব্যাংক হিসাবও অবমুক্ত

কাজী আনিসুর রহমান
ফাইল ছবি

কাজী আনিসুর রহমান কেন্দ্রীয় যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ১৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১৯ সালে আনিসুরের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।

মামলা তদন্ত করে ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আনিসুরের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ৭ মার্চ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালত। এ মামলায় ৪৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।

আনিসুরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৭ নভেম্বর তাঁর ব্যাংক হিসাব অবমুক্তের আদেশ দেন আদালত। আদেশে বলা হয়, দৈনন্দিন জীবনযাপনের লক্ষ্যে ব্যবসা পরিচালনা ও কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার জন্য শর্ত সাপেক্ষে তাঁর ব্যাংক হিসাব অবমুক্ত করা হলো।
আনিসুর বর্তমানে জামিনে আছেন।

খালেদ ও আনিসুরের ব্যাংক হিসাব অবমুক্তের বিষয়ে দুদকের অন্যতম আইনজীবী খুরশীদ আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, এই দুজনের ব্যাংক হিসাব অবমুক্তের তথ্য তাঁর জানা নেই। তবে ব্যাংক হিসাব অবমুক্তের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে দুদক উচ্চ আদালতে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।

আরও পড়ুন

মমিনুলের বিচার শেষ হয়নি

এ কে এম মমিনুল হক

মমিনুল হক ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে ৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা আয়ের অভিযোগে ২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।

মামলা তদন্ত করে ২০২২ সালের ১৭ এপ্রিল মমিনুলের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। গত বছরের ১৪ আগস্ট তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এ মামলায় মাত্র একজনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।

মমিনুলের বিরুদ্ধে সিআইডি দুটি মামলা করে। একটি মামলায় ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এতে বলা হয়, নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে মোহামেডান ক্লাবে ক্যাসিনোর ব্যবসা চালানোর সুযোগ করে দিয়ে সেখান থেকে প্রতিদিন পাঁচ লাখ টাকা করে নিতেন মমিনুল। এ মামলার বিচার শুরু হয়েছে।

সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজি ও ক্যাসিনো (জুয়া) থেকে ২৫ কোটি টাকা আয়ের অভিযোগে ২০২১ সালের ৩০ মে মমিনুলের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করে সিআইডি। মামলায় সিআইডি বলেছে, আরামবাগের বিভিন্ন দোকান, ফুটপাতের ১২ হাজারের বেশি দোকান ও বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর লোকজন চাঁদা তুলতেন। এই টাকা তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বৈশাখী এন্টারপ্রাইজের ব্যাংক হিসাবে জমা হতো। তিনি আরামবাগ স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর ‘ওয়ান টেন’ (একধরনের জুয়া) চালু করেন। জুয়া ও চাঁদা থেকে আসা ১৪ কোটি ৪২ লাখ ২৫ হাজার টাকা ওই ব্যাংক হিসাবে জমা করার তথ্য পেয়েছে সিআইডি। মামলাটির তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

আরও পড়ুন

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির মিডিয়া উইংয়ের পুলিশ সুপার আজাদ রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশে অর্থ পাচারের মামলার তথ্য সংগ্রহ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ শেষে যত দ্রুত সম্ভব, আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে।

ক্যাসিনো-কাণ্ডে জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া কৃষক লীগের বহিষ্কৃত কেন্দ্রীয় নেতা কাজী শফিকুল আলম ওরফে ফিরোজের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংসহ চারটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। মামলাগুলো সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংসহ চারটি মামলার বিচার চলমান রয়েছে। ২০১৯ সালে সম্রাটের সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন যুবলীগের তৎকালীন নেতা এনামুল হক ওরফে আরমান। তাঁর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা আছে। মামলা বিচারাধীন।

খালেদ, আনিসুর, মমিনুলসহ প্রত্যেক আসামি আদালতে নিজেদের নিরপরাধ দাবি করেছেন। তাঁদের দাবি, মামলা হয়রানিমূলক।

আরও পড়ুন

সাজা হয়েছে ২০ জনের

জি কে শামীম
ফাইল ছবি

ক্যাসিনো-কাণ্ডে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের পৃথক দুই মামলায় আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা দুই ভাই এনামুল ও রুপনসহ ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। এনামুল-রুপনের বিরুদ্ধে আরও অন্তত নয়টি মামলার বিচার চলমান।

মানি লন্ডারিং আইনের মামলায় সাজা হয়েছে অনলাইন ক্যাসিনো কারবারি সেলিম প্রধানের। তাঁর বিরুদ্ধে আরও চারটি মামলার বিচার চলমান।

এ ছাড়া মানি লন্ডারিং মামলায় প্রভাবশালী ঠিকাদার জি কে শামীম ও তাঁর সাত দেহরক্ষীর সাজা হয়েছে। অস্ত্র আইনের মামলায়ও এই আটজনের সাজা হয়েছে। শামীমের আরও চারটি মামলার বিচার চলমান।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু প্রথম আলোকে বলেন, মামলাগুলো যাতে বিচারিক আদালতে নিষ্পত্তি হয়, সে জন্য রাষ্ট্রপক্ষের উদ্যোগ আগেও ছিল, এখনো আছে।

আরও পড়ুন