গুম–খুনের বিচার না হওয়া পর্যন্ত নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি রচিত হবে না: পরিবেশ উপদেষ্টা

গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানছবি: প্রথম আলো

পতিত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে হওয়া গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি রচিত হবে না বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, এসব গুম ও খুনের বিচার হলে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মানুষের আস্থা জন্মাবে।

আজ শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা এ কথাগুলো বলেন। গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’।

আলোচনা সভায় রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘নিজস্ব স্বার্থের ওপরে উঠে নির্ভীকচিত্তে না দাঁড়িয়ে শুধু অবিশ্বাস দিয়ে, হতাশা দিয়ে পরিস্থিতির পরিবর্তন আমরা কেউই করতে পারব না। আমাদের বলতে হবে বিচার করতেই হবে। নতুন বাংলাদেশের ভিত্তিও, পরিবর্তিত বাংলাদেশের ভিত্তিও রচিত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত বিচারগুলো না হবে। বিচার যখন হবে, প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মানুষের আস্থা জন্মাবে।’

স্বৈরশাসন–পরবর্তী পরিবর্তন বিশ্বের কোথাও মসৃণ হয়নি উল্লেখ করে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, ‘তাই বিচারের দাবি কখনো ছাড়া যাবে না। একটা দেশ সন্দেহ ও অবিশ্বাসের ওপর গড়ে ওঠবে না। পরিবর্তন নিজে নিজে আসবে না। পরিবর্তন আমাদের আনতে হবে।’

এখনো গুম–খুনের সাক্ষী হতে মানুষ ভয় পান উল্লেখ করে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘যাঁরা ভাবছেন যে বিচারের দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা খুব সুখে আছেন; কারণ, রাস্তাটা খুবই পরিষ্কার, ব্যাপারটা কিন্তু এ রকম নয়। যাঁরা সাক্ষ্য দিতে আসবেন, তাঁরাও ভয় পান। জায়গায় জায়গায় ঢাকার বাইরে গিয়ে সে ভয় ভাঙানো হচ্ছে। কাজেই এটা একটা প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়া কারও জন্য সহজ নয়। বিশেষ করে ১৬ বছরের স্বৈরাচারের শাসনের পরে এই যাত্রাটা আমরা শুরু করেছি।’

গুমের শিকার পরিবারের সুরক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই উল্লেখ করে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, ‘গতকাল (বৃহস্পতিবার) গুম বিষয়ে একটি আইন নীতিগত অনুমোদন হয়েছে। সেই আইনের ২৪ ধারায় তহবিল গঠন ও ভুক্তোভোগী পরিবারকে আইনি সহায়তার বিধান রাখা হয়েছে।’

আলোচনা সভায় অধিকারের প্রেসিডেন্ট তাসনিম সিদ্দিকীর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বিবৃতি পাঠ করেন অধিকারের জ্যেষ্ঠ গবেষক তাসকিন ফাহমিনা। এ সময় তিনি সব গুমের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করা, নিখোঁজ ব্যক্তিদের অনুসন্ধানের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন, সাজানো মামলা প্রত্যাহার, ভুক্তভোগী যেন ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করতে পারে, সে জন্য ‘সার্টিফিকেট অব অ্যাবসেন্স’ প্রদান, ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ বাতিল বা সংশোধন এবং র‍্যাবকে বিলুপ্ত করাসহ অধিকারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে ১০টি দাবি তুলে ধরেন।

সঠিকভাবে কাজ না হলে গুম নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ বেশি দূর এগোবে না মন্তব্য করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তাসমিরুল ইসলাম বলেন, ‘গুমের কথা বলতে গেলে কোন বাহিনীর কোন সদস্যদের নাম উঠে আসছে? সেই জায়গায় আমাদের সোচ্চার হতে হবে। নাহলে গুম প্রতিরোধ নিয়ে বেশি দূর এগোনো যাবে না।’

গুমবিষয়ক তদন্ত কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিস বলেন, এ কমিশনের কাছে এখন পর্যন্ত গুম–সংক্রান্ত ১ হাজার ৮০০ এর বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রশাসনিক কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে। পাশাপাশি যেসব জনবল ও সক্ষমতা দরকার, সেটা তৈরি না হলে সমস্যা থেকে যাবে।’

মানবাধিকার রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে উল্লেখ করে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রয়োজনে আবারও অভ্যুত্থান হবে। কিন্তু গুম ও খুনের বিচার হতেই হবে। আমাদের লড়াই শেষ হয়ে যায়নি। তাই বিচার সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত সরকারকে বাধ্য করতে হবে।’

২০১৯ সালে গুমের শিকার ইসমাইল হোসেনের স্ত্রী নাসরিন জাহান প্রশ্ন তোলেন, স্বৈরাচার পতনের পর এখনো কেন বিচারের জন্য তাঁদের ধারে ধারে ঘুরতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমি কবে আমার সন্তানের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব যে তার বাবা কবে ফিরবেন? এখন পর্যন্ত আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কেন খুলে দেওয়া হচ্ছে না? আমরা এই জীবন থেকে অবসর নিতে চাই, স্বামীর হদিস চাই।’

আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন দৈনিক আমার দেশের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, ২০২৩ সালে ধামরাই থেকে গুমের ভুক্তভোগী রহমত উল্লাহ, ২০১২ সালে গুম হওয়া বরিশালের ছাত্রদল নেতা ফিরোজ খানের স্ত্রী আমেনা আক্তার, ২০১৫ সালে উত্তরা থেকে গুমের ভুক্তভোগী আইনজীবী সোহেল রানা, ২০১২ সালে রাজধানী থেকে গুম হওয়া মুকাদ্দাসের চাচা আবদুল হাই প্রমুখ।

আরও পড়ুন