ফেরি রজনীগন্ধা যখন ডুবছিল, সবাই ছিলেন ঘুমে

পদ্মা নদীতে ডুবে যাওয়ার অষ্টম দিনে ফেরি রজনীগন্ধা উদ্ধার করা হয়প্রথম আলো ফাইল ছবি

দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ‘চরম গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতা’র কারণে ডুবেছিল রজনীগন্ধা ফেরিটি। নোঙর করার পর ফেরিটির দায়িত্বশীল সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তখন ক্ষতিগ্রস্ত অংশ দিয়ে পানি ঢুকে পড়ে। সবাই ঘুমিয়ে থাকায় পানি সেচে ফেলার কেউ ছিলেন না।
গত ১৭ জানুয়ারি সকালে পাটুরিয়া ৫ নম্বর ঘাটের কাছাকাছি নোঙর করে থাকা ফেরিটি নয়টি যানবাহন নিয়ে ডুবে যায়। দুর্ঘটনার পর পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে চরম গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতার কথা উল্লেখ করা হয়। আর ফেরির দায়িত্বশীলদের ঘুমিয়ে পড়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন বিআইডব্লিউটিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

এর জন্য দায়ী বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে অব্যাহতি, সাময়িক বরখাস্ত ও কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি)। সংস্থাটির এক নথিতে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে ইনচার্জ মাস্টারের বিধি লঙ্ঘন, তিনি ও অন্য কর্তব্যরত কর্মীদের চরম গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতার কারণে ফেরিটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান এ কে এম মতিউর রহমান আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ফেরিটি যাত্রা করার আগে কিছু বিষয় যাচাই–বাছাই করতে হয়; যা রজনীগন্ধার ক্ষেত্রে ঠিকভাবে করা হয়নি। মূলত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলা, ঘন কুয়াশা, ধারণক্ষমতার বেশি ওজন বহন করায় ফেরিটি ডুবেছে। এ জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
১৬ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১২টার পর রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া প্রান্ত থেকে পাটুরিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে ইউটিলিটি (ছোট) ফেরি রজনীগন্ধা। রাত দেড়টার দিকে ঘন কুয়াশার কারণে পাটুরিয়ার ৫ নম্বর ঘাটের অদূরে পদ্মা নদীতে নোঙর করে ফেরিটি। পরদিন সকাল সাড়ে আটটার দিকে ফেরিটি ডুবে যায়। এ ঘটনায় ফেরির দ্বিতীয় ইঞ্জিনচালক হুমায়ুন কবিরের মৃত্যু হয়।

ডুবে যাওয়া ফেরি উদ্ধারে গত ১৭ জানুয়ারি পাটুরিয়া ঘাটে আসে উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা
ফাইল ছবি

ফেরিটি যেভাবে ডুবে গেল

বিআইডব্লিউটিসির ওই নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ফেরিটির কোনাগুলির বাউন্ডারি রেলিং ও ডেকের নিচে হালের অংশ অন্য ফেরির সঙ্গে সংঘর্ষে বা পন্টুনে ভেড়ানোর সময় ধাক্কা লেগে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তদন্ত কমিটির সদস্য ও দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন যে ঘন কুয়াশার কারণে ঘাট দেখতে পাওয়া যায়নি। ফলে ঘাটের কাছাকাছি এলেও ফেরিটি ভিড়তে পারেনি। ঘাটের কাছাকাছি ফেরিটি নোঙর করে দায়িত্বশীল সবাই ঘুমিয়ে পড়েন। তখন ফেরির ক্ষতিগ্রস্ত অংশ দিয়ে পানি ঢুকে পড়ে। সবাই ঘুমিয়ে থাকায় সেই পানি সেচ দিতে পারেননি ফেরির দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। যখন তাঁরা দেখেছেন যে ফেরি ডুবে যাচ্ছে, তখন তাঁরা চেষ্টা করেও ডোবানো ঠেকাতে পারেননি।

দায়িত্বশীল কর্মকর্তা পেলেন শুধু নোটিশ

মারাত্মক দায়িত্বহীনতা ও গাফিলতির কারণে যেসব কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিআইডব্লিউটিসির পাটুরিয়া প্রান্তিকের এজিএম (মেরিন) মো. আহাম্মদ আলী। বিআইডব্লিউটিসির মুখ্য কর্মচারী ব্যবস্থাপক মো. ফজলে রাব্বির সই করা কারণ দর্শানোর চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘ফেরিটির কোনাগুলির বাউন্ডারি রেলিং ও ডেকের নিচে হালের অংশ অন্য ফেরির সঙ্গে সংঘর্ষে বা পন্টুনে ভেড়ানোর সময় ধাক্কা লেগে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই রুটে ফেরিটি পরিচালনার ক্ষেত্রে মাস্টাররা ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। ফেরিটি পরিচালনা, পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মারাত্মক দায়িত্বহীনতা ও গাফিলতি করেছেন। পাটুরিয়া অঞ্চলের নৌ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে আপনি এর দায় এড়াতে পারেন না।’
পাটুরিয়া অঞ্চলের নৌ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে শুধু কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলেও ফজলে রাব্বির সই করা চিঠিতেই দায়িত্ব পালনে চরম গাফিলতির কারণে অস্থায়ী গ্রিজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মো. মামুন সিকদারকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে ইনল্যান্ড মাস্টার অফিসার মেহের আলী, লস্কর মানিক রায়, হুইল সুকানী মো. সবুজ মিয়া ও লস্কর মো. মুরাদকে। আর হুইল সুকানী মো. আরিফুর রহমান, লস্কর মো. শাহ জাহান ও লস্কর মো. মনির আহাম্মদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। আরও কয়েকজন কর্মকর্তা–কর্মচারীকে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি ও জবাবদিহির আওতায় আনা হয়েছে। তা ছাড়া ঘটনার পরপরই সাময়িক বরখাস্ত করা হয় ফেরির সেকেন্ড মাস্টার মো. আঞ্জুমানকে।

ফেরিতে বসছে সিসিটিভি

রজনীগন্ধা দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুর্ঘটনা রোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বিআইডব্লিউটিসি। এর মধ্যে রয়েছে ফেরিতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন। দুটি ফেরিতে পরীক্ষামূলকভাবে সিসিটিভি স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি ফেরিতে দুটি সিসিটিভি ক্যামেরা থাকছে। যার একটি মাস্টারের কক্ষে, অন্যটি ইঞ্জিনকক্ষে থাকছে। সব ফেরিতে এভাবে সিসিটিভি বসানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যা প্রধান কার্যালয় থেকে পর্যবেক্ষণ করা হবে।
জলযান যাত্রা শুরুর আগে আবশ্যিকভাবে সেটির নিরাপত্তা পরিদর্শন করা হচ্ছে। ধারণক্ষমতার বেশি ওজন না নেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রতিদিন সকালে আবহাওয়ার পূর্বাভাস হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে নাবিকদের জানানো হচ্ছে। সব জলযানে প্রতি পালায় আবশ্যিকভাবে হাজিরা গ্রহণ করা হচ্ছে। সব ফেরিতে সাউন্ডিং পাইপ (ফেরিতে পানির পরিমাপক) স্থাপন করা হচ্ছে।