আনন্দ-উচ্ছ্বাসে হয়ে গেল দেশের প্রথম ‘মিম’ উৎসব
ইন্টারনেটের যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সর্বক্ষণ জুড়ে থাকা লোকজনকে এখন আর ‘মিম’ কী, সেটা বলে বোঝানোর বিশেষ দরকার পড়ে না। তবু সহজ করে বলতে গেলে হয়তো এভাবে বলা যায়— নানা রকম ছবির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সরস কথার সংযোগ— এই হলো মিম।
দেশে প্রথমবারের মতো হয়ে গেল মিম নিয়ে উৎসব। অনলাইন স্যাটায়ার সাইট ‘ই-আরকি’র আয়োজনে মিম নিয়ে দিনভর এই উৎসব ছিল তেজগাঁও–গুলশান লিংক রোড–সংলগ্ন আলোকি কনভেনশন সেন্টারে। মঙ্গলবার সকাল ১১টায় অনানুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় এই উৎসবের কার্যক্রম।
বিষয়টিই যখন মজার, তখন উৎসবে তো মজা হবেই। মিম নিয়ে অনেক রকমের আয়োজন ছিল এ উৎসবে। মিমের জনপ্রিয় চরিত্রগুলো নিয়ে নানা আকারের কাটআউট, মিম ভোটের পোস্টার, ডিজিটাল প্রিন্টের জ্যামিতিক স্থাপনা—এমন অনেক কিছুতে সেজেছিল উৎসব প্রাঙ্গণ। দর্শকদের অনেকেই এসব মিমের সঙ্গে ছবি তুলে উৎসবের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতেই ব্যস্ত থেকেছেন।
‘হেলমেট’, ‘সহমত ভাই’—এসব শব্দ মিমের কল্যাণে ব্যাপক প্রসিদ্ধি পেয়েছে। মিলনায়তনে প্রবেশপথে শুরুতে ছিল সারি করে রাখা হেলমেটের ওপর রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে একগুচ্ছ মিম। আরও ছিল চলচ্চিত্র, ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের নাটকের বিভিন্ন চরিত্র, খেলা, পরিবেশসহ সমসাময়িক বিষয় নিয়ে বিচিত্র মিম। জনপ্রিয় মিম ও সেগুলোর ইতিহাস নিয়ে ছিল ‘মিম জাদুঘর’।
দর্শকেরা শুধু দেখবেন তা হবে কেন? নিজেরাও যেন মজার মজার কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন, তারও নানা ব্যবস্থা ছিল। এর একটি ভাগ্যের চাকা। সেই চাকা ঘুরিয়ে প্রাপ্ত নম্বর অনুসারে ছবি দিয়ে মিম তৈরি করেছেন আগ্রহী দর্শকেরা। সেসব প্রদর্শনীও হয়েছে। ছিল মিম নিয়ে কুইজ। আর দারুণ জমে উঠেছিল মিম চরিত্র নিয়ে ভোট। ব্যালট পেপারে সাম্প্রতিক কালের জনপ্রিয় ছয় চরিত্রের ছবি। ভোটের বুথ দুটি। একটির নাম ‘জ্যোৎস্না রাতে কয়েকজন ভোটার’ অন্যটি ‘দিনের আলোর ভোটার’। ব্যালট পেপার আর সিল হাতে নিয়ে ভোটারেরা যার যে বুথে ইচ্ছা ভোট দিতেও গেছেন।
সুদূর কুষ্টিয়া থেকে উৎসবে উপস্থিত হন শীতকালীন মিমের জনপ্রিয় চরিত্র ‘ছোটন কাকু’। তিনি উপস্থিত হলে আয়োজক ও মিম ভক্তরা, ‘ছোটন কাকুর আগমন/শুভেচ্ছা স্বাগতম’, ‘ছোটন কাকু এগিয়ে চল...’ ইত্যাদি স্লোগানে উৎসবস্থল সরগরম করে তোলেন। এই ছোটন কাকুর প্রকৃত নাম শামসুল হক। ২০১৬ সালে এক টিভি চ্যানেলে শীত নিয়ে তার একটি মন্তব্য ভাইরাল হয়। তারপর এ নিয়ে মিম করা হলে ‘ছোটন কাকু’ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক পরিচিতি পান তিনি। সেই ছোটন কাকুকে কাছে পেয়ে অনেকেই তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন।
ই–আরকি সম্পাদক সিমু নাসের বলেন, মিম এখন সমাজমাধ্যমের একটি বিশেষ ভাষা হিসেবে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অনেক কথা সরাসরি বলা যায় না। মানুষ বিশেষ ভঙ্গির ছবির সঙ্গে তাদের ভাবনা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-শ্লেষের মাধ্যমে তুলে ধরেন। কেবল মজার বিষয়, সমালোচনা এসবই নয়, অনেক সামাজিক সমস্যা, নীতি–নৈতিকতার অনেক প্রসঙ্গও মিমের মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে। এমনকি বাণিজ্যিক প্রচারেও এখন মিমের ব্যবহার বাড়ছে।এসব কারণেই মিম নিয়ে এমন উৎসব।
দুপুর থেকে শুরু হয় মিম তৈরির কৌশল, ভাষা, নৈতিকতা, আইন—এমন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কর্মশালা। এতে অংশ নেন নির্বাচিত ৩০ মিমার (যারা মিম তৈরি করেন)। কর্মশালায় বিষয়গুলো নিয়ে বলেন নির্মাতা আশফাক নিপুন, টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক সাবহানাজ রশীদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহা মীর্জা, ডিজিটাল রাইটের প্রতিষ্ঠাতা মিরাজ আহমেদ, উন্নয়ন যোগাযোগবিশেষজ্ঞ শারারাত ইসলাম ও নগদের হেড অব ব্র্যান্ড মনসুরুল আজিজ।
এরপরে সন্ধ্যায় আয়োজন করা হয় মিম নিয়ে প্যানেল আলোচনা। এতে উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘মিম সম্পর্কে শুরুতে আমাদের ধারণা তেমন স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু এখন নিত্যদিনের জীবনযাত্রার বহু বিষয় মিমের অংশ হয়ে যাচ্ছে। একটি নতুন ভাষা গড়ে উঠেছে। এর সঙ্গে সৃজনশীলতা আর মতপ্রকাশের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।’
উন্মাদ পত্রিকার সম্পাদক আহসান হাবিব মিম তৈরির সময় সীমালঙ্ঘন ও শালীনতা মেনে চলার প্রতি গুরুত্ব দেন। এ পর্বে আরও আলোচনা করেন মিমের মোরশেদ মিশু, পৌষী রাজ্জাক, রুম্মান আর কালাম। সঞ্চালনা করেন সৈয়দ খালেদ সাইফুল্লাহ। ছোটন কাকুকে সম্মাননা ও মাফলার দেওয়া হয়। পরে মিম প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন অতিথি ও আলোচকেরা।
‘স্ট্যান্ড-আপ ঢাকা’র কমেডিয়ান বিপ্র, হৃদয় ও শাদিদের কমেডি এবং শিল্পী সন্ধি ও সভ্যতার গাওয়া ‘যেজন মিমের মর্ম বোঝে না, তার সাথে নাই লেনাদেনা’ গানে উৎসবের সমাপ্তি টানা হয়।