ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার আগে সংসদীয় কমিটিতে আমরা কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ না করে আইনটি সংসদে পাস করা হয়।
তখনই আমরা বলেছিলাম, আইনটি ত্রুটিপূর্ণ, এটিতে অসম্পূর্ণতা আছে। কারণ, আমাদের অনেক দাবি সেটিতে মানা হয়নি।
আমাদের মূলত উদ্বেগ ছিল চারটি জায়গায়। প্রথমটি ছিল প্রয়োগের ক্ষেত্রে। কারণ, আইনটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যার ফলে এটির অব্যবহার ও অপপ্রয়োগের আশঙ্কা আছে।
দ্বিতীয় উদ্বেগটি ছিল, এই আইনে অনেকগুলো ধারা আছে, যেগুলো অজামিনযোগ্য। এ জন্য আমরা বলেছিলাম, এগুলো জামিনযোগ্য করতে হবে।
তৃতীয়টি হলো, আইনে শাস্তির মাত্রা অনেক বেশি, এটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা। একই সঙ্গে জরিমানার হারও স্বাভাবিক পর্যায়ে আনার দাবি ছিল আমাদের।
আর চতুর্থটি হলো, আইনটি সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে প্রয়োগের আগে প্রাইমাফেসি (প্রাথমিক সত্যতা) ঠিক করার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ ঠিক করা দরকার। আমরা প্রাথমিকভাবে বলেছিলাম, কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করার আগে অভিযোগটি বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলে পাঠানো হোক। তখন তারা (সরকার) বলেছিল, এ নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যাত্রাটি শুরু হয়েছিল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন দিয়ে। ওই আইনের ৫৭ ধারার ব্যাপক অপপ্রয়োগ হয়েছিল। তখন আমরা বলেছিলাম, এই অপপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।
তখন বর্তমান আইনমন্ত্রীই (আনিসুল হক) বলেছিলেন, তাঁরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করছেন, তাতে ৫৭ ধারা আর থাকবে না। কিন্তু দেখা গেল ৫৭ ধারা অপসারণ করা হলোই না, বরং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আরও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেওয়া হলো।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আমরা আমাদের আপত্তি জানিয়েছি। মানুষ আমাদের পক্ষে। এখন তারা (সরকার) বলছে, নতুন আইনে এটি (আপত্তির দিকগুলো) থাকবে না।
আমরা বলেছি, সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সাইবার আইন থাকা দরকার। আমরা সাইবার আইনের পক্ষে। কারণ, এখন সাইবার অপরাধের মাত্রা নানাভাবে বেড়ে গেছে।
কিন্তু সেই আইন যাতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের অধিকার—এসব জায়গায় যেন অপপ্রয়োগ না হয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে যেসব উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলাম, আশা করি সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে এগুলো থাকবে না।
আমরা নতুন আইনের (সাইবার নিরাপত্তা আইন) খসড়াটি এখনো দেখিনি। কিন্তু আইনমন্ত্রী বলেছেন, জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হয়েছে। দেখতে চাই আমরা কতগুলো ধারা (জামিনযোগ্য) বাড়াতে বলেছিলাম, আর তাঁরা কতটুকু বাড়িয়েছেন।
সরকার বলছে, সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা হবে না, জরিমানা করা হবে। জরিমানার পরিমাণটা কত, সেটি দেখতে হবে। আরও দেখতে হবে যে বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা অত পরিমাণ জরিমানা দিতে পারবেন কি না। নতুন আইন প্রয়োগের ক্ষমতা কাদের দেওয়া হবে, সেটিও দেখতে চাই।
এসব যদি পরিবর্তন করা না হয়, তাহলে কয়েকটি ধারা পরিবর্তন করলে আমাদের যে উদ্বেগ সেগুলো প্রশমিত হবে না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংগঠন এবং জাতিসংঘের উদ্বেগও প্রশমিত হবে না।
কাজেই সাইবার নিরাপত্তা আইনের যে খসড়া আগামী সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে তোলা হবে, আমরা আশা করব অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে, বিশেষ করে সম্পাদক, সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক, আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে সাইবার নিরাপত্তা আইন যেন একটি ভালো আইনে পরিণত হয়, আমরা সেই প্রত্যাশা করব।
মনজুরুল আহসান বুলবুল, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি