এফডিসির একাল-সেকাল ২: ডিজিটালে পিছিয়ে, ‘ডুবছে’ মামলা-দুর্নীতিতেও

অবহেলায় পড়ে আছে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি
ছবি: মানসুরা হোসাইন

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার দেলোয়ার জাহান ঝন্টু তাঁর অনেক চলচ্চিত্রের শুটিং করেছেন বিএফডিসিতে। তবে গত ১৫ বছরে তিনি সেখানে চলচ্চিত্রের কোনো কাজ করেননি। তাঁর ভাষ্য, ‘বিএফডিসিতে একবেলা শুটিং করতে যে ভাড়া লাগে, বাইরে তার চেয়ে অনেক কম টাকায় কাজ করা যায়। এখানে কাজ শেষ করে পুরো টাকা পরিশোধ করে বের হতে হয়। পরে পরিশোধ করার সুযোগ নেই।’

দেলোয়ার জাহান ঝন্টু বললেন, এফডিসিতে কেন শুটিং কমে গেছে, তা জানার জন্য প্রযোজক, পরিচালকদের এফডিসি কর্তৃপক্ষ কখনো ডাকেও না। এ বিষয়ে কোনো গরজই নেই।

প্রায় একই কথার প্রতিধ্বনি করলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ আক্তার। এই চিত্রনায়িকা বললেন, ‘এফডিসির ক্যামেরা গরম হয়ে যাচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এফডিসির ভেতরে শুটিং স্পট বলতে সেই ঝরনা স্পট, তাও আবার নষ্ট। বাগান বলতে কয়েকটা গাছ। এই ঝরনা স্পট বা বাগানে এই ২০২৩ সালে কেউ শুটিং করতে চাইবেন?’

চলচ্চিত্রশিল্প অ্যানালগ থেকে ডিজিটালে লাফ দিলেও দুইয়ের মধ্যখানে গ্যাপ বা ফারাকটা অনেক বেশি। এফডিসির সঙ্গে শিল্পী থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। অ্যানালগের স্বর্ণযুগের সময়টাকে ধরে এফডিসিকে চিন্তাভাবনায় আমূল পরিবর্তন এনে সবকিছুই ডিজিটাল ফরম্যাটে করতে হবে।
আলমগীর, নায়ক ও পরিচালক
এফডিসির সিঁড়ির এক অংশে এমন অবস্থা
ছবি: প্রথম আলো

অথচ এফডিসিতে নির্মিত ১৯৬৩ সালে জহির রায়হানের ‘কাচের দেয়াল’ পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে পাঁচটি শাখায় পুরস্কার পায়। এফডিসি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্টুডিও ছিল, তার প্রমাণ ১৯৬৫ সালে এফডিসি থেকে নির্মিত হয় পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সংগম’। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছিলেন জহির রায়হান।

১৯৯৩ সালে প্রকাশিত মির্জা তারেকুল কাদেরের গবেষণাগ্রন্থ ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প’-এ উল্লেখ করা হয়েছে, বিএফডিসিতে দেশের মোট চলচ্চিত্রের ইনডোর শুটিংয়ের ৮০ ভাগ, রঙিন প্রসেসিং ও প্রিন্টিংয়ের ১০০ ভাগ, রেকর্ডিংয়ের ৯০ ভাগ, ডাবিং ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের ৮০ ভাগ এবং এফেক্টস সাউন্ডের ১০০ ভাগ কাজ হতো। তবে এই সবই এখন অতীত।

অফিসের ভেতর কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

উত্তরণে নজর নেই কর্তৃপক্ষের

একাধিক পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএফডিসিতে কাজের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দিকে কর্তৃপক্ষ কখনো নজর দেয়নি। এফডিসির ভেতরে কমপ্লেক্স তৈরির জন্য ৩, ৪ ও ৫ নম্বর ফ্লোর ভেঙে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে পাঁচটি ফ্লোর আছে। একটি ফ্লোর শীততাপনিয়ন্ত্রিত; অন্য ফ্লোরের শীতাতপনিয়ন্ত্রণের যন্ত্রটি নষ্ট।

‘একটি সিনেমার গল্প’ চিত্রনায়ক আলমগীর পরিচালিত ষষ্ঠ চলচ্চিত্র। ২০১৮ সালে মুক্তি পায় এটি। নয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা পাওয়া আলমগীর এফডিসিতে তাঁর এই চলচ্চিত্রের কাজ করার অভিজ্ঞতায় বললেন, ‘কালার কারেকশন করতে কষ্ট হয়েছে। শতভাগ কাজ হয়নি। বড় স্ক্রিন থাকলে সময় কম লাগত। এফডিসি সাউন্ডের জন্য কিছু যন্ত্রপাতি এনেছিল, তা কোনো কাজেই লাগেনি। তাহলে তা কিনেছিল কেন?’

আলমগীর প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন ১৯৭২ সালের ২৪ জুন। ২০০০ সাল থেকে চলচ্চিত্রে কাজ কমিয়ে দিয়েছেন। এই চিত্রনায়ক বললেন, ‘এফডিসিতে কাজ করলে আমি কমফোর্ট ফিল করি। সারা জীবনের অভ্যাস। খরচের কথা ভাবিনি বলে আর ভালোবাসা থেকেই এফডিসিতে কাজ করেছি। কিন্তু বেশির ভাগ প্রযোজক-পরিচালকদের এফডিসিতে কাজের যে অনীহা, তার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। সেই কারণটা খুঁজে বের করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেশি খরচ করে কেন কাজ করতে হচ্ছে, তাও দেখতে হবে।’

বিএফডিসির আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ (সংশোধিত) প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় এক্সটার্নাল অডিট বা বাইরের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অডিট করা হয়নি। প্রকল্পের ক্রয় পরিকল্পনায় ক্রয়ের বরাদ্দ বাংলাদেশি টাকায় উল্লেখ করা হলেও চুক্তিমূল্য ইউরো, ইউএসডিতে দেখানো হয়েছে।

এফডিসিকে চলচ্চিত্রের তীর্থস্থান হিসেবে উল্লেখ করে নায়ক আলমগীর আরও বললেন, ‘২৩০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি। জীবনের ৭৪ বছরের মধ্যে ৫১ বছরই কেটেছে চলচ্চিত্রজগতে। চলচ্চিত্রশিল্প অ্যানালগ থেকে ডিজিটালে লাফ দিলেও দুইয়ের মাঝখানে গ্যাপ বা ফারাকটা অনেক বেশি। এফডিসির সঙ্গে শিল্পী থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। অ্যানালগের স্বর্ণযুগের সময়টাকে ধরে এফডিসিকে চিন্তাভাবনায় আমূল পরিবর্তন এনে সবকিছুই ডিজিটাল ফরম্যাটে করতে হবে।’

ডিজিটালে পিছিয়ে বিএফডিসি

অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল সিনেমার জগতে প্রবেশ করতে গিয়ে হোঁচট খায় এফডিসি। এরপর আর প্রতিষ্ঠানটি সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

২০১১ সালে এফডিসি সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নে ৫৯ কোটি ১৮ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। ২০১৪ সালে বিএফডিসিতে প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরা আসে। অথচ এর আগে ২০১২ সালে দেশে জাজ মাল্টিমিডিয়ার হাত ধরে ডিজিটাল চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হয়। ফলে এফডিসি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে।

রঙিন চলচ্চিত্র নির্মাণে ১৯৮৩ সালে এফডিসিতে ‘জহির রায়হান ল্যাবরেটরি’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। দিনের বেলাতেও ল্যাবের ভেতর স্তূপ করে রাখা যন্ত্রপাতিগুলো মুঠোফোনের আলো জ্বেলে দেখতে হলো। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা জানালেন, কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে, একই সঙ্গে স্মৃতিও হারিয়ে যাচ্ছে। একটি মেশিনের গায়ে স্কচটেপ দিয়ে আটকানো কাগজে লেখা-‘দিন যায় কথা থাকে’। এটি ১৯৭৯ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র।

এফডিসি নিয়ে কথা বলছেন নায়ক আলমগীর
ছবি: মানসুরা হোসাইন

লেখাটি কর্মীদের দীর্ঘশ্বাসেরই যেন প্রতিনিধিত্ব করছে। এফডিসিতে একটি জাদুঘর চালু করে অ্যানালগ আমলের যন্ত্রপাতিগুলো প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে তা আমলে নেওয়া হয়নি।

অন্যদিকে ডিজিটাল আমলের যন্ত্রপাতি কেনা বা অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়ম হওয়ার অভিযোগ আছে। যন্ত্রপাতি থাকলেও তা চালানোর জন্য দক্ষ জনবল নেই।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া হিসাবে, বিএফডিসিতে বর্তমানে মোট আটটি ক্যামেরা আছে। এর মধ্যে সনি এফ-৫৫ ক্যামেরা পাঁচটি। একটি নষ্ট। রেড ড্রাগন ক্যামেরা দুটির মধ্যে একটি নষ্ট। একটির মেরামতের কাজ চলছে। স্কারলেট ক্যামেরা একটি চালু আছে। এডিটিংয়ের জন্য ফ্রিল্যান্সার দিয়ে কাজ করতে হয়। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের জন্য ৫ দশমিক ১ সাউন্ড সিস্টেম সফটওয়্যার নষ্ট তিন বছরের বেশি সময় ধরে। প্রায় পাঁচ কোটি টাকার সাউন্ড মিক্সিংয়ের দুটি মেশিন নষ্ট।

মেরামত করার টাকা নেই। প্রায় এক কোটি টাকার দুটি জিমিজিব ক্রেন (৪০ ফুট) থাকলেও তা চালানোর জন্য দক্ষ জনবল নেই। কেউ কাজ করতে চাইলে বাইরে থেকে লোক ভাড়া করে আনতে হয়।

ডিসিপি মেশিন নষ্ট। কৃষ্টি প্রজেক্টর মেশিন কোনো কাজেই লাগেনি। ভিজ্যুয়াল এফেক্টের কাজের সুবিধা নেই। সিনেমাস্কোপ ক্যামেরা না থাকলেও এর লেন্স কেনা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আরও জানান, ডিসিপি (ডিজিটাল সিনেমা প্যাকেজ) মেশিন নষ্ট। কৃষ্টি প্রজেক্টর মেশিন কোনো কাজেই লাগেনি। ভিজ্যুয়াল এফেক্টের কাজের সুবিধা নেই। সিনেমাস্কোপ ক্যামেরা না থাকলেও এর লেন্স কেনা হয়েছে। সাবটাইটেল মেশিন মাত্র তিনটি চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়েছিল।

কোটি টাকার ডিটিএস মেশিন সচল হয়নি কখনো। কোটি টাকা টেলিসিনে মেশিন কেনা হলেও রিভার্স টেলিসিনে মেশিন কেনা হয়নি। ডিজিটাল এডিটিং মেশিন অচল হয়ে আছে। ডিজিটাল তথ্য সংরক্ষণের জন্য সেন্ট্রাল স্টোরেজ কাজে লাগানো হয়নি। নাজির আহমদ সাউন্ড কমপ্লেক্সে তিনটি ডাবিং থিয়েটারের মধ্যে একটি কাজ করে।

অত্যাধুনিক ডলবি সাউন্ড সিস্টেম, মান্না ডিজিটাল সাউন্ড কমপ্লেক্স কোনো কাজেই লাগেনি। বিএফডিসিতে আজ পর্যন্ত আইটি ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

বহুদিন ব্যবহার নেই। পোকায় কেটেছে খাতা
ছবি: প্রথম আলো

দুর্নীতির অভিযোগ, মামলা

এফডিসির আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ (সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পটি শুরু হয় ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে সময় বাড়িয়ে শেষ হয় ২০১৭ সালের জুন মাসে। প্রকল্পটি নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় এক্সটার্নাল অডিট বা বাইরের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অডিট করা হয়নি। প্রকল্পের ক্রয় পরিকল্পনায় ক্রয়ের বরাদ্দ বাংলাদেশি টাকায় উল্লেখ করা হলেও চুক্তিমূল্য ইউরো, ইউএসডিতে দেখানো হয়েছে।

যন্ত্রপাতি কেনাবাবদ উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারের ৩ কোটি ৪৬ লাখ ৫৮ হাজার ৫২০ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে—এমন অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক হামিদুল হাসান ২০১৫ সালে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় তখনকার এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ তিনজনকে আসামি করে মামলা করেন।

চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিএফডিসির বেহাল অবস্থা এক দিনে হয়নি। ডিজিটাল যন্ত্রপাতিতে পিছিয়ে যাওয়া, বিএফডিসির যেটুকু যা আছে, তা কাজে লাগাতে না পারা, মামলা, দুর্নীতি, প্রযোজক ও সমিতিগুলোর কাছ থেকে বকেয়া আদায় করতে না পারাসহ নানা সমস্যায় প্রতিষ্ঠানটির আজ এমন দশা। কাজ নেই বলে কর্মীরা টেবিল-চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছেন। চারপাশে ভুতুড়ে পরিবেশ।

২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে এই মামলায় যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মালয়েশিয়ার মেসার্স নভেলকোর (এম) কর্মকর্তা জন নোয়েল, স্থানীয় বিক্রয় প্রতিনিধি খন্দকার শহীদুল ইসলাম, প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলামকে বিভিন্ন মেয়াদের বিনাশ্রম কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড, জরিমানা করা হয়। মিথ্যা তথ্য দিয়ে চুক্তিবহির্ভূতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে চীনের তৈরি মালামাল গ্রহণ ও মূল্য পরিশোধ করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ ছিল আসামিদের বিরুদ্ধে।

দুদকের উপপরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী মামলাটি তদন্ত করে ২০১৭ সালের ২ মার্চ পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে অব্যাহতি দিয়ে অপর তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলা প্রসঙ্গে কোনো কথা বলতে চাননি। প্রথম আলোকে শুধু এটুকু বলেন, মামলাটি তাঁর কাছে একটি ‘দুঃস্বপ্নের’ মতো।

এফডিসি কর্তৃপক্ষ ২০০৬ সালে ৪ কোটি টাকার ডিজিটাল সাউন্ড টারবো সিস্টেম (ডিটিএস) কেনার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে। সে অনুযায়ী, ২০০৭ সালের ৪ এপ্রিল ফেইথ ইন্টারন্যাশনাল নামের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি নতুন ডিটিএস যন্ত্রপাতির পরিবর্তে পুরোনো যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে পুরো অর্থ তুলে নেয়। এমন অভিযোগ পাওয়ার পর অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুদক।

এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে এমন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া সব সময় জরুরি ছিল, যিনি চলচ্চিত্রশিল্পের বিভিন্ন দিক বুঝবেন এবং দলীয় রাজনীতি কিংবা দুর্নীতিমুক্ত থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে যাঁরা এখানে নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁরা অনেকে এমনকি এফডিসি পরিচালনার পদটিকে ‘শাস্তি’ হিসেবে দেখেছেন। রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সততার সঙ্গে এফডিসির তথা চলচ্চিত্রের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ভূমিকা নেননি।
গীতি আরা নাসরীন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এফডিসিতে কাঁচা ফিল্ম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ফিল্ম ট্রাস্টের কর্মচারী উজ্জ্বল চক্রবর্তী ফেইথ ইন্টারন্যাশনালের অংশীদার হিসেবে নেপথ্যে থেকে এই অর্থ হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। সে সময় বিএফডিসি কর্তৃপক্ষ এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার পর বিএফডিসি কর্তৃপক্ষ বিষয়টির অধিকতর তদন্তের জন্য দুদকের কাছে তাদের অভিযোগ পাঠায়। দুদকের অনুসন্ধানেও এসব দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়।

বর্তমানে এফডিসি-সংক্রান্ত ৩৭টি মামলা বিচারাধীন বলে জানা গেছে। ২০১১-১২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে অনুযায়ী, ওই সময় মোট মামলা ছিল ৬৩টি। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলা ছিল ১৮টি। বর্তমানে দুদকের কয়টি মামলা চলমান, তা দুদক ও বিএফডিসি, কেউই আলাদা করে তথ্য দিতে পারেনি।

কত বছর থেকে এসব রাসায়নিক স্তূপাকারে রাখা হয়েছে, কর্মীদের তা মনে নেই
ছবি: প্রথম আলো

পড়ে আছে এফডিসির সম্পত্তি

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে এফডিসির প্রধান কার্যালয়ে জায়গা আছে ৭ দশমিক ৬৩২৪ একর। মূল কার্যালয়ের জমিটিই বেহাল হতে বসেছিল। এ-সংক্রান্ত মামলার রায় ফিডেল গোমেজ অ্যান্ড কোং-এর পক্ষে যাওয়ার দায় এড়াতে বিএফডিসি কর্তৃপক্ষ তিনজনকে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্তও করেছিল।

বিএফডিসির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সই করা ওই আদেশের প্রতিবাদে এফডিসি কর্মচারী কলাকুশলী পরিষদ বিক্ষোভ করে। ২০১২ সালে এফডিসির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ম. হামিদ হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেন। ১৯৯২ সালে শুরু হওয়া মামলাটি এখনো চলমান।

১৯৮০ সালের ১ জুলাই গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ১০৫ একর জায়গায় বঙ্গবন্ধু ফিল্ম সিটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ১৯৮৪ সালের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। বর্তমানে প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে। গত ১৮ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৩৮০ কোটি টাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফিল্ম সিটির (দ্বিতীয় পর্যায়) অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

চলচ্চিত্রের চেয়ে অন্যান্য বিষয়ের পোস্টারই বেশি
ছবি: প্রথম আলো

বকেয়া আদায় হচ্ছে না

এফডিসির দেওয়া তথ্য বলছে, অ্যানালগ পদ্ধতিতে চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় প্রযোজকেরা বিএফডিসি থেকে নেগেটিভ সংগ্রহ করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। সিনেমা মুক্তির পর বকেয়া পরিশোধ করেননি। বকেয়া পরিশোধে তাগাদা দিতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল, সেই ঠিকানা থেকে চিঠি ফেরত আসছে। বকেয়া পরিশোধ করেননি—এমন প্রযোজকদের মধ্যে কেউ কেউ মারাও গেছেন। ১৯৮০ সাল থেকে ৩৯৮ জন প্রযোজকের কাছে প্রযুক্তিগত সহায়তা, ফ্লোর ভাড়াসহ নানা খাতে বকেয়া রয়েছে ২০ কোটি টাকার বেশি। বিএফডিসির ২০১১-১২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রযোজকদের কাছে বকেয়ার পরিমাণ সুদসহ ২৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।

সরকারি প্রতিষ্ঠানটির ভেতরে সংরক্ষিত এলাকায় (কেপিআই) প্রযোজক-পরিচালক-শিল্পী সমিতিসহ মোট সাতটি সংগঠনের কার্যালয় রয়েছে। এফডিসির স্টাডি রুমগুলো কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যান্য পেশাজীবী সমিতির অফিসও আছে এখানে। সমিতিগুলোর কাছে কার্যালয়ের ভাড়া ও বৈদ্যুতিক বিল বাবদ বিএফডিসির পাওনা প্রায় সাত কোটি টাকা।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ বললেন, ‘১৯৮৪ সাল থেকে যে বিল জমেছে, তা দিতে বলছে এফডিসি। এটা তো কোনো গ্রহণযোগ্য কথা হলো না।’ তিনি বলেন, ‘শিল্পী, কলাকুশলীরা এফডিসিতে এসে যে একটু বসবেন, সে ব্যবস্থাও নেই। সমিতিগুলোর কার্যালয়ই ভরসা।’

সমিতিগুলো জায়গা দখল করে থাকলেও চলচ্চিত্র বা বিএফডিসির উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখছে না, কর্তৃপক্ষের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালক কাজী হায়াৎ বলেন, এফডিসির ভেতরে সমিতিগুলোর কার্যালয় আছে বলেই চলচ্চিত্রের কিছু মানুষ এখানে এখনো আনাগোনা করেন।

২০১১-১২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তখন মোট মামলা ছিল ৬৩টি। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলা ছিল ১৮টি। বর্তমানে দুদকের কয়টি মামলা চলমান, তা দুদক ও এফডিসি কেউই আলাদা করে তথ্য দিতে পারেনি।

২০১৮ সাল থেকে বলা হচ্ছে, এফডিসিকে সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণ করতে চায় সরকার। প্রায় ৩২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হওয়ার কথা বিএফডিসি কমপ্লেক্স। ২০২১ সালের মধ্যে কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পরে ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

বিএফডিসির পুরোনো মূল গেটের কাছে ৪ দশমিক ৭০ বিঘা জমিতে তিনতলা বেসমেন্টসহ ১২ তলা ভবনটিতে ৫টি সিনেপ্লেক্স, ৫টি শুটিং ফ্লোর, ২৪ কক্ষের হোটেল, মার্কেট, ২টি সুইমিং পুল, রেস্টুরেন্ট, বঙ্গবন্ধু কর্নার, অটিজম কর্নার, ৩০০ গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা ইত্যাদি থাকবে। বিএফডিসি নিজস্ব আয়ে চলার জন্য এ কমপ্লেক্সের দিকে তাকিয়ে আছে।

গত ৩ এপ্রিল জাতীয় চলচ্চিত্র দিবসের অনুষ্ঠানে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানান, বিএফডিসি কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। কমপ্লেক্সটিতে শিল্পীরা ঢুকে সিনেমা বানিয়ে প্রদর্শনী করে বের হতে পারবেন।

তবে বিএফডিসি কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের জুন মাসে শেষ হবে না। আরও সময় লাগবে।

নিপুণ আক্তার
ছবি: সংগৃহীত

২০১৫ সালে বরাদ্দকৃত ১৯ কোটি ৮০ লাখ টাকায় প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, চলচ্চিত্রের উন্নয়নে এই সিটি এখন পর্যন্ত ভূমিকা না রাখতে পারলেও এখানে বিভিন্ন সমিতিসহ অন্যরা বনভোজনে যাচ্ছেন।

এফডিসি কর্তৃপক্ষ এখনো আশাবাদী, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশে মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মিত হবে। চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শকদের সিনেমা হলে যাওয়ার আগ্রহ বাড়বে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।

১৯৮৯ সালে মিরপুরের ভাষানটেকে এক একর জমি গণপূর্ত বিভাগ থেকে কেনা হয়েছিল। এফডিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন সুবিধার জন্য এই জায়গায় এখন পর্যন্ত কিছু করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।

চট্টগ্রামের এফডিসির বর্ধিত শুটিং ইউনিট তৈরির জন্য বিটিভি চট্টগ্রাম থেকে পাওয়া ১ দশমিক ৩৫১০ একর জমি থাকলেও তা কাজে লাগানো হয়নি।

তবে এফডিসির আয়ের উৎস বাড়াতে জমিগুলো কাজে লাগানোর কথা ভাবা হচ্ছে বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুজহাত ইয়াসমীন।

কৃষ্টি ডিজিটাল প্রোজেক্টরের ব্যবহার হয়নি
ছবি: মানসুরা হোসাইন

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণাভিত্তিক ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প: সংকটে জনসংস্কৃতি’ বইয়ের সহলেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন মনে করেন এফডিসি যে লক্ষ্যে স্থাপিত হয়েছিল, তা অর্জনের পথ থেকে সরে যাওয়ার বড় কারণ সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাব।

তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে এমন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া সব সময় জরুরি ছিল, যিনি চলচ্চিত্রশিল্পের বিভিন্ন দিক বুঝবেন এবং দলীয় রাজনীতি কিংবা দুর্নীতিমুক্ত থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে যাঁরা এখানে নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁরা অনেকে এমনকি এফডিসি পরিচালনার পদটিকে ‘শাস্তি’ হিসেবে দেখেছেন। রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সততার সঙ্গে এফডিসির তথা চলচ্চিত্রের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ভূমিকা নেননি।

আরও পড়ুন