প্রথমে ব্যর্থ, পরে ‘কৌশলে’ ইজারা

বন বিভাগের অভিযোগ, তাদের না জানিয়ে কেওড়াবনের পাঁচ একর ভূমি কোহিনূর স্টিল নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।

  • নতুন করে বনের জায়গা ইজারা দেওয়ায় ৮ সেপ্টেম্বর সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আইনি নোটিশ দিয়েছে বেলা।

  • কাগজপত্রে উত্তর সলিমপুর লেখা হলেও বেশির ভাগ জায়গা পড়েছে তুলাতলী মৌজায়। তুলাতলী জাহাজভাঙা কারখানার ঘোষিত অঞ্চল নয়।

বন বিভাগের জমি জাহাজভাঙা শিল্প এলাকার জন্য ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। সম্প্রতি সীতাকুণ্ডের তুলাতুলী এলাকায়
ছবি: জুয়েল শীল

তিন বছর আগে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে উপকূলীয় বনভূমিতে জাহাজভাঙা কারখানা করতে ব্যর্থ হয় বিবিসি স্টিল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে তখন তুলাতলী এলাকার ৭ দশমিক ১০ একর বনভূমি ইজারা পেলেও উচ্চ আদালত বাতিল করেন।

কিন্তু দুই বছর পরে এসে দ্বিতীয়বার একই মালিকের অন্য প্রতিষ্ঠানের নামে পাঁচ একর বনভূমি ইজারা দেয় প্রশাসন। অভিযোগ রয়েছে, দ্বিতীয়বারের ইজারা নেওয়া হয় ভিন্ন মৌজা দেখিয়ে।

প্রথমবার ইজারা বাতিল হওয়া বিবিসি স্টিলের স্বত্বাধিকারীর নাম আবুল কাশেম। তিনি রাজা কাশেম নামেই পরিচিত। দ্বিতীয়বার ইজারা পাওয়া প্রতিষ্ঠানটির নাম কোহিনূর স্টিল, যেটির মালিক কাশেমের স্ত্রী কোহিনূর আকতার। চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি কোহিনূর স্টিলের নামে সীতাকুণ্ডের উত্তর সলিমপুর মৌজা দেখিয়ে পাঁচ একর বনভূমি ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন।

নতুন করে বনের জায়গা ইজারা দেওয়ায় ৮ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসন, বন বিভাগ, কোহিনূর স্টিলসহ বিভিন্ন পক্ষকে আইনি নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।

ইজারা দেওয়া জায়গা বেশির ভাগ তুলাতলী মৌজার। মূলত বনের জায়গা এটি। পুনরায় বনের জায়গা ইজারা দেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে মাসখানেক আগে জেলা প্রশাসন বরাবর একাধিক চিঠি দিয়েছে বন বিভাগ।
মোহাম্মদ আবদুর রহমান, চট্টগ্রামের উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও)

বন বিভাগের অভিযোগ, কাগজপত্রে উত্তর সলিমপুর লেখা হলেও বেশির ভাগ জায়গা পড়েছে তুলাতলী মৌজায়। তুলাতলী জাহাজভাঙা কারখানার ঘোষিত অঞ্চল নয়। এ কারণে ‘কৌশলে’ পুরোটাই উত্তর সলিমপুর মৌজা দেখিয়ে বন বিভাগের কেওড়াবনের পাঁচ একর ভূমি ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।

উত্তর সলিমপুর ও তুলাতলী মৌজায় উপকূলীয় বন বিভাগের ১৫০ একর বনায়ন রয়েছে। ইতিমধ্যে বন বিভাগ কোহিনূর স্টিলকে দুটি নোটিশ দিয়ে বনের জায়গা থেকে সরে যাওয়ার জন্য বলেছে। চূড়ান্ত নোটিশ দিয়ে উচ্ছেদপ্রক্রিয়ায় যাবে তারা।

আরও পড়ুন

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ইজারা দেওয়া জায়গা বেশির ভাগ তুলাতলী মৌজার। মূলত বনের জায়গা এটি। পুনরায় বনের জায়গা ইজারা দেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে মাসখানেক আগে জেলা প্রশাসন বরাবর একাধিক চিঠি দিয়েছে বন বিভাগ।

কিন্তু একটি চিঠির জবাবও তারা দেয়নি। আদালতের রায়ের আদেশ উল্লেখ করে ইজারা বাতিলের জন্য সর্বশেষ আরও আরেকটি চিঠি দেওয়া হয়। এই চিঠির উত্তরও দেওয়া হয়নি। অথচ জেলা প্রশাসনকে ওই বনভূমি রক্ষার আদেশ দিয়েছিলেন আদালত।

এখন মনে পড়ছে না। এটা ফাইল দেখে বলতে হবে।
মোহাম্মদ মমিনুর রহমান, কোহিনূর স্টিলের ইজারা বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক

কোহিনূর স্টিলকে দেওয়া একসনা ইজারার চুক্তিনামায় জেলা প্রশাসকের পক্ষে সই করেন সীতাকুণ্ডের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহদাত হোসেন ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলম। দ্বিতীয় পক্ষে ছিলেন কোহিনূর আকতার।

এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি সহকারী কমিশনার মো. আশরাফুল আলম। জানতে চাইলে ইউএনও শাহদাত হোসেন বলেন, ‘হাইকোর্ট যে জায়গাটির ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছে, কোহিনূরকে তা দেওয়া হয়নি। বিবিসি স্টিলের সেই সাত একর আমরা সংরক্ষণ করেছি। ওটা সংরক্ষণ করে এর বাইরে পাঁচ একর জমি ইজারা দেওয়া হয়েছে। এখন তারা পাঁচ একরের বাইরে নতুন করে গাছপালাসহ দখল করেছে কি না, সেটা দেখতে হবে। জায়গাটি তুলাতলী নাকি উত্তর সলিমপুর মৌজা, ঠিক মনে নেই।’

কোহিনূর স্টিলের ইজারা বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এখন মনে পড়ছে না। এটা ফাইল দেখে বলতে হবে।

‘আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে একই জায়গা আবার ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। অথচ আগের মামলার রায়ে আদালত বন ধ্বংসকারী এ ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। জাহাজভাঙা কারখানার যাবতীয় কার্যক্রম সরিয়ে নিতে বলেছিলেন। এই ইজারা আদালত অবমাননার শামিল। এ নিয়ে আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করেছি আমরা।’
হাসানুল বান্না, আইনজীবী

সরেজমিনে দেখা যায়, ফৌজদারহাট টোল সড়কের গোলচত্বর থেকে গ্রামীণ সড়ক ধরে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর দিকে গেলে ফৌজদারহাট ঘাট। এ ঘাটের উত্তর পাশেই তুলাতলী মৌজার বনাঞ্চল। সেখানে বনাঞ্চল কাঁটাতার দিয়ে ঘেরাও দিয়ে কোহিনূর স্টিল ওই এলাকায় কারখানা স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। গাছপালা কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। ঘেরাওয়ের ভেতরও অনেক গাছপালা রয়েছে। জাহাজভাঙা কারখানার জন্য সংরক্ষিত এলাকা নামে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের লোকজন সার্বক্ষণিক পাহারায় রয়েছেন সেখানে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল কাশেমের দাবি, ‘হাইকোর্টের আদেশের বিষয়ে বিবিসি স্টিল উচ্চ আদালতে আপিল করেছে। কোহিনূর স্টিলের বিষয়েও বন ছাড়পত্র দিয়েছে। জেলা প্রশাসন অনুমোদন দিয়েছে। ওই জায়গাটিতে তুলাতলী মৌজায় পড়েনি। মেপে দেখতে পারেন। ওখানে আমি কিছু গাছ লাগিয়েছি। এখন ঘেরাও দিয়ে রেখেছি।’

নথিপত্র থেকে জানা গেছে, বিবিসি স্টিলের ইজারা বাতিল হওয়ার পর ২০২০ সালেই নতুন করে ১০ একর ভূমির জন্য আবেদন করা হয় কোহিনূর স্টিলের নামে। তখন সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন রায় ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম এ নতুন আবেদনের ওপর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নেতিবাচক মতামত দেন।

তাঁরা ওই এলাকাটি বনের জন্য নোটিফিকেশনকৃত উল্লেখ করে হাইকোর্টের রায়ে তা সংরক্ষণের আদেশ দেওয়ার বিষয়টি মনে করিয়ে দেন। পরে এই দুজন সীতাকুণ্ড থেকে বদলি হয়ে যান। এ ছাড়া আবেদনের পর একই সময়ে এ বিষয়ে বন বিভাগের কাছে ইজারার বিষয়ে কোনো আপত্তি ছিল কি না, জেলা প্রশাসন থেকে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু তখন বন বিভাগ থেকে আপত্তি বা অনাপত্তি কোনোটাই জানানো হয়নি। তখন ডিএফও ছিলেন এস এম গোলাম মওলা।

এ বিষয়ে বর্তমান ডিএফও আবদুর রহমান বলেন, তখন কেন জেলা প্রশাসনের চিঠির জবাব দেওয়া হয়নি, তা বোধগম্য নয়। তবে আগেরবার বিবিসি স্টিলের ক্ষেত্রে আপত্তি দেওয়া হয়েছিল।

জানা গেছে, প্রথমবার ২০১৯ সালে উত্তর সলিমপুরের পাশের তুলাতলী মৌজার ৭ দশমিক ১০ একর জমি বিবিসি স্টিলকে ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। তখন বন বিভাগ তাতে আপত্তি দেয়। প্রথমবারের ইজারা বাতিলের জন্য ২০১৯ সালের শুরুর দিকে বেলা জনস্বার্থে উচ্চ আদালতে মামলা করেছিল।

২০২০ সালের ২ জানুয়ারি ওই মামলার রায়ে, ইজারা কার্যক্রমকে আইনি কর্তৃত্ববিহীন ও আইনগতভাবে ভিত্তিহীন ঘোষণা করা হয়। একই আদেশে বনভূমি রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তা না করে আবার ইজারা দেওয়া হয়েছে।

নতুন করে ইজারা ও আইনি নোটিশ দেওয়া প্রসঙ্গে বেলার আইনজীবী হাসানুল বান্না প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে একই জায়গা আবার ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। অথচ আগের মামলার রায়ে আদালত বন ধ্বংসকারী এ ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। জাহাজভাঙা কারখানার যাবতীয় কার্যক্রম সরিয়ে নিতে বলেছিলেন। এই ইজারা আদালত অবমাননার শামিল। এ নিয়ে আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করেছি আমরা।’