বড় জাহাজের শেষ গন্তব্য সীতাকুণ্ড

গত বছর বিশ্বে বিশালাকার জাহাজ ভাঙা হয়েছে ২০টি। এর মধ্যে ১৪টিরই বা ৭০ শতাংশেরই গন্তব্য ছিল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন ইয়ার্ড।

বিশ্বের ২২টি দেশে পুরোনো জাহাজ ভাঙা হয়। এসব দেশের মধ্যে কয়েক বছর ধরে শীর্ষ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। দুই বছর ধরে বিশালাকার জাহাজ ভাঙার ক্ষেত্রে সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা কারখানাগুলো।

গত সপ্তাহে বেলজিয়ামভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম ২০২১ সালে বিশ্বে জাহাজভাঙার সর্বশেষ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, গত বছর বিশ্বে বিশালাকার জাহাজ ভাঙা হয়েছে ২০টি। এর মধ্যে ১৪টিরই বা ৭০ শতাংশেরই গন্তব্য ছিল সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন ইয়ার্ড। আর বাকি ছয়টি বিশালাকার জাহাজ ভাঙা হয়েছে ভারত,পাকিস্তান ও তুরস্কে। কয়েক বছর আগেও বড় জাহাজ ভাঙার দেশের তালিকায় শীর্ষে ছিল পাকিস্তান ও তুরস্ক। ২০১৮ সালে বড় জাহাজ ভাঙায় পাকিস্তান ছিল শীর্ষে। আর ২০১৯ সালে তুরস্ক শীর্ষে উঠে আসে। এরপর ২০২০ সাল থেকে টানা দুই বছর বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে।

পুরোনো জাহাজ বেচাকেনা হয় জাহাজে থাকা লোহার ওজনের ভিত্তিতে। কোনো জাহাজে ৪০ হাজার টনের বেশি লোহা পাওয়া গেলে সেই জাহাজকে বড় জাহাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসব জাহাজ একেকটি ৩৩০ মিটারের বেশি লম্বা। জ্বালানি ও আকরিক পরিবহনকারী অতিকায় বড় এসব জাহাজ এবং ভাসমান টার্মিনাল ভেঙে ৪০ হাজার টনের বেশি লোহা পাওয়া যায়।

শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বিশ্বে মোট ৭৬৩টি জাহাজ ভাঙা হয়। এসব জাহাজ ভেঙে পাওয়া গেছে প্রায় ৬১ লাখ টন লোহা। এর মধ্যে বাংলাদেশে ২৫৪টি জাহাজ ভেঙে পাওয়া যায় ২৬ লাখ ৩০ হাজার টন লোহা।

বাংলাদেশে বড় জাহাজ আমদানিতে শীর্ষে রয়েছেন ইস্পাত কারখানার উদ্যোক্তারা। ইস্পাত কারখানায় রড তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় জাহাজ ভেঙে পাওয়া পুরোনো লোহার টুকরা। সরাসরি পুরোনো লোহার টুকরা আমদানির পাশাপাশি জাহাজ ভাঙা থেকে পাওয়া লোহার টুকরা দিয়ে কাঁচামালের চাহিদা পূরণ করেন ইস্পাত খাতের উদ্যোক্তারা। যাঁদের ইস্পাত কারখানা নেই, তাঁরা জাহাজ ভেঙে যা পান, তার সবই বিক্রি করে দেন।

গত বছর মোস্তফা হাকিম গ্রুপ প্রায় ৯০০ কোটি টাকা খরচ করে ৪টি বড় জাহাজ আমদানি করেছে। এই ৪টি জাহাজ ভেঙে লোহা পাওয়া যায় ১ লাখ ৮১ হাজার টন। প্রতিষ্ঠানটির গোল্ডেন ইস্পাত ও এইচএম স্টিল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি নামে দুটি ইস্পাত কারখানা রয়েছে। এ ছাড়া কেএসআরএম গ্রুপ গত বছর ছয়টি বড় জাহাজ ভেঙেছে। ইস্পাত খাতের পণ্য রড নির্মাণে বাজারে শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে কেএসআরএম গ্রুপের। রড নির্মাণকারী অন্য কারখানাগুলো সরাসরি পুরোনো লোহার টুকরা আমদানি করে চাহিদা মেটায়। এ ছাড়া জাহাজভাঙা ইয়ার্ড থেকেও কাঁচামাল সংগ্রহ করেন তাঁরা।

জানতে চাইলে মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ সরোয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর ইস্পাতের কাঁচামাল পুরোনো লোহার টুকরা সংগ্রহ করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। এ কারণে বেশি কাঁচামালের জোগান নিশ্চিত করতে বড় জাহাজ আমদানি করেছি। বড় জাহাজ ভাঙায় দক্ষতা তৈরি হয়েছে এ দেশের জাহাজভাঙা উদ্যোক্তাদের।’

পুরোনো-নতুন জাহাজ বেচাকেনার তথ্যসেবা প্রদানকারী গ্রিসভিত্তিক সংস্থা ইন্টারমোডাল শিপব্রোকার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের শুরুর দিকে পুরোনো জাহাজের টনপ্রতি লোহার দাম ছিল ৪৫০ থেকে ৪৭০ মার্কিন ডলার। তাতে একেকটি বিশালাকার পুরোনো জাহাজ আমদানিতে ব্যয় হয়েছে কমবেশি ১৭০ কোটি টাকা। বছরের শেষ দিকে পুরোনো জাহাজের লোহার দাম বেড়ে প্রতি টন ৬০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। তাতে বড় জাহাজের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ২০০ কোটি টাকার বেশি।

উদ্যোক্তারা জানান, বড় আকারের পুরোনো জাহাজের লোহার প্লেট বেশ উন্নত মানের। বাজারে ভালো মানের প্লেটের চাহিদা বেশি। আধা স্বয়ংক্রিয় ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে ছোট জাহাজ নির্মাণেও এই মানের প্লেট বেশি ব্যবহৃত হয়। আবার বড় জাহাজ থেকে পুরোনো লোহার টুকরা বেশি পাওয়া যায়। আবার বড় জাহাজে বর্জ্য পদার্থও কম থাকে। এ জন্য বড় উদ্যোক্তারা বড় জাহাজ আমদানিতে বেশি ঝুঁকছেন।

তবে বড় জাহাজ আমদানিতে মুনাফা ও ঝুঁকি—দুটোই বেশি। একেকটি বড় জাহাজ কাটতে ৬ থেকে ৯ মাস সময় লাগে। এ সময়ে দাম পড়ে যেমন লোকসানের ঝুঁকি থাকে, তেমনি দাম বেড়ে গেলে মুনাফারও সম্ভাবনা থাকে। ভারতের জাহাজভাঙা কারখানাগুলো ছোট জাহাজ বেশি আমদানি করে, যাতে দ্রুত বিক্রি করে বাজার থেকে বেরিয়ে যাওয়া যায়। আবার দেশটিতে মাঝারি উদ্যোক্তার সংখ্যা বেশি। দেশটি ইস্পাত পণ্য উৎপাদনে জাহাজ ভাঙার ওপর নির্ভরশীল নয়।

বাংলাদেশে মৌলিক কাঁচামাল আকরিক ব্যবহার করে ইস্পাত পণ্য উৎপাদিত হয় না। ফলে প্রাথমিক কাঁচামাল পুরোনো লোহার টুকরা ব্যবহার করে ইস্পাত পণ্য, বিশেষ করে রড উৎপাদিত হয়। সরাসরি আমদানি ও জাহাজ ভাঙা থেকে পুরোনো লোহা সংগ্রহ করে রড উৎপাদন করেন উদ্যোক্তারা। রড কারখানার কাঁচামালের দ্বিতীয় উৎস হিসেবে প্রতিবছর আমদানি বাড়ছে। সেই তালিকায় বছর দু-এক ধরে যোগ হয়েছে অতিকায় বড় জাহাজ।