ছোট মেয়ের জানাজায় অংশ নিতে পারেননি বেলাল হোসেন, বড় মেয়েকেও দেখতে পেলেন না

গভীর রাতে বাইরে থেকে তালাবন্ধ ঘরে আগুনে দুই সন্তানকে হারিয়েছেন বেলাল হোসেনছবি: সংগৃহীত

বেলাল হোসেনের তিন মেয়ের মধ্যে সাত বছর বয়সী ছোট মেয়ে আয়েশা আক্তার ঘরে দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা যায়। সেই মেয়ের চেহারা দেখতে পারেননি, জানাজাতেও অংশ নিতে পারেননি তিনি। ওই আগুনে দগ্ধ বড় মেয়ে সালমা আক্তারকেও (১৮) বাঁচানো গেল না। ছয় দিন রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন থেকে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুর থেকে বেলাল এখনো এ মেয়েকেও দেখতে আসতে পারেননি।

বুধবার বিকেলে বেলাল মোবাইলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘরে আগুন লাগার পর তিন মেয়ে চিক্কুর দিয়ে আব্বু আব্বু ডাকছে। বলছে, “আব্বু বাঁচাও।” বলি, বাইর হও। তখন মেয়েরা বলে, “দরজা খুলে না।” আমার ঘরের দরজাও খুলে না। তখন টিনের বেড়া ভাঙা শুরু করি। বউ আর দুই ছেলেরে ঠ্যাং ধইরা ছেচড়াইয়্যা বাইর করি। বড় দুই মেয়েরেও বাইর করতে পারি। ছোট মেয়েটারে বাঁচাইতে পারি নাই। কেমনে কে বা কারা মেয়েটারে কবর দিছেন, তা–ও জানি না।’

বেলাল হোসেন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চরমনসা গ্রামের সূতারগোপ্তা এলাকার বাসিন্দা। তিনি ওই ইউনিয়নের বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক। ১৯ ডিসেম্বর গভীর রাতে তাঁর বাড়িতে আগুন লাগার পর থেকে তিনি দাবি করছেন, ঘরের দরজায় কেউ বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে ও পেট্রল ঢেলে নাশকতার জন্যই আগুন দিয়েছে।

আগুনের ঘটনার সময় পাকা ভিটির লম্বাটে বড় চৌচালা টিনের পাশাপাশি তিনটি কক্ষে বেলাল হোসেন, তাঁর স্ত্রী নাজমা বেগম, তিন মেয়ে ও দুই ছেলে ঘুমাচ্ছিলেন। বেলাল স্ত্রী, চার বছর বয়সী ছেলে নাজমুল ইসলাম, চার মাস বয়সী নজরুল ইসলাম, বড় মেয়ে সালমা আক্তার এবং মেজ মেয়ে সামিয়া আক্তারকে ঘরের টিনের বেড়া উঁচু করে কোনো রকমে বের করতে পেরেছিলেন।

সূতারগোপ্তা বাজারের সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী বেলাল হোসেন ঘটনার পর থেকে সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বুধবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।
বিকেলে বেলাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ ছোট মেয়েটার কবর দেখলাম। কাল (বৃহস্পতিবার) ঢাকায় বড় মেয়েটারে দেখতে যাব। চোখ খুইল্যা বাপরে দেখলে মেয়েটা একটু শান্তি পাব।’

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চরমনসা গ্রামে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ ঘরে আগুনের ঘটনায় দগ্ধ সালমা আক্তার বুধবার দিবাগত রাতে রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন
ছবি: সংগৃহীত

তবে বেলাল সেই সুযোগ আর পেলেন না। তাঁর বড় মেয়ে সালমা বুধবার দিবাগত রাত সোয়া একটার দিকে মারা গেছেন বলে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ল্যাভেন্ডার ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ রবিউল করিম খান জানিয়েছেন।

বুধবার সকালে এ হাসপাতালে গেলে আইসিইউ থেকে সালমাকে দেখে বের হয়ে অধ্যাপক রবিউল করিম প্রথম আলোকে জানান, সালমার শ্বাসনালিসহ শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে গেছে। দ্রুত শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে। শরীরে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে দগ্ধ হয়নি। তবে শারীরিক এমন অবস্থার মধ্যেও পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন সালমা।

৫ ডিসেম্বর মুঠোফোনের মাধ্যমে বিদেশে থাকা পাত্রের সঙ্গে সালমার বিয়ে হয়েছিল। বেলাল হোসেন জানান, অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা দেওয়া মেজ মেয়েকেও জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আত্মীয়রা নিয়ে যান, তবে তাকে ভর্তি করতে হয়নি। তার শরীরের ২ শতাংশ পুড়েছিল। ছোট মেয়ে আয়েশার দ্বিতীয় শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছিল ঘটনার আগের দিন।

আরও পড়ুন

জবাব চান বেলাল

বেলাল ঘটনার রাতের কথা উল্লেখ করে বলেন, এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যেই ঘরের ভেতরে আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। ছোট মেয়ের আব্বু আব্বু বলে চিৎকারও একটু সময় পরেই থেমে যায়। বেলাল হোসেন বলেন, ‘তখনই মনে মনে ছোট মেয়েকে আল্লাহর কাছে হাওলা করে দিছি।’

২২ ডিসেম্বর সোমবার প্রায় এক ঘণ্টা ধরে তল্লাশি চালিয়ে ঘটনাস্থল থেকে তিনটি তালা (একটি তালার মধ্যে চাবি লাগানো) উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. রেজাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, উদ্ধার করা তালাগুলো ঘটনার সঙ্গে কীভাবে সংশ্লিষ্ট, তা যাচাই করা হচ্ছে। আগুন দেওয়ার ঘটনাটি পরিকল্পিত কি না এবং এর পেছনে কারা জড়িত—সবদিক গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অবশ্য ঘটনার পর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) হোসাইন মোহাম্মদ রায়হান কাজেমীর সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছিল, আগুনের ঘটনায় নাশকতার কোনো ‘বিশ্বাসযোগ্য’ আলামত পায়নি পুলিশ। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার চার দিন পর ২৩ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাতে সদর থানায় মামলা করেন বেলাল হোসেন।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চরমনসা গ্রামে বাইরে থেকে তালাবন্ধ ঘরে আগুনের ঘটনায় ওই দিনই মারা যায় সাত বছরের আয়েশা আক্তার
ছবি: সংগৃহীত

ঘরে পেট্রল ঢেলে দরজায় তালা দিয়ে কারা বা কী কারণে আগুন দিল, এ প্রশ্নের উত্তরে বেলাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না কেন এমন ঘটনা ঘটল। তিনি বলেন, ‘নাশকতার জন্য আগুন না দিলে এত অল্প সময়ে এমন করে আগুন জ্বলত না। পুলিশ প্রথমে বলছে নাশকতার কিছু পায়নি আবার তিনটি তালাও উদ্ধার করছে। ঘরে তালা না থাকলে বা নাশতকার জন্য আগুন না লাগাইলে আমার মেয়েরা পুড়ল কেন? এত কম সময়ে সব জ্বলে যায় কেমনে? প্রশাসনের কাছেই জবাব চাই।’

রাষ্ট্রকে খুঁজে বের করতে হবে: সারা হোসেন

অগ্নিদগ্ধ সালমা আক্তারকে দেখতে বুধবার সকালে রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে গিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন কাজী জাহেদ ইকবাল, ফারহানা শারমীন ও মানজুর-আল-মতিন।

সে সময় সালমার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিয়ে সারা হোসেন বলেন, সেখানে কীভাবে আগুন লাগল, এমন মর্মান্তিক ঘটনা কেন ঘটল, কেউ জড়িত কি না—সেটি রাষ্ট্রকে খুঁজে বের করতে হবে। কেউ আগুন দিয়ে থাকলে সেটা গুরুতর অপরাধ।

ঘরে কেউ আগুন দিয়ে থাকলে তা গুরুতর অপরাধ উল্লেখ করে সারা হোসেন আরও বলেন, এ ঘটনায় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সব ধরনের আইনি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যদি পরিবারটির আইনগত সহায়তার প্রয়োজন হয়, তবে তা করা হবে।