১৪টি শকুনের মৃত্যু: ছাগলের গায়ে ঢালা বিষ কুকুর-শিয়াল হয়ে যায় শকুনের পেটে

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের তিনটি স্থান থেকে শকুনের মৃতদেহগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সকালেছবি: প্রথম আলো

মৌলভীবাজারে ১৪টি শকুনকে বিষ প্রয়োগে মারা হয়েছে। একই পরিবারের তিনজন সদস্য একটি মৃত ছাগলের গায়ে বিষ মিশিয়ে ফেলে রাখেন। আর ওই ছাগলের মাংস খেয়ে তিনটি কুকুর ও একটি শিয়াল মারা যায়। ওই চারটি প্রাণীর মৃতদেহ খেয়ে শকুনগুলোর মৃত্যু হয়েছে। বন বিভাগ এবং প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন সূত্রে তা নিশ্চিত হওয়া গেছে।

শকুন হত্যার ঘটনায় মৌলভীবাজার সদর থানায় আজ বৃহস্পতিবার একটি মামলা করেছে বন বিভাগ। মো. রোকন ও মজনু মিঞা নামে দুজনকে আসামি করা হয়েছে। বন বিভাগ থেকে শকুনের মৃতদেহ উদ্ধার হওয়া এলাকা থেকে দুটি বিষের বোতল উদ্ধার করা হয়েছে। মামলার সঙ্গে প্রমাণ হিসেবে ওই বোতল দুটি থানায় জমা দেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ প্রথম আলোকে জানান, শকুনগুলো ৮-১০ দিন আগে মারা যেতে পারে। মৃতদেহগুলো সংগ্রহ করে বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিভাগে পাঠানো হয়েছে।

মামলায় বলা হয়েছে, বন থেকে আসা শিয়াল অভিযুক্ত দুজনের বাড়ির একটি ছাগলকে কামড় দেয়। এতে ছাগলটি মারা গেলে এর মালিক ক্ষিপ্ত হয়ে ছাগলের গায়ে বিষ ঢেলে দিয়ে ফেলে রাখে। আর তা ওই কুকুর ও শিয়ালগুলো খায়। ঘটনাস্থলে তিনটি কুকুর ও একটি শিয়ালের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

আইইউসিএন, বাংলাদেশের শকুন সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য একটি শকুনের শরীরে আইইউসিএনের স্যাটেলাইট ট্যাগ লাগানো হয়েছিল। ওই শকুনকে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসা করতে দেখা যায়। কিন্তু কয়েক দিন ধরে শকুনটির অবস্থান একই জায়গায় অনড় ছিল। কোনো সিগন্যাল মিলছিল না। এই অনড় থাকার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে শকুনের মৃত্যুর বিষয়টি ধরা পড়ে।

আইইউসিএনের শকুন সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রধান সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে গবেষক দলটি গত বুধবার শকুনটির অবস্থান চিহ্নিত করে। আজ সকাল আটটার দিকে তারা মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের কালারবাজারসংলগ্ন এলাকায় এসে শকুনের মৃতদেহগুলো দেখতে পায়। গবেষক দলটি ঘটনাস্থল থেকে ১১টি শকুনের মৃতদেহ উদ্ধার করে। মৌলভীবাজার সদরের একাটুনা ইউনিয়নের কালার বাজারসংলগ্ন বরকাপন, বুড়িকোনা ও রসুলপুরের বসতি এলাকাসংলগ্ন মাঠের বিভিন্ন স্থানে মৃত কুকুর ও কুকুর-শিয়ালের দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়।

সারোয়ার আলম এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, বাংলা শকুন বিশ্বজুড়ে মহাবিপন্ন। এটি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্তির পথে ছিল। কিন্তু বন বিভাগ ও আইইউসিএনের নেওয়া উদ্যোগে এদের সংখ্যা বাড়ছিল। আর সিলেট এলাকাতেই তা বাড়তে দেখা যাচ্ছিল। আর যাতে কোনো শকুন এইভাবে মারা না যায়, সে জন্য জরুরি পদক্ষেপ ও সচেতনতা বাড়াতে হবে।

আইইউসিএন সূত্রে জানা গেছে, গত এক যুগে একসঙ্গে এতগুলো শকুনের মৃত্যুর ঘটনা দেশে ঘটেনি। এর আগে গত বছরের আগস্টে একসঙ্গে ৫টি শকুন মারা যায়। আর বিশ্বের মধ্যে মৌলভীবাজারের ওই ঘটনার আগে একসঙ্গে এর চেয়ে বেশি শকুনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে নেপালে গত বছরের জুলাই মাসে। সেখানে একসঙ্গে ৭০টি শকুন মারা যায়।

বন বিভাগ ও আইইউসিএনের জরিপ অনুযায়ী, দেশে ২৬০টি শকুন ছিল। এর মধ্যে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে ছিল ৮০টি। এই ১৪টি শকুনের মৃত্যুর পর এই সংখ্যা আরও কমে গেল।

বন বিভাগ থেকে এরই মধ্যে মৃত শিয়াল, কুকুর ও ছাগলের মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে, যাতে অন্য কোনো শকুন ওই মাংস খেয়ে মারা না যায়। এ ধরনের বিষ প্রয়োগের ঘটনা আর যাতে না ঘটে, সে জন্য স্থানীয়ভাবে জনসাধারণকে সচেতনতার প্রচার চালানো হচ্ছে।

আরও পড়ুন