বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় নারীদের বিয়ে করা কি অপরাধ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের একমাত্র আবাসিক হল বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল ফাইল ছবি

বিয়ে ও সন্তান জন্মদান—দুটোই নারীর প্রজনন অধিকার। এরপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে আসন পাওয়া, চাকরি—এমন অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের বেলায় অবিবাহিত হওয়া কিংবা সন্তান না থাকার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। আইনে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে আসন পাওয়া বা চাকরির জন্য যাঁরা আবেদন করেন, তাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক নারী। তাহলে তাঁদের ক্ষেত্রেও কেন এমন নিষেধাজ্ঞা?

গত ২৫ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের প্রাধ্যক্ষ দীপিকা রাণী সরকারের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বিবাহিত এবং অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীদের আসন ছাড়তে বলা হয়। কেননা হলের আবাসিকতা পাওয়ার শর্ত অনুযায়ী বিবাহিত ছাত্রীদের আসন পাওয়ার সুযোগ নেই।

জবির বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের প্রাধ্যক্ষের দেওয়া ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আবাসিকতা লাভ ও বসবাসের শর্তাবলি এবং আচরণ ও শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা ২০২১–এর ১৭ নম্বর ধারা মোতাবেক বিবাহিত ও গর্ভবতী ছাত্রীরা আবাসিক সিট (আসন) পাবে না। বিধায় তারা অতি দ্রুত হলের সিট ছেড়ে দেবে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।  

তবে গত ২৭ সেপ্টেম্বর এ বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার চেয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে আইনি নোটিশ পাঠান বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. সোলায়মান। ওই নোটিশে বলা হয়, বিবাহিত ও গর্ভবতী ছাত্রীদের জন্য এমন নিয়ম নারীদের উচ্চশিক্ষা অর্জনের পথে অন্তরায়। এটি বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদের সঙ্গেও সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।

আইনজীবী সোলায়মান প্রথম আলোকে বলেন, সংবিধানবিরোধী এ ধরনের নির্দেশনা কেউ দিতে পারেন না। আইনি নোটিশে কাজ না হলে হাইকোর্ট বিভাগে রিট করা হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিবাহিত-অবিবাহিত এভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এভাবে দেখলে তা হবে বৈষম্যমূলক, যা গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষার্থী অন্তঃসত্ত্বা হলে তাঁর শারীরিক ও মানসিক দিক বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যুক্তিসংগত কোনো পরামর্শ দিতে পারে।

বর্তমান সময়ে এ ধরনের নির্দেশনা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তো এ ধরনের অসাংবিধানিক নির্দেশনা দিতেই পারে না। চারকির ক্ষেত্রেও বিবাহিত না হওয়ার শর্ত বেঁধে দেওয়া অসাংবিধানিক। নারীদের পিছিয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মহলে এ ধরনের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে।
মালেকা বানু, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

জবির হল কর্তৃপক্ষ যা বলছে

অবশ্য জবির বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের প্রাধ্যক্ষ দীপিকা রাণী সরকার তাঁর নির্দেশ দেওয়ার পক্ষে বেশ কিছু যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, হলটিতে রাতের বেলা হাউস টিউটর ও প্রভোস্ট কেউ থাকেন না। গেটে দুজনসহ মাত্র তিনজন লোক আছেন। হলে চিকিৎসক নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অ্যাম্বুলেন্স আছে। কোনো মেয়ে অসুস্থ হলে অন্য মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে হলের গেটে থাকা দুজন তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যান। অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীদের গর্ভপাত হওয়াসহ এর আগেও বিভিন্ন সমস্যা হয়েছে। রাতের বেলা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে কে দেখবেন?

দীপিকা রাণীর দাবি, বিবাহিত নারীদের সাধারণত ঢাকায় বাসা ভাড়া করে থাকার সামর্থ্য থাকে। তাঁদের সিটগুলো মা-বাবা নেই কিংবা দূর থেকে পড়তে এসেছেন এমন ছাত্রীদের দিলে তাঁরা পড়াশোনাটা শেষ করতে পারেন। এ ছাড়া বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীদের জন্য অন্য শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যা পোহাতে হয় বলেও দাবি করেন তিনি।

আইনি নোটিশ প্রসঙ্গে জবির বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের প্রাধ্যক্ষ বলেন, ছাত্রীরা তাঁদের কাছে এসে সমস্যার কথা বলতে পারতেন। তা তাঁরা করেননি। এখন আইনি প্রক্রিয়ায় যে সিদ্ধান্ত, তা–ই নেওয়া হবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের প্রাধ্যক্ষ দীপিকা রাণী সরকারের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বিবাহিত এবং অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীদের আসন ছাড়তে বলা হয়। কেননা হলের আবাসিকতা পাওয়ার শর্ত অনুযায়ী বিবাহিত ছাত্রীদের আসন পাওয়ার সুযোগ নেই।

‘অন্তঃসত্ত্বা নারীর চাহিদামতো অবকাঠামো তৈরি করতে হবে’

বিবাহিত ছাত্রীদের হলে থাকা নিয়ে কর্তৃপক্ষের এমন নির্দেশনা দেওয়ার নজির এটাই প্রথম নয়। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলে এমন নির্দেশনা দিতে দেখা গেছে। এমনকি কিছু কিছু চাকরির বিজ্ঞাপনেও বলে দেওয়া হয়, বিবাহিত নারীরা আবেদন করতে পারবেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের পাঁচটি হলে আসন বণ্টন-সম্পর্কিত নীতিমালার একটি ধারায় বলা ছিল, ‘কোনো ছাত্রী বিবাহিত হলে অবিলম্বে কর্তৃপক্ষকে জানাবেন। অন্যথায় নিয়ম ভঙ্গের কারণে তাঁর সিট বাতিল হবে। শুধু বিশেষ ক্ষেত্রে বিবাহিত ছাত্রীকে চলতি সেশনে হলে থেকে অধ্যয়নের সুযোগ দেওয়া হবে। অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রী হলে থাকতে পারবেন না।’

এই নিয়ম নিয়ে ২০২১ সালে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়। ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বরাবর লিখিত আবেদনে নিয়মটি বাতিলসহ চার দফা দাবি জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্রী হলের প্রতিনিধিরা।

২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলগুলোতে বিবাহিত ছাত্রীরা থাকতে পারবে না’—এমন নিয়ম বাতিল চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। পরে এই নিয়ম বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিবাহিত-অবিবাহিত এভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এভাবে দেখলে তা হবে বৈষম্যমূলক, যা গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষার্থী অন্তঃসত্ত্বা হলে তাঁর শারীরিক ও মানসিক দিক বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যুক্তিসংগত কোনো পরামর্শ দিতে পারে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে অনেক কিছুর পরিবর্তন করতে হয়। তবে অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীর ক্ষেত্রে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা থাকলে, তা নিতে বলা হয়।

২০২১ সালে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (এমবিএসটিইউ) বিবাহিত শিক্ষার্থীদের হল খালি করার নির্দেশ দেয়, সেই সঙ্গে তাঁদের হলে আসনের জন্য আবেদন করতেও নিষেধ করে। এ ঘটনা সমালোচনার জন্ম দিলে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নার্সিং অনুষদে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে চার বছর মেয়াদি ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন নার্সিং কোর্সে প্রথম বর্ষে ভর্তির আবেদনে উল্লেখ ছিল, প্রার্থীকে অবশ্যই অবিবাহিত হতে হবে। কোর্স চলাকালে বিয়ে করতে পারবেন না। কোর্সের যেকোনো পর্যায়ে বিবাহিত প্রমাণিত হলে ভর্তি বাতিল করা হবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল প্রাধ্যক্ষের স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তি
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য তানিয়া হক বলছিলেন, তিনি ২০০৭ সালে তাঁর ৪ বছর বয়সী সন্তানকে নিয়ে নেদারল্যান্ডসে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়ার সময় বিপাকে পড়েছিলেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সন্তানসহ তাঁকে যেতে নিষেধ করেছিল। অনেক সংগ্রামের পর সন্তানসহ তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়তে গিয়েছিলেন।

তানিয়া হক বলেন, তাহলে কি বিবাহিত নারী বা মা হওয়া মেয়েরা পড়বেন না? একজন বিবাহিত আর অবিবাহিত মেয়ের মধ্যে কেন বৈষম্য করা হবে? বিবাহিত হলেই তাঁর থাকার জায়গা থাকবে, এটা ভাবারও তো কারণ নেই। অন্তঃসত্ত্বা নারীর হয়তো কিছু বাড়তি চাহিদা থাকতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে সেই চাহিদামতো অবকাঠামো তৈরি করতে হবে।

চাকরির আবেদনেও ‘অবিবাহিত’ শর্ত

দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর হওয়া নারীদের বিয়ে করায় কোনো বাধা নেই। তেমনি প্রাপ্তবয়স্ক একজন নারী শারীরিক ও মানসিকভাবে বিয়ে ও সন্তান নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন।

সরকারের আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক চিকিৎসক নুরুন নাহার বললেন, ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সের মধ্যের একজন নারী শারীরিক ও মানসিকভাবে বিয়ে ও সন্তান নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন। বিভিন্ন জটিলতা হতে পারে, সে বিবেচনায় ৩৫ বছর বয়সের পর আর কোনো সন্তান না নিতে নারীদের উৎসাহিত করা হয়।

তবে গত বছরের অক্টোবর মাসে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস লিমিটেড কেবিন ক্রু বা ফ্লাইট স্টুয়ার্ডেস নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সেখানে প্রার্থীকে অবিবাহিত হতে হবে বলে উল্লেখ ছিল।

এ ছাড়া গত বছর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৯৯তম ব্যাচে ‘সিপাহি (জিডি)’ পদে পুরুষ ও নারীদের নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সেখানেও বৈবাহিক অবস্থা ‘অবিবাহিত’ এবং বন্ধনীচিহ্নের ভেতরে আলাদাভাবে ‘তালাকপ্রাপ্ত নয়’ কথাটিও লিখে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

জাতিসংঘ সিডও সনদ বা নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদে নারীর সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়া নিরাপদ রাখাসহ স্বাস্থ্য রক্ষা এবং কাজের পরিবেশে গর্ভধারণ বা মাতৃত্বসংক্রান্ত কারণে বৈষম্য রোধের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। সনদের ২ নম্বর ধারায় বলা আছে, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে শরিক দেশগুলো আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে এবং আইনের সংস্কার করবে। তবে সরকার এ সনদের ২ নম্বর এবং ১৬.১ (গ) ধারাটিতে (বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও দায়িত্ব) এখনো আপত্তি বহাল রেখেছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, বর্তমান সময়ে এ ধরনের নির্দেশনা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তো এ ধরনের অসাংবিধানিক নির্দেশনা দিতেই পারে না। চারকির ক্ষেত্রেও বিবাহিত না হওয়ার শর্ত বেঁধে দেওয়া অসাংবিধানিক। নারীদের পিছিয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মহলে এ ধরনের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে।