চট্টগ্রামে ঘন ঘন লোডশেডিং, লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ছে চার্জার ফ্যান-আইপিএসের
গত কয়েক দিনে দেশজুড়ে লোডশেডিং পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ব্যতিক্রম নয় চট্টগ্রামও। জাতীয় গ্রিড থেকে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ না পাওয়ায় বন্দরনগরীটিতে ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রচণ্ড দাবদাহ। একদিকে লোডশেডিং, অন্যদিকে প্রচণ্ড গরম—এ দুইয়ে দুর্বিষহ করে তুলেছে জনজীবন।
জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, এ অবস্থা থেকে কবে মুক্তি পাওয়া যাবে? কিন্তু এখনই আশার কথা শোনাতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তারা জানান, চলমান সংকটজনক পরিস্থিতি খুব দ্রুত নিরসন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ না পাওয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এদিকে তীব্র গরমের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু কাপ্তাই হ্রদে পানি কমে যাওয়ায় ও জ্বালানির অভাবে অনেক ইউনিট চালু করা যাচ্ছে না। এ কারণে ঘাটতি দূর করাও যাচ্ছে না।অশোক কুমার চৌধুরী, পিডিবির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী।
দ্রুত সংকট না কাটার বড় একটি কারণ কাপ্তাই হ্রদে পানি কমে যাওয়া। এ কারণে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিটের চারটিই বন্ধ হয়ে গেছে। আবার গ্যাস ও জ্বালানি তেলের অভাবেও অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতেও উৎপাদনপ্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থায় টানা বৃষ্টি না হলে লোডশেডিং কমার সম্ভাবনা খুব একটা নেই বলে মনে করছেন পিডিবির কর্মকর্তারা।
গত কয়েক দিনের মধ্যে নগরীতে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং ছিল গত রোববার। এদিন বেলা ১১টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল দেড় হাজার মেগাওয়াট। এর বিপরীতে বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল ১ হাজার ৩৯ মেগাওয়াট। এ কারণে বিদ্যুতের ঘাটতি থাকে ৪৬১ মেগাওয়াট। সন্ধ্যার দিকেও প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল।
লোডশেডিং পরিস্থিতির অবনতির কারণে বিকল্প ব্যবস্থায় ঝুঁকছেন চট্টগ্রামের মানুষ। একটু স্বস্তির আশায় অনেকেই চার্জার ফ্যান, চার্জার বাতি ও আইপিএস কিনছেন; যদিও চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এসব পণ্যের দামও বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
গতকাল সোমবার চাহিদার তুলনায়ও অনেক কম বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে পিডিবির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী অশোক কুমার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল দুপুরে প্রায় সাড়ে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল। প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ না পাওয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এদিকে প্রচণ্ড গরমের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু কাপ্তাই হ্রদে পানি কমে যাওয়ায় ও জ্বালানির অভাবে অনেক ইউনিট চালু করা যাচ্ছে না। এ কারণে ঘাটতি দূর করাও যাচ্ছে না।
বিকল্প ব্যবস্থায় ঝুঁকছেন মানুষ
লোডশেডিং পরিস্থিতির অবনতির কারণে বিকল্প ব্যবস্থায় ঝুঁকছেন চট্টগ্রামের মানুষ। একটু স্বস্তির আশায় অনেকেই চার্জার ফ্যান, চার্জার বাতি ও আইপিএস (তাৎক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা) কিনছেন; যদিও চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এসব পণ্যের দামও বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কোনো কোনো পণ্যের দাম এক থেকে দেড় হাজার টাকা বেড়েছে। উপায় না থাকায় বেশি দামেই কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন জাবেদুল ইসলাম। স্ত্রী, দুই শিশুসন্তান ও বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে তাঁর সংসার। থাকেন চট্টগ্রাম নগরের রাহাত্তরপুল এলাকায়। জাবেদুল ইসলাম বলেন, ‘রাতে কারেন্ট (বিদ্যুৎ) থাকে না। একবার এলে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট থাকে। এরপর আবার চলে যায়। একবার গেলে এক থেকে দেড় ঘণ্টায়ও আসে না। প্রচণ্ড গরমে ঘুমানো যায় না। দিনের বেলায়ও একই পরিস্থিতি। বাসায় বৃদ্ধ বাবা ও শিশুদের নিয়ে রীতিমতো বিপদে পড়ে গেছি।’
এই ‘বিপদ’ থেকে উদ্ধার পেতে গত রোববার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরের রাইফেল ক্লাব মার্কেট থেকে ছয় হাজার টাকায় একটি চার্জার ফ্যান কেনেন জাবেদুল। এ জন্য তাঁকে ঘুরতে হয় তিনটি বিপণিবিতান। দুই শিশুসন্তানের জন্য এই ফ্যান কেনেন তিনি। পরে বাবার জন্য আরেকটি চার্জার ফ্যান কিনতে গতকাল একই বিপণিবিতানে যান তিনি। কিন্তু এক দিনের ব্যবধানে একই চার্জার ফ্যান কিনতে তাঁকে গুনতে হয় বাড়তি ৫০০ টাকা।
ক্ষোভ প্রকাশ করে জাবেদুল বলেন, ‘লোডশেডিংয়ের জন্য দুর্বিষহ দিন কাটাতে হচ্ছে। দিন-রাত বিদ্যুৎ থাকে না। তীব্র গরমে বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বৃদ্ধ বাবারও সমস্যা হচ্ছে। তাঁদের সুরক্ষার জন্য চার্জার ফ্যান কিনতে হয়েছে। কিন্তু এক দিনের ব্যবধানে একই ফ্যানের দাম কীভাবে ৫০০ টাকা বেড়ে যায়?’
বেড়েছে চার্জার ফ্যানের চাহিদা, দামও বেশি
গতকাল দুপুরে রাইফেল ক্লাব মার্কেটে চার্জার ফ্যান কিনতে এসেছিলেন নগরের দুই নম্বর গেটের বাসিন্দা মোখলেসুর রহমান। তিনি বলেন, ‘লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় ঘরে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে চার্জার ফ্যান কিনতে হচ্ছে। তিন-চারটি দোকান ঘুরেছি। সবাই বাড়তি দাম চাইছে।’
মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘সপ্তাহখানেক আগেও যে চার্জার ফ্যানের দাম ছিল সাড়ে চার হাজার টাকা, এখন তা সাড়ে ছয় হাজার থেকে সাত হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দরদাম করে সাড়ে ছয় হাজার টাকায় একটি ফ্যান কিনেছি।’
লোডশেডিংয়ের জন্য দুর্বিষহ দিন কাটাতে হচ্ছে। দিন-রাত বিদ্যুৎ থাকে না। তীব্র গরমে বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বৃদ্ধ বাবারও সমস্যা হচ্ছে। তাঁদের সুরক্ষার জন্য চার্জার ফ্যান কিনতে হয়েছে। কিন্তু এক দিনের ব্যবধানে একই ফ্যানের দাম কীভাবে ৫০০ টাকা বেড়ে যায়?জাবেদুল ইসলাম, বেসরকারি চাকরিজীবী।
লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় চার্জার ফ্যানের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে উল্লেখ করে রাইফেল ক্লাব মার্কেটের জিলানি ইলেকট্রনিকসের বিক্রয়কর্মী রূপণ চৌধুরী বলেন, এখন প্রতিদিন গড়ে ৫০টি চার্জার ফ্যান বিক্রি হচ্ছে। আগে ১০ থেকে ১৫টি বিক্রি হতো।
দাম বাড়তি নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে রূপণ চৌধুরী বলেন, তাঁরা বেশি দামে চার্জার ফ্যান বিক্রি করছেন না। আমদানিকারকদের কাছ থেকে বাড়তি দামে ফ্যান কিনতে হচ্ছে। তাই দাম বেশি রাখতে হচ্ছে।
বাড়তি দাম চার্জার বাতি-আইপিএসেরও
রাইফেল ক্লাব মার্কেটের সরকার ইলেকট্রনিকসের মালিক বিশ্বজিৎ সরকার জানান, শুধু চার্জার ফ্যান নয়, এখন চার্জার বাতির চাহিদাও বেড়েছে। বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় প্রতিটি বাতি আগের চেয়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বাড়তি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে বিশ্বজিৎ সরকারের ভাষ্য, দাম বাড়লেও তাঁদের লাভ হচ্ছে কম। কেননা, তাঁরাও বাড়তি দামে কিনছেন।
চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদের পাওয়ার সেল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী রাজীব দত্ত। তিনি জানান, কয়েক দিন ধরে আইপিএস বিক্রি বেড়েছে। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০টি আইপিএস বিক্রি হচ্ছে। দু–এক মাস আগেও সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০টি আইপিএস বিক্রি হতো।
যন্ত্রাংশের দাম বাড়ার কারণে একেকটি আইপিএসের দাম ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা বেড়েছে—এমন দাবি করে রাজীব দত্ত বলেন, শুধু নতুন আইপিএস বিক্রি হচ্ছে—এমনটা নয়, পুরোনো আইপিএসও মেরামত করছেন অনেকেই।
জনদুর্ভোগকে পুঁজি করে পণ্যের বাড়তি দাম নেওয়ার বিষয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, লাগামহীন লোডশেডিং মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। এর মধ্যেই বিকল্প সব পণ্য বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা করার প্রবণতা ও প্রশাসনের নীরবতার কারণে সাধারণ মানুষ এই সংকটে পড়েছে।