গরমে হাসপাতালে বাড়ছে জ্বর-ডায়রিয়ার রোগী

ঢাকার বাইরের প্রায় সব হাসপাতালেই শয্যার চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি। বহির্বিভাগেও রোগীর চাপ বেশি।

তাপপ্রবাহে হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে। অনেকে শয্যা না পেয়ে বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। গতকাল খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেসাদ্দাম হোসেন

জ্বর ও কাশি নিয়ে ৯ মাস বয়সী আলিজা আকতার মায়ের কোলে অনেকটা কাহিল হয়ে পড়েছে। মা আনিছা আকতার তাকে নিয়ে রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগে চিকিৎসক দেখানোর অপেক্ষায় ছিলেন। গতকাল সোমবার দুপুর ১২টার দিকে আলিজাকে সেবা দেন হাসপাতালের চিকিৎসক মাহফুজ হাসান আল মামুন।

চিকিৎসক মাহফুজ প্রথম আলোকে বলেন, তাপপ্রবাহের কারণে হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীর চাপ বেড়েছে। শিশুরা এখন জ্বর, সর্দি, কাশির মতো ইনফ্লুয়েঞ্জার (শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ) উপসর্গ নিয়ে বেশি আসছে। পাশাপাশি পানিশূন্যতাজনিত ডায়রিয়ার রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

এই চিত্র শুধু রাজধানীর নয়, দেশের ১০টি জেলায় খোঁজ নিয়ে প্রায় একই পরিস্থিতি দেখা গেছে। প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে দেখা যায়, চলমান তাপপ্রবাহে হাসপাতালে রোগী বেড়েছে। বিশেষ করে শিশুরা জ্বর, ডায়রিয়া ও বয়স্করা শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। ঢাকার বাইরের প্রায় সব হাসপাতালেই শয্যার চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি আছেন। বহির্বিভাগেও সেবা নিতে আসা রোগীর চাপ বেশি।

ইনফ্লুয়েঞ্জা হলে জ্বর, কাশি, মাথাব্যথা, পেশি ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, খারাপ লাগা বোধ করা, গলাব্যথা ও নাক দিয়ে সর্দি ঝরার মতো লক্ষণ দেখা দেয়; অর্থাৎ ইনফ্লুয়েঞ্জা মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আবহাওয়ার বিরূপ পরিস্থিতি। ফলে শিশুদের ঠান্ডাজনিত উপসর্গ বাড়ছে।

এবার ১ এপ্রিল থেকে তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ২৯ দিন ধরে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, গত ২৮ দিনে (১ এপ্রিল থেকে ২৮ এপ্রিল) বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছে ২১ হাজার ৭০৯ জন রোগী। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, পবিত্র ঈদুল ফিতর ও পয়লা বৈশাখের দীর্ঘ ছুটির পরেও রোগীর এই সংখ্যা অনেকটা বেশি। এই ২৮ দিনে গড়ে ১৩০টি শিশু নতুন ভর্তি হয়েছে।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শায়লা আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, তাপপ্রবাহ শুরুর পর বিশেষ করে ঈদের ছুটির পর রোগী বেড়েছে। শিশুরা বেশি ঘামে। অল্পতেই পানির ঘাটতি বেড়ে যায়। হাসপাতালে আসা শিশুদের বড় অংশই গরমে অসুস্থ হচ্ছে। মায়েরা এসে বলছেন, বাচ্চার খারাপ লাগছে। যেটি আসলে গরমের কারণে অস্বস্তি।

আরও পড়ুন

সম্প্রতি রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং আইসিডিডিআরবি এক যৌথ পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা হলে জ্বর, কাশি, মাথাব্যথা, পেশি ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, খারাপ লাগা বোধ করা, গলাব্যথা ও নাক দিয়ে সর্দি ঝরার মতো লক্ষণ দেখা দেয়; অর্থাৎ ইনফ্লুয়েঞ্জা মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আবহাওয়ার বিরূপ পরিস্থিতি। ফলে শিশুদের ঠান্ডাজনিত উপসর্গ বাড়ছে।

শয্যার তুলনায় এই হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। এক সপ্তাহ ধরে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গরমজনিত রোগ নিয়ে রোগীরা বেশি চিকিৎসা নিতে আসছেন। পাশের জেলা শেরপুর, কুড়িগ্রামের রাজিবপুর ও রৌমারী উপজেলার রোগীও এখানে আসছেন।
জামালপুর জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মো.মাহফুজুর রহমান

শয্যার অতিরিক্ত রোগী

গতকাল দুপুর ১২টার দিকে জামালপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের মেঝে ও বারান্দায় চাদর ও পাটি বিছিয়ে শতাধিক রোগীকে শুয়ে থাকতে দেখা গেছে। প্রচণ্ড গরমে রোগী ও স্বজনদের হাঁসফাঁস অবস্থা। বিদ্যুৎ চলে গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। রোগীদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা।

২৫০ শয্যার এই হাসপাতালে গতকাল ৫৬৮ রোগী ভর্তি ছিলেন। অতিরিক্ত ভর্তি ৩১৮ রোগী ওয়ার্ডের মেঝে ও বারান্দায় বিছানা করে সেবা নিচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি ছিলেন মেডিসিন ওয়ার্ডে, ২২৮ জন। গতকাল বহির্বিভাগে ১ হাজার ৫৩৫ জন রোগী সেবা নিয়েছেন। এসব রোগীর মধ্যে ঠান্ডা, জ্বর, ডায়রিয়া ও গরমজনিত রোগীর সংখ্যা বেশি।

জামালপুর জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মো.মাহফুজুর রহমান বলেন, শয্যার তুলনায় এই হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। এক সপ্তাহ ধরে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গরমজনিত রোগ নিয়ে রোগীরা বেশি চিকিৎসা নিতে আসছেন। পাশের জেলা শেরপুর, কুড়িগ্রামের রাজিবপুর ও রৌমারী উপজেলার রোগীও এখানে আসছেন।

গরমের মধ্যে কাজ করতে করতে মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। মাথায় পানি ঢালার পর সুস্থ না হওয়ায় মেডিকেলে নিয়া আসছি। এখানে এসে চিকিৎসা পাওয়ার পর এখন অনেকটা ভালো আছেন
সাবিনা আক্তার , গাইবান্ধা

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যার দ্বিগুণের বেশি রোগী ভর্তি রয়েছেন। হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ১ হাজার শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি ছিলেন ২ হাজার ২১ জন। শিশু ওয়ার্ডে ৭২ শয্যার বিপরীতে ২০৮টি শিশু রোগী ভর্তি ছিল।

গাইবান্ধার পলাশবাড়ী থেকে শ্বাসকষ্ট ও পাতলা পায়খানা নিয়ে গত শনিবার এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সাবিনা আক্তার (৪৫)। তাঁর সঙ্গে থাকা মেয়ে আক্তারা বেগম জানান, ‘গরমের মধ্যে কাজ করতে করতে মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। মাথায় পানি ঢালার পর সুস্থ না হওয়ায় মেডিকেলে নিয়া আসছি। এখানে এসে চিকিৎসা পাওয়ার পর এখন অনেকটা ভালো আছেন।’

আরও পড়ুন

৫০০ শয্যার খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গতকাল ১ হাজার ৩৪২ জন রোগী ভর্তি ছিলেন, যা ধারণক্ষমতার প্রায় তিন গুণ বেশি। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের ৪৮টি শয্যার বিপরীতে ভর্তি ছিল ১২৪ শিশু। এই ওয়ার্ডের সহকারী রেজিস্ট্রার চিকিৎসক মো. আবু জাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, এই গরমে দুই মাস বয়স থেকে এক বছর বয়সী শিশুরা বিভিন্ন রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।

মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত মাসের তুলনায় চলতি মাসে রোগীর চাপ বেড়েছে। মার্চের ২১ থেকে ২৮ তারিখ হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৪৩৭ জন। এক মাসের ব্যবধানে ২১ থেকে ২৮ এপ্রিল ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৩৪ জনে।

প্রচণ্ড গরম থেকে প্রথমে খিঁচুনি দিয়ে জ্বর আসে। পরে বমি ও পাতলা পায়খানা। উপায় না পেয়ে হাসপাতালে এসেছেন।
খাদিজা আক্তার, নাচোল

জ্বর-ডায়রিয়ার রোগী বেশি

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে গেটের বাইরে খাদিজা আক্তার তাঁর তিন মাসের সন্তান আসমাকে পাখা দিয়ে বাতাস করছিলেন। তিনি গত রোববার সন্ধ্যা সাতটার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল থেকে এসেছেন। খাদিজা বলেন, প্রচণ্ড গরম থেকে প্রথমে খিঁচুনি দিয়ে জ্বর আসে। পরে বমি ও পাতলা পায়খানা। উপায় না পেয়ে হাসপাতালে এসেছেন।

হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, রাজশাহী অঞ্চলে তীব্র তাপদাহে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ডায়রিয়ার রোগী। গত শনিবার ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছেন মোট ৪৯ জন। এর মধ্যে শিশু রোগী ২৯ জন। গত রোববার ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ৫৪ জন। এর মধ্যে শিশু ২৮ জন। এ ছাড়া হাসপাতালে তীব্র গরমে ঠান্ডা-জ্বর-কাশিসহ নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

মাগুরা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে শয্যা আছে ৪৫টি। গত রোববার ১১৬টি শিশু ভর্তি ছিল। এর মধ্যে অন্তত ৩৬টি শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা বিকাশ কুমার শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, চলমান তাপদাহের কারণে রোগীর সংখ্যা বাড়ায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে গতকাল ৯৬ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন। ছয় মাস বয়সী শিশু আছিয়াকে কোলে করে বসে ছিলেন নানি হাওয়া বেগম। বমি ও পাতলা পায়খানায় কাহিল হয়ে পড়া শিশুটির শরীরে চলছিল স্যালাইন। সদর হাসপাতালের শিশু বিভাগের পরামর্শক আসাদুর রহমান বলেন, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় চুয়াডাঙ্গায় শিশুরা জ্বরের পাশাপাশি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]