হত্যার উদ্দেশ্যে ড্রোন, হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের আদেশ দেন শেখ হাসিনা

শেখ হাসিনাফাইল ছবি

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের অবস্থান নির্ণয়ে ড্রোন ব্যবহার করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আদেশ দেন।  তাই তাঁদের হত্যার উদ্দেশ্যে হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়।

আর এই আদেশের বিষয়টি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে তাঁর গত বছরের ১৮ জুলাই টেলিফোনে কথোপকথনে উন্মোচিত হয়। এ ছাড়া সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে তাঁর কথোপকথন শোনানো হয়।

আরও পড়ুন

গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় শেখ হাসিনাসসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার রায়ে এমন অভিমত দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

ঘোষিত রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, উল্লেখিত কথোপকথন–সংক্রান্ত পেনড্রাইভ, সিডি ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে। কথোপকথন সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কাছে কথোপকথন সঠিক (জেনুইন) বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বলা হয়েছে এটি এআই দিয়ে তৈরি করা নয়। কথোপকথন ধারণ করা পেনড্রাইভ, সিডি আদালতকক্ষে শোনানো হয়। এসব কথোপকথন শুনেছি, তাতে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে কথোপকথন প্রকৃত, জাল ও সৃজন করা নয়।

ঘোষিত রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হত্যার উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন পরস্পর যোগসাজশে ও সহযোগিতায় যৌথভাবে নৃশংসতা ঘটান।

গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় এই প্রথম কোনো মামলায় গতকাল সোমবার রায় হয়।  

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল ওই রায় দেন। রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আরেক আসামি সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

পরস্পর যোগসাজশে নৃশংসতা

ঘোষিত রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হত্যার উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন পরস্পর যোগসাজশে ও সহযোগিতায় যৌথভাবে নৃশংসতা ঘটান। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের সাক্ষ্যে উন্মোচিত হয় যে তৎকালীন  স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাংগীর, অতিরিক্ত সচিব, এসবিপ্রধান, ডিবিপ্রধান, র‍্যাব মহাপরিচালক, ঢাকা মহানগর কমিশনার, বিজিবি ও আনসারের মহাপরিচালক, এনটিএমসিপ্রধান, ডিজিএফআই ও এনএসআইপ্রধান সমন্বয়ে কোর কমিটি গঠিত হয়।

২০২৪ সালের ১৯ জুলাইয়ের পর প্রতি রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় তাঁরা বৈঠকে বসতেন। শেখ হাসিনার কাছ থেকে কোর কমিটির কাছে নির্দেশনা আসত। মামুন আরও বলেছেন, ‘আন্দোলনের একপর্যায়ে ড্রোন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয় আন্দোলনকারীদের সমবেত হওয়ার স্থান নির্ণয়ে এবং আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের জন্য হেলিকপ্টার ও লেথাল উইপেন ব্যবহার করার বিষয়ে।’

শেখ হাসিনা লেথাল উইপেন ব্যবহার করার নির্দেশ দেন, অতিরিক্ত ডিআইজি জোয়ারদার সেখানে উপস্থিত ছিলেন। লেথাল উইপেন ব্যবহার করার এই বার্তা তিনি সারা দেশের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে পাঠান।

তিনজন নেতৃত্ব দেন, যৌথ অপরাধমূলক উদ্যোগ

তথ্যাদি পর্যালোচনা করে রায়ে বলা হয়, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ও জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশনে অভিযুক্ত তিনজন যৌথভাবে নেতৃত্ব দেন, জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ (যৌথ অপরাধমূলক উদ্যোগ) হিসেবে। শেখ হাসিনার আদেশের পাশাপাশি আসাদুজ্জামান খান ও আবদুল্লাহ আল মামুনের তত্ত্বাবধানে পরবর্তী সময়ে আইন প্রয়োগকারী এবং আওয়ামী লীগের কর্মী, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সারা দেশে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও জনগণের ওপর আক্রমণ করেছে; যেখানে হেলিকপ্টার ও লেথাল উইপেন ব্যবহার করে হয়। যে কারণে প্রায় ১৫০০ লোকের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে ঢাকার চানখাঁরপুলের ছয়জন আন্দোলনকারী এবং আশুলিয়ার অপর ছয়জন আন্দোলনকারী রয়েছেন।

২০২৪ সালের ১৯ জুলাইয়ের পর প্রতি রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় তাঁরা বৈঠকে বসতেন। শেখ হাসিনার কাছ থেকে কোর কমিটির কাছে নির্দেশনা আসত। মামুন আরও বলেছেন, ‘আন্দোলনের একপর্যায়ে ড্রোন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয় আন্দোলনকারীদের সমবেত হওয়ার স্থান নির্ণয়ে এবং আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের জন্য হেলিকপ্টার ও লেথাল উইপেন ব্যবহার করার বিষয়ে।’

শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য  প্ররোচিত করে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য মাকসুদ কামালের সঙ্গে গত বছরের ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার কথোপকথন তুলে ধরে রায়ে বলা হয়, তাতে শেখ হাসিনা বলেন, রাজাকারদের তো ফাঁসি দিয়েছি, এবার তোদেরও (আন্দোলনরত) তাই করব। একটাও ছাড়ব না, আমি (শেখ হাসিনা) বলে দিচ্ছি। এই কথোপকথনে শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমি বলে দিচ্ছি, আজকে সহ্য করার পরে অ্যারেস্ট করবে, ধরে নেবে এবং যা অ্যাকশন নেওয়ার নেবে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এটি কাচের মতো স্বচ্ছ শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য তার দলের কর্মী, সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে প্ররোচিত করে। তাঁর বক্তব্য আন্দোলনকারীদের উসকে দেয়। অধিকন্তু এসব বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি আন্দোলনকারীদের  হত্যা ও নির্মূল করার আদেশ দিয়েছেন। এ–সংক্রান্ত কথোপকথন ধারণ করা পেনড্রাইভ, সিডি এবং বক্তব্যের অনুলিখন ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

শিক্ষার্থীদের দাবি অবমূল্যায়ন করেন শেখ হাসিনা

ঘটনা ও পারিপার্শ্বিকতা পর্যালোচনা করে ঘোষিত রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ২০২৪ সালের ১ জুলাই আন্দোলন শুরু করে, যা ওই বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলে।

শিক্ষার্থীদের বক্তব্য শোনা ও তাঁদের দাবি পূরণের পরিবর্তে  তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্ডারমাইন দ্য মুভমেন্ট (আন্দোলনকে অবমূল্যায়ন) এবং ‘রাজাকারস' উল্লেখ করে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে অবমাননাকর মন্তব্য করেন, যা বাংলায় গালি। 'মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা চাকরি পাবে না তো রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে' উল্লেখ করেন তিনি। অভিযুক্ত শেখ হাসিনার এই অবমাননার মন্তব্যের পরে নারী শিক্ষার্থীসহ শিক্ষার্থীরা সোচ্চার হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমবেত হয়। শেখ হাসিনার ওই শব্দচয়ন করা মন্তব্য প্রত্যাহার ও ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানান তারা।

আরও পড়ুন