স্বাধীনতা এসেছে, মুক্তি আসেনি

‘অব্যাহত মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক একক বক্তৃতা করেন দেশের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ও জনবুদ্ধিজীবী অধ্যাপক রেহমান সোবহান। বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২৩ ডিসেম্বরছবি: তানভীর আহাম্মেদ

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, স্বাধীনতা এসেছে, মুক্তি আসেনি। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরোলেও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম এখনো চলছে। গণতন্ত্র, সুশাসন, সম্পদের সমতা, ন্যায়বিচার—এসব ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি। তবে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করেছে। পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ।

শনিবার ‘অব্যাহত মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক একক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে অধ্যাপক রেহমান সোবহান এসব কথা বলেন। বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, সাহিত্যিকসহ সমাজের নানা শ্রেণির বিশিষ্টজনেরা।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অর্ধশতাব্দীর বেশি পার হয়ে এসে বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য নিয়ে বক্তৃতা করেন রেহমান সোবহান। তাঁর বক্তৃতায় রাজনীতি, অর্থনীতি, নির্বাচন, বৈষম্য, ন্যায়বিচার—এসব বিষয় উঠে আসে।

প্রথমা প্রকাশন থেকে সিটি ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ সম্পাদিত ‘একাত্তরের দিনপঞ্জি: মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি’ এবং প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী: স্মৃতি জীবন যুদ্ধ’—এ দুটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসবের দ্বিতীয় ভাগে স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বক্তৃতা দেন।

এখন সরকারি দলের সঙ্গে অন্য দলগুলো নির্বাচনের সঙ্গী হয়ে গেছে। তাঁরা এখন আপসরফা করেন, নির্বাচনে অংশ নিলে কতগুলো সংসদীয় আসন উপহার দেওয়া হবে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও আমরা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি খুঁজছি।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অর্থনীতিবিদ

একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, একটি বিষয় হলো, ক্ষমতায় যেতে পারে এমন বড় দু-তিনটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এ ছাড়া তিনি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে মসৃণ ক্ষমতার হস্তান্তরের কথাও বলেন।

রেহমান সোবহান বলেন, বিরোধী দল নির্বাচনে জিতলে নির্বিঘ্নে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে—এমন নিশ্চয়তার পরিবেশ সৃষ্টি করা উচিত; যা ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পরে হয়েছিল। প্রতিবারই বিরোধী দল নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গেছে।

প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতায় অন্যায্যতা বাড়ছে

সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতায় সমাজে অন্যায্যতা বাড়ছে বলে মনে করেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। এ সময় তিনি ছয়টি প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করেন। এগুলো হলো নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বাংলাদেশ ব্যাংক।

রেহমান সোবহান বলেন, ‘গণমাধ্যমে দেখলাম, জাতীয় নির্বাচনের এক প্রার্থীর সম্পদ ৭০০ শতাংশ বেড়েছে। নির্বাচন কমিশন বলছে, কীভাবে বাড়ল, তা তাদের দেখার বিষয় নয়। সম্পদ কীভাবে বাড়ল, তা তদন্ত করতে পারে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ ছাড়া এনবিআরও দেখতে পারে, ওই সব আয়ের কর দেওয়া আছে কি না। অথচ এই তিনটি প্রতিষ্ঠানই এসব কাজ যথাযথভাবে করে না। দুর্নীতি দমন কমিশনকে বিরোধীদের বিষয়ে তদন্ত করতে দেখা যায়। এসব প্রতিষ্ঠানের ভয়ডরহীন এবং পক্ষপাতহীন হয়ে স্বাধীনভাবে তদন্ত করার ক্ষমতা থাকা উচিত।’

রেহমান সোবহান বলেন, বিরোধী দল নির্বাচনে জিতলে নির্বিঘ্নে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে—এমন নিশ্চয়তার পরিবেশ সৃষ্টি করা উচিত; যা ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পরে হয়েছিল। প্রতিবারই বিরোধী দল নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গেছে।

বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে রেহমান সোবহান বলেন, ‘বিচারব্যবস্থার প্রতীক হলো দুই চোখ বন্ধ রাখা। এক চোখ খোলা রেখে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয় না। তা না হলে বিচারব্যবস্থা কার্যকর হবে না। আইনশৃঙ্খলা-ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে হলে সততা নিয়ে কাজ করতে হবে। কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনায় থাকা উচিত নয়।’

বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পর্কে রেহমান সোবহান বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের আমল থেকে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। এরপর এরশাদ আমলেও তা থেকে যায়। পরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব হয়নি; বরং বেড়েছে। এই খেলাপি ঋণের বিষয়টি নিয়ে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ ব্যাংক তেমন কিছু করতে পারেনি। খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি যেন এখন ব্যবসা মডেলের অংশ হয়ে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, নতুন নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া যেন বাচ্চাদের চকলেট বিতরণের মতো হয়ে গেছে। এখন ভারতের চেয়ে বেশি ব্যাংক বাংলাদেশে।

সংসদ এখন সুযোগসন্ধানীদের জায়গা

রেহমান সোবহান মনে করেন, জাতীয় সংসদের চরিত্র ক্রমাগত বদলে গেছে। সংসদ এখন সুযোগসন্ধানীদের জায়গা হয়ে গেছে। আইনপ্রণেতা শ্রেণির রূপান্তর হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সময় আয় ও সম্পদের বিবরণী দিয়েছিলেন। এখন প্রার্থীরা যা দেন, তা প্রকৃত সম্পদের চেয়ে কম। তিনি বলেন, সংসদ সদস্যরা এখন সংসদে গিয়ে সন্তোষজনক ভূমিকা রাখতে পারছেন না। খেলাপি ঋণ, স্বাস্থ্যব্যবস্থার মতো জাতীয় ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয় না। বাজেট নিয়েও এক দশকের বেশি সময় ধরে কার্যকর আলোচনা হয় না। তাঁর মতে, সংসদে ব্যবসায়ীরা বেশি। তাঁরা সংসদে গিয়ে নিজেদের স্বার্থের কথা বলেন। ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত সব প্রতিষ্ঠানেই জনপ্রতিনিধিদের চরিত্রই বদলে গেছে। ক্ষমতায় থাকলে নিজের সমৃদ্ধি দ্রুত হয়। বিভিন্ন প্রকল্পের ঠিকাদারি পেতে রাজনৈতিক পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে।

অধ্যাপক রেহমান সোবহানকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২৩ ডিসেম্বর
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

রেহমান সোবহান আরও বলেন, ‘প্রতিদিন ক্ষমতাসীন দলকে জবাবদিহির আওতায় আনার কথা, তা এখন হচ্ছে না। এখন সরকারি দলের সঙ্গে অন্য দলগুলো নির্বাচনের সঙ্গী হয়ে গেছে। তাঁরা এখন আপসরফা করেন, নির্বাচনে অংশ নিলে কতগুলো সংসদীয় আসন উপহার দেওয়া হবে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও আমরা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি খুঁজছি।’

বৈষম্য বেড়েছে

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, শুধু পাকিস্তানি শাসকদের হাত থেকে মুক্তি পেলেই হবে না, অর্থনৈতিক মুক্তিও লাগবে। একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন। এখনো অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম চলছে। বৈষম্য বেড়েছে, এখনো দারিদ্র্য আছে। একটি নতুন ধনিক শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। এগুলো নিয়েই এখন সংগ্রাম চলছে।

রেহমান সোবহান তাঁর বক্তৃতায় গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অগ্রগতির কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের চেয়ে আমরা ৬০ শতাংশ এগিয়ে আছি। আর্থসামাজিক প্রায় সব ক্ষেত্রেই পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দিয়েছি। কোভিডের সময় আমরা মাথাপিছু আয়ে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছি। কিছু কিছু সামাজিক সূচকে ভারতের চেয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। কৃষি খাতে বৈচিত্র্য এসেছে। পল্লি অর্থনীতিতে অকৃষি খাত বেশ এগিয়ে গেছে। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে এখন সারা বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। ইস্পাত উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়েছে। দেড় কোটি মানুষ প্রবাসে গেছে। তাদের পাঠানো আয় দেশের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।’

এসব অগ্রগতির তথ্য দেওয়ার পরই রেহমান সোবহান প্রশ্ন তোলেন, এসব অগ্রগতি কি আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী হয়েছে? এসব অগ্রগতি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ তৈরি করতে পারল কি? তিনি বলেন, ‘আমাদের আকাঙ্ক্ষা—আমরা একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলব। যেখানে গণতন্ত্র একটি অংশ মাত্র। অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠবে।’

অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে একটি ছোট প্রশ্ন-উত্তর পর্ব হয়।

অনুষ্ঠানে অতিথিদের একাংশ। বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২৩ ডিসেম্বর
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান, মানবাধিকার নেত্রী হামিদা হোসেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী, ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, সেন্ট্রাল উইমেনস ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন, সেন্ট্রাল উইমেনস ইউনিভার্সিটির সোশিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মালেকা বেগম, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।

আরও পড়ুন